ভ্রমণকাহিনী
কাশ্মীর
প্রাক-কথন
আমরা স্কুলে পড়তে যখন প্রথম শুনেছিলাম
কাশ্মীরে সন্ত্রাসের কারণে যাওয়া যাবে না, তখন থেকে মন খারাপ। ভূস্বর্গ
অদেখা থেকে যাবে? দু
দশকের বেশি সময় অপেক্ষায় গেল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে, যদিও অমরনাথ যাত্রীরা প্রাণের
ঝুঁকি নিয়ে চরম বিশৃংখলার মধ্যেও বার বার এই উপত্যকা পার হয়েছে। কিংবদন্তি, ইতিহাস ও প্রাকৃতিক
সম্পদঋদ্ধ কাশ্মীরে নতুন করে ভ্রমণের দ্বার খুলে যাওয়া মানে ভ্রমণ পিপাসুকুল আর
ভারতের পর্যটন মানচিত্র দুয়েরই নতুন অধ্যায় শুরু হওয়া। একটি পুরাণ মতে প্রজাপতি
ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবের সাহায্যে জলোদ্ভব অসুরকে বধ করে কাশ্মীর রাজ্য গড়ে তোলেন।
রামায়ণের ভরত ও শত্রুঘ্ন নাকি গিয়েছিলেন সেখানে। মৌর্য সম্রাট অশোকের অধিকারে থাকা
কালে বৌদ্ধ ধর্ম কিছুটা বিস্তার লাভ করলেও তার কোনও অবশেষ কাশ্মীর উপত্যকায় আর
খুঁজে পাওয়া দুস্কর। যা আছে লে লাদাখে,সেটাও অনেকটাই বিবর্তিত তিব্বতী প্রভাবে। পরে হিন্দু
রাজাদের প্রভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায় হিন্দুধর্ম। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে কাশ্মীর মুঘল
বাদশাহদের দখলে যার জাজ্বল্য প্রমাণ বিভিন্ন বাগিচায়, সৌধে এখনও বিরাজমান। আফগানরাও
সাময়িক দখল নেয় কাশ্মীরের। তাদের হারিয়ে উপত্যকা অধিকার করেন পাঞ্জাব অধিপতি রণজিৎ
সিং। ১৮৪৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীরের দখল পেলেও অন্যান্য পাহাড়ি
অঞ্চলের মতো এখানে বৃটিশ প্রভাব প্রকট নয়। স্বাধীনতার আগেও তা ইংরেজ শাসনভুক্ত
ছিলও না,যার ফলে ১৯৪৭-এ
স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পর রাজা হরি সিং-এর সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি আর এক বিড়ম্বিত ইতিহাস।
ভারত সরকার কাশ্মীর পর্যটনের
পৃষ্ঠপোষকতা করতে এবছর বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। ১৮ জুন ২০১২ পর্যন্ত যে কোনও
পদের সরকারি কর্মী দিল্লী ও অমৃতসর থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত এলটিসি বাবদ বিমান মাসুল
পাবে। আমরা অবশ্য আমার মা বাবাকেও কাশ্মীর দেখাতে নিয়ে যাব বলে ১৮ মে হাওড়া থেকে
ট্রেনেই চড়েছিলাম। বয়স্ক ও বাচ্চা যাচ্ছে বলে প্যাকেজ ট্যুরই বেছেছিলাম।
অনেক আগে থাকতে স্টেশনে পৌঁছে গেলে কী
হয় ট্রেন যে এভাবে ঝোলাবে আর পরের দিন দুপুরে টোকো গন্ধওয়ালা মধ্যাহ্নভোজ পরিবেশিত
হবে কে ভেবেছিল। এখানেই শেষ নয় ট্রেন দেরি করতে করতে অমৃতসর পোঁছয় আট ঘণ্টা
দেরিতে। ঘোষ স্পেশালের ভ্রমণসূচী তখন সব ভুণ্ডুল। তার ওপর আমার মা ওভারব্রীজের
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ধপাস্। সহযাত্রীরা যতই “কিচ্ছু হয়নি, উঠুন” বলে ধমকান বা শাহস
যোগান,সংঘাতিক কিছু যে হয়েছে
তা মায়ের মাটিতে পা না রাখতে পারা দেখেই বুঝলাম। এজেন্টের বাস নয়, আলাদা অটোয় করে ওদের
নির্দশিত হোটেলে পোঁছলাম। ঘোষের ছোট মালিক নিজে এসেছে। সে পোঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা
করতে হল ঘর পেতে। আমাদের অন্তত একটা একতলার ঘর চাই। মা বাবাকে সেখানে স্থাপন করে
আমাদের নিতে হল তিনতলার ঘর। জিরোনোর সময় নেই। ওয়াঘার জন্য বাস ছাড়ছে। ট্রেনের জামা
কাপড় না বদলেই চড়লাম বাসে। আমার বর মাকে ডাক্তার দেখাবে বলে হোটেলে রয়ে গেল আমার
জিম্মায় মেয়ে,মোবাইল ও ক্যামেরা
অর্পণ করে। আমাদের আগে অমৃতসর ভালো করে ঘোরা ছিল। এবার এসেছি কন্যা উর্বীর সোসাল
স্টাডি বইতে পড়া ‘গোল্ডেন
টেম্পল’দেখার বাসনা পুরণ করতে।
ওয়াঘায় এমনিতেই আড়াইটে থেকে গ্যালারি দখল না করলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়,তার ওপর দিনটা ববিবার, স্থানীয় জনস্রোতও
মিশেছে। সুতরাং বিকেল পাঁচটায় ওয়াঘা সীমান্তে পৌঁছে যা হবার তাই হল। জনতা দেখলাম, ভারত ও পকিস্তানের গেট
দূর থেকে দেখলাম,কিন্তু
পা তুলে তুলে মজাদার ভঙ্গীর কুচকাওয়াজ আর পতাকা বিনিময় মেয়েকে দেখাতে পারলাম না।
আমার কামিজের পকেট নিরাপত্তা রক্ষীদের কৌতুহলের কারণ হলেও আমার বেশ কাজে লাগল।
ওখানে ব্যাগ নিষেধ। এখানে নিজের প্রিপেইড মোবাইল অকেজো। ড্রাইভারের চলভাষে যোগাযোগ
করে সন্ধ্যে বেলায় স্বর্ণমন্দিরে সাক্ষাত করলাম মেয়ের বাবা শুভঙ্করের সঙ্গে। ওর
মোবাইল তখনও টাওয়ার পাচ্ছে। স্বর্ণমন্দিরে তখন উৎসবের সময়। প্রচুর বাজি ফাটছে আকাশ
আলো করে আর শব্দ-দুষণের মাত্রাকে কাঁচকলা দেখিয়ে। রাতের আলোয় একরকম শোভা আর দিনের
আলোয় আসল চেহারা। উর্বী কেবল প্রথমটা দেখতে পেয়েই খুশি। পরের দিন সকালে কাটরার
উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় দেখলাম দুর্গা মন্দির। আমাদের আগেও দেখা ছিল। মা তো নামতে
পারবেন না, বাবাও নামলেন না।
কাটরা-বৈষ্ণোদেবী
যে বাসে করে কাটরা যাওয়া হল তার
কাগজপত্র পারমিটে গলদের খেসারত দিয়ে সকাল নটায় বেরিয়েও কাটরা পৌঁছতে রাত এগারোটা
পেরিয়ে গেল। এতক্ষণ আমাদের বৈষ্ণোদেবীর পথে পদব্রজে,ঘোড়ায় বা ডান্ডিতে রওনা হওয়ার
কথা। বাস যেখানে থামিয়েছে সেখান থেকে হোটলে মাকে আনতে হল আলাদা অটো ভাড়া করে। আমি
হোটেলের হদিশ, বাবার দিকে নজর, মেয়েকে সামলানো আর
মালপত্রের তত্বাবধান এতকিছু একসাথে অত নিপুনভাবে করতে পারি আগে জানতাম না। মায়ের
অবস্থার জন্য একটা একতলার রুম সঙ্গে-সঙ্গে পাওয়া গেলেও আমরা বাচ্চা নিয়ে রাত
বারোটা পর্যন্ত খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে রইলাম,যতক্ষণ না আমাদের এক সহযাত্রী
রায়দা নিজেরা পাঁচজন মানিয়ে নিয়ে আমাদের নিজের তিনতলার ঘরখানা ছেড়ে দিলেন। তবে
হোটেল ‘হরি রিসর্ট’বেশ ভালো। পরের দিন
মাকে ডাক্তার দেখাব, এক্সরে
করাব বলে পর্চি পাওয়া সত্বেও দেবীদর্শনে গেলাম না। মায়ের বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে
দুটুকরো। কলকাতায় ফিরে অপারেশন করাতে হবে,প্লাস্টারে হবে না। বিকেলের
কাছাকাছি একটা পার্কে কিছুটা সময় কাটালাম। কেনাকাটার শুরু হয়ে গেল কাটরা বাজার
থেকেই। বিস্তর দোনোমোনো আলাপ আলোচনার পর স্থির হল,যখন টাকাও ফেরত হবে না আবার তৎকালে এসি টুটায়ারের টিকিটও
পাওয়া যাচ্ছে না,তখন
২৯ মের সেকেন্ড এসির কনফার্মড টিকিট বাতিল না করে ভ্রমণটাই পুরো করি। ভাঙা পায়ে
বিশমণি স্ল্যাব,বেডপ্যান আর বাড়তি
কুড়িহাজারি শেভরোলে ট্যাভেরা ভাড়া নিয়ে ২৩মে সত্যি-সত্যি শ্রীনগরের পথে পাড়ি
দিলাম।
শ্রীনগর:
স্বর্গের রাজধানী
আমি পাটনিটপ ঘুরতে বিশেষ আগ্রহী ছিলাম।
কথা ছিল পাটনিটপে একটি পার্কে দুপুরের খাবার দেবে। আমরা ছোট গাড়ি নিয়ে অনেক এগিয়ে
গিয়ে পাটনিটপ পুলিসফাঁড়ির কাছে একঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়ে রইলাম। অদ্ভূদ জায়গা। হালকা
শিরশিরে বাতাস। অথচ দূরে পাহাড়ের চূড়ায় বরফ দেখা যাচ্ছে। শীতে নিশ্চই এখান থেকেও
সব তুষারাবৃত পাহাড় দেখা যায়। একটা ছোটদের অ্যামিউজমেন্ট পার্ক মতো আছে। ঘোষরা
কিন্তু দুপুরের খাদ্যবিরতি দিল রামবনে একটা নোংরা ধাবায়, পার্কে নয়। আমি যতটা পারলাম
ক্যামেরাবন্দী করলাম। ঝিলম নদীকে পাশে রেখে মনোরম পথে চলতে চলতে বনিহালের আগেটায়
মারাত্মক যানজটে থেমে যেতে হল। এর উৎস জওহর টানেল, যেটা পার হলেই নাকি মর্ত্য থেকে
স্বর্গারোহণের অনুভূতি হয়। আড়াই কিলোমিটারের দর্শনীয় এই টানেল যখন পেরোলাম তখন রাত
সাড়ে দশটা। পথের নৈসর্গিক দৃশ্য সব অন্তর্হিত। কিছু লোক চেরি, স্ট্রবেরি বিক্রি করছে।
আমরা একটা ধাবায় ফর্সা ফর্সা কাশ্মীরি ছেলেদের খেতে খেতে রান্না করা এঁটো হাতে
পরিবেশিত অতি সুস্বাদু রুটি, টমেটো তড়কা, পনির মসালা,রাজমা খেয়ে নিলাম। ড্রাইভার দলের সিং আবার এক প্লেট ভাতও
খেল। তা আমার মাকে কোলে-পিঠে করে গাড়িতে তোলা নামানোর দায়িত্বও তো তার। শ্রীনগর
পোঁছলাম রাত দুটোয়। আগে বলা হয়েছিল,হোটেল গউসিয়া, এখন নির্দেশ এল তার পাশেরটায় যেতে। যোগাযোগ সিংজির
মোবাইলে। হোটেলের নামই বলতে পারল না ঠিক করে! হোটেলদুটো খুঁজে পেলাম। রাস্তা থেকে
বেশ খানিকটা ভেতরে। গউসিয়ার পাশে ‘হোটেল ইরাম। বাকি গাড়িগুলোর মধ্যে একটা নাইনসিটারও
আমাদের সাথে পৌঁছেছে। অত্যন্ত ব্যাজার মুখে আমাদের যে রুমগুলো খুলে দেওয়া হল তাতে
নরকবাসের গ্যারান্টি। আসলে বুকিং ছিল গউসিয়ায়। তারা ভরা মরশুমে বেশি টাকায় অন্য
পার্টি ঢুকিয়ে ঘোষ স্পেশালের পর্যটকদের ঠেলে দিয়েছে পাশে তাদের আত্মীয়ের হোটেল
ইরামে। ইরাম অন্যের দায় নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত যার প্রকাশ করছে বোর্ডারদের সাথে
যথেচ্ছ ব্যবহার করে। এইখানেই চার দিন? অন্যরা হোটেল দেখে ও রুম নিয়ে চ্যাঁচামেচি করলেও পঙ্গু
মা, নড়বড়ে বাবা আর বাচ্চা
নিয়ে শুভঙ্কর রাত তিনটেয় ঝামেলা করার পক্ষপাতী নয়। মাকে পরিচর্যা করে এসে দেড়খানা
বালিস একখানা কম্বল আর উৎকট দুর্গন্ধ সম্বল করে শুয়ে পড়লাম। সব ঘরের মেঝে থেকে
বাথরুমের মেঝে দুফুট উঁচুতে। মাকে বাথরুমে একা নিয়ে যেতে পারব না।! গোলমালের
মধ্যেই দিনের আলো ফুটল। এক বিকট পৃথুলা বৃদ্ধার গলার জোর সব চেয়ে বেশি। তিনি ঘোষের
সাথে-সাথে নিজের হেঁচকি তোলা স্বামীকেও লাগাতার বকে গেলেন এবং অন্য হোটেলে
ব্যবস্থা করে নিতেও সক্ষম হলেন। আরও কেউ কেউ পরের দিন অন্যত্র জায়গা করে নিল।
একতলার ঘর একটা অন্তত চাই বলে আমরা ঐ আস্তাবলেই পড়ে রইলাম; আর চার দিনই কানে -এল ওরা
কাশ্মীরি, এসব ওদের প্রপার্টি, পছন্দ না হলে বেরিয়ে
যেতে হবে, ওরা যখন বলবে রুম খালি
করতে হবে। আর হোটেলের বোর্ডাররা যে অতিথি নয়,‘বহিরাগত’‘আউটসাইডার’,তা শ্রীনগরে না এলে
জানতে পারতাম না। অন্যান্য আউটসাইডাদের সাথেও রোজ লাগত। হোটেল ছেড়ে বাইরেটাতেই আসা
যাক। আজ, ২৪মে তো স্থানীয়
ঘোরাঘুরি।
ডাল-হ্রদ
ও শিকারাবিহার
ডাললেকের ধারটা অনেকটা মেরিন ড্রাইভের মতো
উন্মুক্ত। উজ্জ্বল রোদে ভারি মনোরম। ড্রাইভারের আগ্রহে শিকারায় চড়লাম বাবা, শুভঙ্কর, উর্বী আর আমি। আমার
ইচ্ছা ছিল সব বেড়িয়ে এসে ধীরে সুস্থে জলবিহার করব। কিন্তু দলের সিং-এর কমিশনটা
তখনই চাই। গাড়িতে বসে থাকা মায়ের কথা ভেবে ও সিলেবাস কমপ্লিটের তাগাদায় দুঘণ্টা
শিকারায় ঘুরে নেহেরু পার্ক,ফ্লোটিং মার্কেট,মীনা বাজার,ভাসন্ত বাগান,দূরে পাহাড়ের মাথায়
আকবর ফোর্ট,বরফচূড়ো এসব দেখে
গাড়িতে ফিরলাম। লেকের অনেক জায়গায় কৃত্রিম ফোয়ারা।
শঙ্করাচার্য
মন্দির
এরপর শঙ্করাচার্য মন্দির। হাজার ফুট উচ্চতা
পর্যন্ত পাহাড়ি পথ চড়ার পর গাড়ি থেমে গেল। এবার আড়াইশো সিঁড়ি। অশোক-পুত্র ঝালুকার
তৈরী শিব মন্দিরের নবনির্মাণ করেন জাহাঙ্গীর যা এখন লোকে দেখতে আসে। আরব আগমণের
বহু পূর্বে শঙ্করাচার্য এই পাহাড়ে তপস্যা করেন বলে কথিত। সুতরাং তখত্-ই-সুলেমান
পাহাড়ের নাম কবে থেকে শঙ্করাচার্য পাহাড় হল আর মন্দিরটির নামকরণ শঙ্করাচার্যের
নামে হওয়ার কী কারণ সেটা পরিস্কার নয়। নিরাপত্তার কড়াকড়ি চোখে পড়ার মতো। এখান থেকে
শ্রীনগর শহর আর ডাল লেক দেখতে ভারি সুন্দর। সেখান থেকে হোটেলে ফিরতে হল দুপুরের
খাবার জন্য। খাওয়ার পর বেরোলাম বাগানগুলো দেখতে। বাগানগুলিকে সমবেতভাবে ‘মুঘল গার্ডেন’বলে পরিচিত।
পরিমহল
পথে আগে পড়ল চশমাশাহি। প্রথমেই সেখানে না নেমে
আরও দু-কিলোমিটার ওপরে উঠে পেলাম পরিমহল। ঘোষের ভ্রমণসূচীতে নেই। পূর্বেকার বৌদ্ধ
মঠে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চার কেন্দ্র তৈরী করেন মোগল বাদশাজাদা দারাশুকো। ছয় ধাপের
সুন্দর বাগান। এখান থেকে ডালহ্রদ ছাড়াও দেখা যায় শ্রীনগরের হেলিপ্যাড, গল্ফকোর্স যা নাকি
এশিয়ার বৃহত্তম আর বিশ্বে তৃতীয়। আর দেখলাম সিজারবাগের শূন্য টিউলিপ উদ্যান যা
ফুলের মরশুমে দেখার জন্য পর্যটক উপচে পড়ে। এবছর মার্চের বদলে এপ্রিলে ফুল ফুটেছিল।
স্থায়িত্ব মাত্র দিন কুড়ি। গুলাম নবি আজাদের আমলে নির্মিত এই উদ্যান শ্রীনগরের
অন্যতম আকর্ষণ। পরিমহল Ancient Monuments and Archiological
Survey of India দ্বারা
সংরক্ষিত। এখানেও কড়া নিরাপত্তা।
চশমাশাহি
নেমে এলাম চশমাশাহির কাছে। যাবার সময় এত ভিড়
দেখিনি। বাগানের আয়তন বেশি না হলেও বাইরটাও দেখবার মতো। সিঁড়ির দুপাশে খাঁজকাটা
ঢেউ খেলানো ঢালে ধাপে ধাপে ঝাউ ও ফুলের গাছ। ভেতরে চিনারও রয়েছে। এই বাগিচার
নির্মাণ সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময় শুরু হয়ে শেষ হয় শাহজাহানের আমলে। এখানে প্রবাহিত
ঝরনার জল নাকি স্বাস্থ্যকর। আমরা অবশ্য কেনা বোতল ছাড়া সে জল পান করিনি নেহেরুজী
করতেন শুনেও। বরং শুভঙ্কর টয়লেট থেকে ফিরে রিপোর্ট দিল আমাদের হোটেলের চেয়ে অনেক
ভালো।
নিশাতবাগ
চশমাশাহি থেকে ৪ কিমি দূরে এর প্রবেশ পথ।
জাবরওঁয়া পাহাড়ের পাদদেশে নূরজাহানের ভাই আসফ খাঁর উদ্যোগে ধাপে ধাপে তৈরি এই বাগানে গাছপালা ফুল একই রকম, তবে বিশাল। ঝরনাও
নেমেছে ধাপে ধাপে। এর ওপরের ধাপগুলো থেকেও ডাললেকের দৃশ্য। হ্রদখানা শ্রীনগর শহরকে
একদিকে যেমন বেষ্টন করে আছে, তেমনি এর শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে শহরের অলিতে-গলিতেও। আবার
এই বাগানগুলো থেকে দেখলে মনে হয় লেকের ধারেই বুঝি শ্রীনগর। বিকেল সাড়ে ছটাতেও আকাশ
আলোয় ঝলমলে। গায়ে গরম জামার দরকার হয় না এমন মধুর বাতাস, অথচ দূরে তুষারাবৃত পাহাড় দেখা
যায়।
শালিমার
বাগ
বেগম নূরজাহানকে উপহার বাদশা জাহাঙ্গিরের। মা
কোনও খানেই নামতে পারছেন না। বাবাও সিঁড়ি ভাঙার ভয়ে মাকে গাড়িতে সঙ্গ দিচ্ছেন।
আমরা তিনজন সূচী মিলিয়ে ঘুরে নিচ্ছি। সিংজী সমেত সবাই মিলে প্রথমে সফ্টি খেলাম।
তারপর সিলেবাসে প্রবেশ। ফুল, ঝাউ, ঝরনার আর এক বিন্যাস। মাঝে আছে মার্বেল প্যালেস। আকাশ
এবার লালচে। ও হ্রদে সূর্যাস্তের ছবি তুলবে বলে ক্যামেরা বাগিয়ে বসে রইল। কিন্তু
দিগন্তরেখার খানিক ওপরেই সূর্যকে মেমারিবন্দী করে ফিরতে হল। ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে
সূর্য সহজে গুডনাইট বলেনা। সব বাগানেই স্থানীয় পোষাক পরে ছবি তোলাবার জন্য
ঝুলোঝুলি। যে ঝলমলে পোষাক ও গয়না পরিয়ে ছবি নিচ্ছিল তেমন পোষাক কোনও কাশ্মীরি নারী
পুরুষের গায়ে দেখিনি। কাজ ছাড়া ম্যাড়ম্যাড়ে আলখাল্লা আর ফিরান বয়স্ক কারও কারওকে
পরতে দেখেছি। পুরুষদের গায়ে শার্টপ্যান্ট আর মেয়েদের সালোয়ারের সাথে বিশেষ ভাবে
মাথা ঢেকে ওড়না বা হিজাব বা বোরখা আর সোয়েটার জ্যাকেট এসবই তো দেখলাম। নাসিমবাগ
পারস্য থেকে আমদানি করা চিনার বৃক্ষের সমাহার। নামের অর্থ ভোরের বাতাস। কিন্তু
সন্ধ্যে বেলার শীত, ক্লান্তি
আর অক্ষম ভ্রমণসঙ্গী সবাই বলছে কুঠুরিতে ফিরে চল। কোনওক্রমে উঁকি মেরে ফিরে চললাম।
মহাদেব পাহাড়ে ঘেরা জলাধার হরওয়ান নিয়ে
যেতে রাজি হল না ড্রাইভার। খরচ আর রুগী বহন ছাড়া আলাদা গাড়ি ভাড়া করার কোনও সুবিধা
পেলাম না। ট্রাভেল এজেন্টকে দেওয়া গাড়িভাড়াও ফেরত হয়নি। তার বদলে দলের একটা
হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট্স এম্পোরিয়ামে গাড়ি দাঁড় করাল। দাম বেহঁশ করার পক্ষে যথেষ্ট।
শিকারাবিহারের সময় ভাসন্ত বাজারে অনেক পছন্দসই জিনিস অনেক কম দামে পাচ্ছিলাম।
কাশ্মীরে সূচীশিল্পের পথিকৃত স্বয়ং জৈন-উল আবেদিন দেখলেও মোহিত হতেন। আমার বর তখন
কিনতে দেয়নি। এখন ড্রাইভার বখ্রা পেয়ে খুশি হবে বলে বলছে, পছন্দ কর। আমি বহু কষ্টে
গ্লোকোমায় আক্রান্ত বাবা আর পরোপকারী স্বামীকে নিরস্ত করে গরম মশলা দেওয়া লিকার
চায়ের আতিথেয়তার মান না রেখে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।
সোনমার্গ
সকালে গরম ভাত আলুপোস্তো, বিউলির ডাল, মাছ সহকারে খেয়ে নিয়ে
জলখাবারটা প্যাক করিয়ে নেবার পক্ষপাতী ছিলাম আমি। মাকে ধমকে ও নিজেরটা তাই করেছি।
বাকিরা কাঁচা পাউরুটি, ডিম, কলার ব্রেকফাস্ট করল।
আমার অনশনে থাকা মেয়েকে আলুপরোটা কিনে খাওয়ানোর ব্যর্থ চেস্টা হয়েছে। নটা নাগাদ
বেরিয়ে পড়লাম সোনমার্গের পথে। দার্জিলিং সিকিমে যেমন কাঞ্চজঙ্ঘা দর্শনের জন্য
প্রকৃতির কাছে সাধ্যিসাধনা করতে হয়, কাশ্মীরে তেমন নয়। পাইন, ওক, চিনার,আখরোট আর রকমারি গোলাপের ঝাড়
ছেড়ে বার বার চোখ দূরের তুষার ছাওয়া পাহাড় চূড়ায় চলে যাচ্ছিল। ভারি সুন্দর একটা
নদী, বোধহয় সিন্ধু – স্থানীয় লোকে বলছে ‘নালা’ আমাদের পাশাপাশি ছুটে
চলল। পথে দেখলাম হজরতবাল মসজিদ আর কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিয়দংশ। কঙ্গনে গাড়ি
থামল চা বিরতি হিসাবে। আমরা চা,ফ্রুটি,চিপস্,বিস্কুট কিনলাম। সর্দার খেল তিনখানা আলুপরোটা। সকালের ‘ব্রেকফাস্ট’এ তার ফাস্ট ভাঙেনি।
আহা,আমার বেতালরূপী মাকে
বিক্রমের মতো পিঠে তো নিচ্ছে। বড় রাস্তা থেকে উঁচু-নীচু সিঁড়ি,একফুট উঁচু চৌকাঠ
ইত্যাদি পেরিয়ে হোটেলের দূরত্ব তো কম নয়। আকাশ মেঘলা। পথের সৌন্দর্যে একএক জায়গায় মনে হচ্ছে সেখানেই নেমে পড়ি।
সোনমার্গে পৌঁছেই সিং-এর নেতৃত্বে ঘোড়াওয়ালার খপ্পরে, থাজিবাসে গ্লেসিয়ারে যেতে হবে।
আমার হাঁটার ইচ্ছা ছিল। যাচ্ছেতাই ভাড়ায় তিনটে ঘোড়া নিতে হল। পরানো হল চিট ময়লা
দুর্গন্ধযুক্ত জ্যাকেটও। টিপ্টিপ্ বৃষ্টিতে ভয়ানক ঠান্ডায় আমি ও আমার মেয়ে বেহাল।
ভয়ানক এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা। ঘোড়া পা ফস্কালে অনেক নীচে পড়ে পাথরে ঘা খেয়ে
দুমড়ে মুচড়ে যেতে হবে। উর্বী তো কান্না জুড়ল। ‘সত্তে পে সত্তা’ ও ‘রাম তেরি গঙ্গা মৈলি’র শ্যূটিং স্পট দেখার
আগ্রহ ছিল না। কাদাজলে ভরা এক জায়গায় গিয়ে ঘোড়া থেমে গেল। মাটিতে পা দিয়েই বুঝলাম
জুতো ফাটা। মোজা ভিজে যাচ্ছে। মোজা ভিজছে উর্বীরও। কয়েক পা হেঁটে কাদা-কাদা বরফ।
স্লেজ নেয়ার জন্য জবরদস্তি। ওদের মাটিতে ওরা টাকা না নিয়ে হাঁটতে দেবে না যেন।
যারা হেঁটে গিয়েছিল তাদের ওপর বেশ রাগ। তবে তাদেরকে স্লেজের জন্য জোরাজুরি করছে না।
কিন্তু আমার ভালোমানুষ বর, ক্রন্দরত মেয়ে আর ঠাণ্ডায় অসুস্থ আমাকে পেয়ে রীতিমতো হাত
ধরে টানাটানি। সাদা বরফ পর্যন্ত পৌঁছনোই গেল না ওদের বাধায়। শরীরও খারাপ লাগছিল।
২৭৪০ মিটার উচ্চতায় আমার কিছুই হবার কথা নয়। ভূটানে এর চেয়ে অনেক উঁচুতে আমরা
ছিলাম। সিকিমেও জিরো যেতে যেতে বায়ুর চাপ কমে পপ্কর্নের প্যাকেট ফেটে যেতে
দেখেছি। কিন্তু বৃষ্টি পড়ে যা ঠাণ্ডা হয়েছে তাতেই কাবু হয়ে গেছি। সঙ্গে ঘোড়ায়
প্রাণ হাতে করে এসে কান্না জোড়া শিশু। জোর করে স্লেজে বসিয়ে কাদার ওপর বিশফুট টেনে
এনে দুশো টাকা কেড়ে নিল। কফি, দুধ খেতে আর ঘোড়াওয়ালাদের খাওয়াতে আরও দেড়শো বেরিয়ে গেল।
আমার মেয়ে তো ফেরার পথে কিছুতেই ঘোড়ায় চাপবে না। হৈচৈ শুনে ঘোড়া রেগে গেলে বা পা
ফস্কালে বিপদের সীমা থাকবে না। গাড়িতে ফিরে মনে হল কঠোর শাস্তি আর আড়াই হাজার
টাকার জরিমানা দুটোই হল। ঘোষ কোম্পানির গাড়ি খুঁজে পেলাম না। সিংজির ফোনে যোগাযোগ
করেও লাভ হল না। দুপুরে আমার জোর করে আনা পাঊরুটি কলা ভাগ করে ক্ষুদাগ্নিতে
ঘৃতাহূতি দিয়ে ফিরতি পথ। আলাদা গাড়ি নিয়ে ভেবেছিলাম কার্গিলের পথ কিছুটা ঘুরে আসব।
মায়ের পক্ষে সারাদিন প্রাকৃতিক প্রয়োজন চেপে কতটা সহযোগিতা করা সম্ভব হবে সে নিয়ে
সন্দেহ ছিলই। এখন আমি নিজেই এক পায়ে নিজের অন্য পায়ে বরের মোজা পরে কন্যার কান্না
থামাতে থামাতে সব ভুলে গেলাম। আসার সময়
নদীর ধারে একটা সুন্দর পার্কের সামনে থামতে চেয়েছিলাম। দলের সিং বলেছিল
ফেরার সময়। এখন ফিরতি পথে প্রবল ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির মধ্যে ওখানে বিশ টাকার টিকিট
কেটে বাথরুম ব্যবহার করে এলাম। গাড়িতে হিটার চালিয়ে একটু সুস্থ হলাম। আমার অবস্থা
আর রাগ দেখে ভীমসেন ড্রাইভারও হোটেলে ফেরার আগে উদ্বৃত্ত ব্রেকফাস্ট ছাড়া কিছু
খেতে চায়নি।
গুলমার্গ
বন্ধ
বন্ধ সংস্কৃতি যে পশ্চিমবাংলার পেটেন্ট
নেওয়া নয় তা এখানেও টের পেলাম। ঘোড়াওয়ালাদের সাথে গাড়িওয়ালাদের বিরোধ। সরকারি
হস্তক্ষেপও আছে পর্যটকদের বিরক্ত করার বিরুদ্ধে। গুলমার্গের ঘোড়াওয়ালারা নাকি
সোনমার্গের চেয়েও ