ভ্রমণকাহিনী
আমাদের
গাড়ি ফ্লাই ওভার দিয়ে একশ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। না, কোন রহস্য গল্প বা উপন্যাস
লিখতে বসিনি আমি। নেহাতই এক ভ্রমণ কাহিনী লিখতে চাইছি। হ্যাঁ, আমরা ছুটে চলেছি পাহাড়ি
দুর্গ, নন্দী হীলের দিকে। ব্যাঙ্গালোর থেকে নন্দী হীল প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের রাস্তা।
ব্যাঙ্গালোর থেকে নন্দী হীলের জন্যে নিয়মিত সরকারী বাসের যাতায়াত আছে। আমাদের ক্ষেত্রে
আলাদা সুবিধা ছিল—নিজস্ব কার ছিল। আমরা বেলা প্রায় বারটার দিকে ছেলের কারেই বেরিয়ে
ছিলাম। রবিবার ছুটির দিন থাকায় আমরা চারজন, মানে আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে আর ছেলে বৌ,
সর্ব সাকুল্যে চারজন ছিলাম। ছেলে স্বয়ং ড্রাইভ
করছিল। না, আমার এসব উপরি সুবিধার থাকার কথা ভেবে কেউ যেন ঈর্ষান্বিত হবেন না। তাতে নিজেরই ক্ষতি হবে, এত সুন্দর পাহাড়ি ঐতিহাসিক
জাগার দর্শন থেকে তা হলে বঞ্চিত হবেন কিন্তু! হঠাৎই প্রোগ্রাম বনে গেলো, সর্বসম্মতি
ক্রমে আমরা তাই রওনা হলাম। ছেলে, বৌমা ওরা
ইতিমধ্যে একবার ঘুরে এসেছে। তবু তাদের আগ্রহ ছিল আরও একবার সেখানে ঘুরে আসার।
বেলা বারটা পার করে, একটু হেভি টিফিন, ফ্রাইড রাইস খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাতের
রাখা বেশতি ভাতটুকু পেঁয়াজ ধনিয়াপাতা ইত্যাদি সহযোগে ভেজে নিয়ে খেতে ভালই লেগেছিল।
অন্তত এই অকালের দিনে অন্ন নষ্ট করাটা মনে সায় দেয় নি। তাই গিন্নীর তৈরি এই মুখরোচক
রেসিপি রাইস ফ্রাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে আমরা কারে গিয়ে বসেছিলাম। বয়সের
স্বভাবে হবে আমি আর আমার স্ত্রী একটু বেশী কথা বলি। স্ত্রীর বর্ণনা কথা অনেকটা রীলে
গোছের হয়ে যায়। তাই আমাকেই মাঝ পথে কিছু একটা বলে তার বিরাম ঘটাতে হয়। বাইরে চোখ যাচ্ছিল,
চারদিকে কংক্রিটের অরণ্য চলেছে। ব্যাঙ্গালোরে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধায় মাথা উঁচু করা দালান
কোঠা গজিয়ে উঠেছে। তবে হ্যাঁ ব্যাঙ্গালোরে যতই পাকা দালান কোঠা হোক না কেন এখানে খালি
জাগারও কিন্তু অভাব নেই। এ জাগাকে, গার্ডের অফ সিটি বুঝি এই কারণেই বলা হয়। বাংলায়
যাকে উদ্যান নগরী বলা যেতে পারে। চলতে চলতে আমরা দেখছি প্রচুর বাগ-বাগিচা, অরণ্যানী,
ঘনবসতি, আবার কোথাও বিরল বসতি।
দু ঘণ্টা
সময়ে আমরা মাত্র পঁয়তাল্লিশ কি.মি. রাস্তা পার হলাম। এবার পাঠক আমায় চেপে ধরতে পারেন,
মশাই, কি আবোলতাবোল বকছেন? শুরুতেই কপচালেন যে ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি ছুটে চলেছে
আর এখনকার হিসাব দিচ্ছেন বিশ পঁচিশের? তা হলে একটু খোলসা করে বলি--ব্যাঙ্গালোর সিটি
এরিয়াতে ভীষণ, ভীষণ জ্যাম লাগে, বলতে গেলে কলকাতা বোম্বাইকে ফেল ফেলে দেয়। এদিক থেকে
আমার মনে হয় বর্তমান দিনে ব্যাঙ্গালোরকে গার্ডেন অফ সিটি নাম না দিয়ে অবরুদ্ধ নগরী
নাম দিলে ভাল হত। শুরুর চলার হিসাবটা আমি কিন্তু ফ্লাই ওভারের চলারটা নিয়ে ছিলাম। এ
ব্যাপারে রসিক পাঠকের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে
নিলাম। সময়ের দীর্ঘতা তবু আমরা বিশেষ একটা টের পাইনি। কারণ হল গিয়ে সেই গিন্নীর কর্ণরোচক
রীলে গল্প কথায় আমরা সময়ের অনেকটা কিল করে নিতে পেরেছি। অতিশয় কথা উক্তিতে মাঝে মাঝে
বিরক্তির ভাবের উদয় হলেও এমনি সময়ে সব ছেঁকে নিয়ে তার রোচক কথাগুলির মূল্য তো দিতেই
হবে। তবে হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে লঙ্কা আর নুনের ছিটে দিয়ে আমি তাকে রুচি বর্ধক করে তুলতে
পেরেছি। স্ত্রীর কথার মাঝে ঝাঁজ মশলা বাড়াতে এটুকুর দরকার ছিল, আমার ছেলে আর বৌমা এ
কথাই জানিয়েছে। আর দশ কিলোমিটার দূরে নন্দী হিল। ব্যাঙ্গালোর থেকে হায়দ্রাবাদের রাষ্ট্রীয়
রাজ মার্গ ধরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার যাবার পর আমরা কর্ণাটকের চকবলপুরে এসে গেলাম। বড়
রাস্তা ছেড়ে বাঁক নিয়ে আমরা এবার মাঝারি রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। রাস্তার দু ধরে এখন পাতলা
বসতি শুরু হয়েছে। বসতি ছাড়িয়ে দু পাশে জঙ্গল, সামনের দিকে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাদা সচল মেঘ জমে আছে। বাতাসে ভাসমান সে পেঁজা তুলোর মত মেঘ, যেন
নিপুণ তুলির টানে টেনে ওঠানো কোন পটদৃশ্য হয়ে সেজে আছে! রাস্তার দু পাশে আবছা রোদ
বেলার বসতি, মাঝে মাঝে ছোট বড় মন্দির, বন বনানী, পাহাড়-পর্বত, তাতে জমাট বাঁধা গাঢ়
সাদা উড়ন্ত মেঘসজ্জা দেখে নিচ্ছিলাম। আহা কি চমৎকার দৃশ্যাবলী। এমনটা দেখেছি আগেও--নেপালে
কিংবা ডালহৌজীতে। আমরা এবার অনায়াস গতিতে ছুটে চলেছি। আমাদের গন্তব্যস্থল আর বেশী দূরে
নেই, এ কথা বুঝে উঠতে পারছিলাম।
গন্তব্যের
দিকে যতটা এগিয়ে যাচ্ছিলাম চোখে পড়ছিল আঙুরের বাগান। এখানে পথের ধারে সবুজ, কালো ও
মাঝারি লালচে রঙের আঙ্গুর বিক্রি হচ্ছিলো। সস্তায় কিছু আঙুর কিনে নিলাম। টুসটুসে আঙুর
চেহারা কোন দিনই বানাতে পারিনি। তবু ইচ্ছে কার না হয় যদি একদিনে আঙুর খেয়ে এক বিন্দুও
টলটলে ভাব জেগে ওঠে শরীরে! আরও এগিয়ে গেলাম। প্রায় পাহাড়ের গোঁড়ায় এসে হাজির হলাম।
হ্যাঁ, খাবার ইচ্ছে হলে পাহাড়ের গোড়াতেই রয়েছে রেস্টুরেন্ট ও হোটেল। যেখান থেকে সুস্বাদু
খাবার খেয়ে পাহাড়ের দিকে উঠতেই পারেন। আমরা আর অপেক্ষা করছি না, মাঝ পথে উদর পূর্তির
ব্যাপারটা সেরে এসে ছিলাম। তাই অপেক্ষা না করে এবার উঠবো, পাক খেয়ে খেয়ে ওপরের দিকে।
রাস্তা পাকা, প্রশস্ত ও সুগম। নন্দী পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্র তল থেকে ১৪৫৮ মিটার। নন্দী
পাহাড়ের নামশৈলী নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। চোলের রাজাদের সময় নন্দী পাহাড়গুলি
আনন্দ গিরি নামে পরিচিত ছিল, যার অর্থ পাহাড়ের সুখ। এ ছাড়া আরও একটি গল্প হল যে যোগ
নন্দেশ্বরা এখানে নিবেদিত ছিলেন। আর সেই কারণেই তার নামকরণ করা হয় নন্দী। নন্দী ছাড়াও
সাধারণত এ পাহাড়কে নন্দী দুর্গ বলা হয়। আরেকটি তত্ত্বের মতে, পাহাড়টি এই পাহাড়ের
উপর অবস্থিত একটি প্রাচীন, ১৩০০ শতকের দ্রাবিড়-শৈলীর নন্দী মন্দিরের নাম থেকে এসেছে।
মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করে নিলাম নন্দী পাহাড়ের পাদদেশ—
পাহাড়ে
চড়তে চড়তে আমরা কুয়াশায় ঘিরে গেলাম। আসলে হালকা মেঘের চাদর আমাদের ঘিরে নিলো। ঠাণ্ডা
বাতাস চলছিল। ধোঁয়ার মত মেঘেরা এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছিল। এও এক সুন্দর উপভোগ্য দৃশ্য
বটে। পাহাড় ঘুরে উঠতে উঠতে মোবাইলে তুলে নিচ্ছিলাম ফটো ও ভিডিও। ক্রমশ দৃশ্যান্তর ঘটে
চলছিল। রাস্তার দু পাশে বন-গাছপালার মাঝে মাঝে নানা ধরনের নানা রঙের ফুলের সমারোহ চোখে
পড়ছে। এক পাশে ছোট বড় পাহাড় আর এক পাশে বিরাট খাই। এ জাগায় আমরা থামলাম। গাড়ি থেকে
নামলাম। হালকা রোদ, মেঘ জালের আস্তরণ ভেদ করে পাহাড়ের গায়ে গিয়ে পড়েছে, বাহ, কি সুন্দর
যে সে দৃশ্য। ছেলে আলাদা করে ক্যামেরা এনেছে। সে আমাদের দাঁড় করিয়ে ফটো তুলে নিচ্ছিল।
নিচে খাই গহ্বরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খণ্ড খণ্ড সাদা-কালো মেঘ জমে আছে। আমরা মেঘের
দেশ থেকেও ওপরে উঠে এসেছি ! ভাবতেও বেশ ভাল লাগছিল। আর দেরী না করে তুলে দিলাম সে সব
দৃশ্যের নজারা—মনোরম
দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে বর্ষা নেমেছে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির
মাঝে মেঘ-ধোঁয়াশা আস্তরণ ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি ওপরে। এবার সমতল জাগা পেলাম, পাহাড়ের মাথা
মুড়েই যে সমতল বানানো হয়েছে তা বেশ বোঝা যায়। বেশ দর্শনার্থীর সমাগম দেখতে পেলাম। এখানে
সূর্য উদয় দেখতে নাকি অনেকে আসেন, আবার অনেকে সূর্যাস্ত দেখতেও আসেন। আমরা তো অস্তাচল
সূর্যকেই দেখতে এসেছি। কিছু দর্শক এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পাহাড়ের শেষসীমার লৌহশলাকা
বের ঘেরে দাঁড়িয়ে ওঁরা আকাশের ও ভূতল দৃশ্য দেখে নিচ্ছে। সুযোগ বুঝে নিচের ছবিটা তুলে
নিতে ভুললাম না-- আমাদের সামনেই দেখলাম প্রশস্ত
একটা গেট। পাহাড়ের পাদদেশে যাবার সুন্দর কারুকাজ করা সিমেন্টেড গেট—
আমরা গেট
ধরে আরও ওপরে উঠে গেলাম। প্রশস্ত রাস্তা আরও বেশ ওপরে সমতল ও বন্ধুর দেশে গিয়ে উঠেছে।
কিছুটা উঠেই এক দিকে অনেক কার পার্ক করা দেখলাম। এখানে বেশ কিছু জাগায় কার পারকিংয়ের
ব্যবস্থা আছে। আমি নিয়ম মত সঙ্গে রাখা ফোল্ডিং ছাতাটা বের করে নিলাম। কিন্তু তাতে দুজনের
মাথা বাঁচানোই মাত্র সম্ভব। ছেলে, ছেলে বৌ ছাতার তলে বন্দি হতে চাইলো না, ওরা বৃষ্টি
ভেজা আনন্দ নিতে নিতে আগে আগে উঠে যেতে লাগলো দ্রষ্টব্য স্থানগুলির দিকে। এখানে কিছুটা
উপর থেকে চারদিকের দৃশ্যাবলী দেখার জন্যে লৌহ শলাকায় তৈরি টাওয়ার বানিয়ে রাখা আছে,
নিচে তার দৃশ্যমান ছবি দেওয়া হল। হ্যাঁ, প্রায় দর্শনীয় জাগাগুলিতে বাঁদরের দর্শন মিলে
যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। টাওয়ারের ওপর,গাছে গাছে, আমাদের আশপাশে ওদের দলের জমঘট
দেখলাম। ওদের ছেলে মেয়ে নাতি পুতি সবার দর্শনই পাওয়া যাচ্ছে। একটা দৃশ্য আমাদের চোখের
সামনেই ঘটে গেলো। কার থেকে এক পরিবার নামল। তাদের সঙ্গে একটা দশ-বার বছর ছেলের হাতে
কোন খাবারের পোটলা ছিল। ছেলেটা কার থেকে নেমেছে কি নামেনি একটা বাঁদর গাছ থেকে লাফ
দিলো একেবারে পোটলার ওপর। ছেলেটা চমকে ভয়ে চীৎকার দিয়ে উঠলো। ততক্ষণে তার হাতের খাবার
পোটলা লোপাট হয়ে গেছে। গাছের ওপর দু তিনটে বাঁদর মিলে সে পোটলা থেকে দেখি খাবার বের
করে কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। ছেলেটা সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এখানে থেকে আমরা হাত
দশ ওপরে উঠে, আবার কিছুটা নিচে গিয়ে বা দিকে দেখলাম একটা লাল প্রাচীন দালান। এটাই হল
টিপু সুলতানের গ্রীষ্ম কালীন নিবাস। গরমের উদদণ্ড রৌদ্র তাপ তাড়াতে সুলতান এই নন্দী
হিলের দুর্গে এসে কিছুদিন যাপন করে যেতেন। এখানে থাকা কালীন তাঁর রাজ্যশাসন এখান থেকেই
পরিচালিত হত।
তেমনি
আমরা পাহাড়ের মাঝামাঝি ডান দিকের শেষ সীমানায় বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে দেখি, টিপুস ড্রপ।
এ জায়গা থেকে দোষী আসামীকে শাস্তি স্বরূপ ঠেলে ফেলে দেওয়া হতো পাহাড়ের নিচে। প্রায় হাজার
মিটার নিচে পতিত হয়ে ওরা মৃত্যু বরণ করত। এবার টিপুস ড্রপে এসে পৌঁছলাম। এখানকার রুক্ষ
পাথর যেন নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। কি ভয়ংকর জায়গা--উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে গা
শিউরে উঠল--এখান থেকেই নাকি পাহাড়ের নিচে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হত দোষী অপরাধীদের। ব্যাপারটা
চিন্তা করেই এই চারদিকের আলো অন্ধকারের ছায়া প্রচ্ছায়ায় আমরা কিছুটা বুঝি ভয়ে সঙ্কুচিত
হয়ে গেলাম। মানস চোখে আমরা ফিরে গেলাম সেই হায়দার আলী ও টিপু সুলতানের সময়ে। হ্যাঁ,
ঠিক এখানেই অপরাধী কয়েদীদের নিয়ে আসা হত। তারপর তাদের পাহাড়ের এই অংশে এনে ঠেলে ফেলে
দেওয়া হত নিচের অতল খাইয়ে। মুহূর্ত কয়েক ভয়ার্ত চীৎকারে ভরে যেত চারদিক আর সব শেষে
করুন মৃত্যু যন্ত্রণার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসত। ইতিমধ্যে চিন্তা উৎপন্ন ভীতির জন্যে হবে
আমার স্ত্রী আমার ধার ঘেঁষে দাঁড়ালেন।
--কি গো
ভয় ভয় করছে না তোমার ? স্ত্রীর ফিস ফিস গলা খুঁজে পেলাম।
আমি ভয়ের
ব্যাপারটাকে আর একটু এগিয়ে দিলাম, হ্যাঁ তা একটু করছে বই কি! আমার কানে তো চীৎকার ভেসে আসছে।
--কার
?
--ওই পাহাড়ের
নিচে ফেলে দেওয়া হতভাগ্যদের--
ভয় পেয়ে
স্ত্রী আমায় জড়িয়ে ধরলেন ! বয়সে বুড়ো হলেও এমন পরিস্থিতি মন্দ লাগে না ! চোখ পড়ল গিয়ে
ছেলে, ছেলে বৌয়ের দিকে, ওরাও ঘন হয়ে ঠিক আমাদের মত অবস্থাতেই আমাদের থেকে কিছুটা দূরে জাগা নিয়েছে।
এগিয়ে
গিয়ে একটা নার্সারি চোখে পড়ল। এবার গার্ডেন এরিয়া এলো, তার বা দিকে পলি হাউস। তার সামনে
খেলার মাঠ। মাঠের বা দিকে পড়ে আছে জীর্ণ পুরাতন এক গেস্ট হাউজ। তার ডান দিকে রেস্টুরেন্ট, সে জাগা থেকে কিছুটা নিচে এখানেও
রয়েছে কারপার্কিং। না, রেস্টুরেন্টের দিকে এখন গেলাম না। একেবারে ঘুরে দেখেটেখে এসে
না হয় একটু চায়ের পিপাসা মিটানো যাবে। কার পার্কিংকে ডান পাশে রেখে আবার আমরা এগিয়ে
গেলাম কর্ণ হাউসের দিকে। তারপর অফিস অফ দি স্পেশাল অফিসারের চেম্বার, বর্তমানে তা তালা
দেওয়া পড়ে আছে। ডানপাশ ঘেঁষে সামনে পড়ল গান্ধী নিবাস। এখানে গান্ধীজী এসে থেকেছেন।
এখানে আছে নেহেরু নিলয়। নেহেরু জীও এ নিলয়ে এসে থেকে গেছেন। একটু ডান পাশে এগোলেই পোলার
রিভার। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় পুরানো সিমেন্ট চাতালের মাঝখানে কয়েক লিটার জল স্টোর করা আছে মাত্র। পোলার আর আরকাবতী এই দুই নদীর উৎসস্থলই
নাকি এখানে। আমরা তার সামান্য জল উৎসটুকু মাত্র দেখতে পেলাম। এবার পাহাড়ের ডান দিক
ধরে ফিরবো। ডান দিকটা ফেরার পথে আবার কিন্তু আমাদের বা দিক হয়ে যাবে। আমাদের পাহাড়ের
অর্ধ পরিসর দেখা হয়ে গেলো। টিপু ড্রপস কিন্তু এদিকের মাঝামাঝি পড়ে। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে
তার বর্ণনা আগেভাগেই দিয়ে দিয়েছি। আর একটু নেমে পেলাম ছোট খাটো দালান ঘর, বোর্ডে লেখা,
হোটেল ময়ূর। দেখে মনে হচ্ছে সেটা অনেকদিন ধরে তালা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।
এবার মন্দির
চত্বরে প্রবেশ করলাম। পাকা বেশ দীর্ঘ উঠোন পরিসরের মত জাগা, তার একদিকে পাহাড়ের ধার
ঘেঁষে ছোট ছোট কয়েদী ঘরের মত ঘর বানানো আছে। তাতে বোর্ড ঝোলানো আছে--সাবধান--ঘরগুলি
প্রবেশ যোগ্য নয়--যখন তখন ধ্বসে পড়তে পারে। কোথাও উল্লেখ পেলাম না--ঘর গুলি আসলে ছোট
ছোট মন্দির ছিল অথবা কারাগৃহ ! এক ধারে রয়েছে
অমৃত সরোবর। এর চারদিক সিঁড়ি ধাপের মত নেমে গেছে নিচে জল পর্যন্ত। এটি এক সময় এই অঞ্চলে
জল সরবরাহের একটি প্রধান উৎস ছিল, এটির নামকরণ করা হয় নেচার লেক। সন্ধ্যাবেলায় এর
অনবদ্য দৃশ্য দেখার মত বটে ! অমৃত সরোবর "নেহাওয়ার লেক" নামেও পরিচিত। এর
আর এক নাম হল, "অ্যামব্রোসিয়া লেক"। সরোবরটি একটি সুন্দর বহু বর্ষ স্থায়ী
স্প্রিং দিয়ে তৈরি। এরই চবুতরে এসে টিপু সুলতান
প্রার্থনা করতেন।
মন্দিরের
প্রবেশদ্বারে নির্মিত নন্দি (ষাঁড়) এর বিশাল এবং মহৎ মূর্তির জন্য মন্দিরটি বিখ্যাত।
যার স্থানীয় নাম নেল্লিকাই বাসবন্না (nellikai basavanna)। এখানে মোট তিনটি মন্দির
রয়েছে, প্রত্যেকটি অরুণাচলেশ্বর, উমা মহেশ্বর ও ভঙ্গের নন্দেশ্বরকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
শিবের এই তিনটি রূপ তার যৌবন, বিয়ে এবং ত্যাগের প্রতিনিধিত্ব করে। মন্দিরগুলো চমৎকারভাবে
নির্মিত, ঐতিহাসিক দেবতার সাথে সজ্জিত এবং মূর্তমান মূর্তিগুলি মন্দিরের দেওয়াল গাত্রে
ও স্তম্ভগুলির সঙ্গে স্থাপিত আছে। স্তম্ভ ও দেওয়াল গাত্রের ডিজাইনগুলি মহৎ ধারণার ওপরে
আধারিত। এটি আসলেই একটি স্থাপত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব। এবার ভক্তির কথায় আসি। আমার স্ত্রী
কিন্তু একটু বেশী ভক্তিমতী। এটার অনেকটা অবশ্য স্বভাব ও বয়সের অভ্যাসের তাড়নায় জন্ম
নিয়েছে। কিছু শুচিবাইও কি এর মধ্যে ভরা থাকবে ? থাকতেই পারে। মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি
জল খুঁজে বেড়ালেন, হাত পা তাঁকে ধুতেই হবে। তারপর পূজা দেবার ব্যাপারটাও আছে। আমরা
পূজার আয়োজন নিয়ে আসিনি, এখানেও তার ব্যবস্থা নেই। এ জন্যে স্ত্রী আমার একটু হলেও মনঃক্ষুণ্ণ
কয়েছেন বৈ কি ! তবু ভাল, আমারা দু প্যাকেট প্রসাদ কিনে নিতে পারলাম। আপাতত ভক্তির ব্যাপারটা
কিছুটা পূর্ণত্ব পেলো। তাতে স্ত্রী আমার সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। পরিসরের
মূল মন্দিরটি, ভোগা নন্দেশ্বরা, কর্ণাটকের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির একটি হিসাবে পরিচিত।
এটি ৯শতকের প্রথম দিকের তৈরি। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী, শিবের মন্দিরটি
নির্মাণের সবচেয়ে প্রাচীন শিলালিপিগুলি নওলম্বা রাজবংশের শাসক নওলামবাদীরজা, রাষ্ট্রকূট
সম্রাট গোবিন্দ তৃতীয় ৮০৬ খ্রিস্টাব্দ সে সঙ্গে বনা শাসক জয়তেজ ও দত্তিয়ের তাম্রশাসন
৮১০ শতান্দীতে স্থাপন করে ছিলেন। পরবর্তী কালে দক্ষিণ ভারতের রাজবংশগুলির পৃষ্ঠপোষকতায়
মন্দিরটি পরিচালত ছিল:গঙ্গ রাজবংশ, চোল রাজবংশ, হৈসাইল সাম্রাজ্য এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের
তত্বাবধানে। মধ্যযুগীয় যুগে, চিকবাল্লাপুরের স্থানীয় প্রধানগণ এবং মাইসোর রাজত্বের
শাসক হালদার আলী ও টিপু সুলতান এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৭৯৯ সালে টিপু সুলতানের
মৃত্যুর পর এটি শেষ পর্যন্ত ইংরেজ শাসনের অধীনে ছিল। মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী দ্রাবিড়।
এ মন্দিরের শিল্প ও স্থাপত্যকলা বহু প্রাচীনতার নিদর্শন বহন করে চলেছে। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের মাধ্যমে মন্দিরটি
জাতীয় গুরুত্বের একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে সুরক্ষিত রাখা।
এখানকার
প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রশংসা বারবার করতে ইচ্ছে হয়। পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে লোহার রেলিং,
সেখান থেকে দৃশ্যগুলি এত মানস সুন্দর যা শুধু মাত্র বর্ণনায় পূর্ণতা পায় না। তারই মাঝে
প্রকৃতি যেন আমাদের সঙ্গে খেলতে নামলো। হঠাৎ আমাদের হালকা মেঘ এসে ঘিরে নিলো। চারদিক
কুয়াশার মত, দূরের দৃষ্টি যাচ্ছিলো না। রেলিঙের ঘেরার কাছে দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য বড়
নয়নাভিরাম ছিল। এক খণ্ড বড় সাদা মেঘের টুকরো ভেসে যাচ্ছিলো। নিচে নন্দী গ্রামের দৃশ্য
কোন খেলনা ঘরের মত উজাগর হচ্ছিল। সার বাঁধা ঘর নিয়ে গ্রাম, বড় ছোট গাছের সারি নিয়ে
বন, দূরের ছোট বড় পাহাড়। মেঘ আচ্ছাদনের মাঝে মাঝে দৃশ্যমান সব মেঘ পাহাড়। আকাশের এক
কোনের কালো মেঘ, আবার সাদা মেঘের আস্তরণ মাঝে মাঝে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করছে, আবার সব পরিষ্কার
হচ্ছে। এরই মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে গেলো। ঝিরঝির রিমঝিম বৃষ্টি। গরম জামা কাপড়ের
অভাবটা এ সময় অনুভব করছিলাম। মাথা বাঁচাতে আমরা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গিয়ে উঠে পড়লাম
সামান্য দূরের টাওয়ারে, উঠতে হল লোহা শিকের মৈ বেয়ে। আরও অনেক লোকের উপস্থিতি এখানে,
বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতেই এখানে সবাই জটলা বেঁধেছে। এখান থেকেও চারদিকে নজর মারা যায়।
দূরের খাই, নিচের সবুজ ময়দান, পাহাড় শৃঙ্খল সব কিছুই নজরে আসছিল— অন্ধকার নেমে আসছিল।
এবার ফিরে যাবার পালা। আকাশের মেঘ, চারদিকের কুয়াশা, আর বৃষ্টির আড়ালে গোধূলি রঙ ফিকে
মেরে গেছে। সব মিলিয়ে চারদিকে আলো আঁধারি নিয়ে ভয়াবহ এক পরিবেশ জমাট বাঁধছিল। লোকজনের
কমি নজরে আসছিল। আর এখানে যেন ভয়শূন্য হয়ে দাঁড়াতে পার ছিলাম না। আমরা মনে মনে ফিরে
যাবার তাগিদ অনুভব করছিলাম। ফিরতে ফিরতে মোবাইল ক্যামেরায় বন্দী না করে পারলাম না এই
ত্রাসার্ত দৃশ্য--
সমাপ্ত
তাপসকিরণ রায়: কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন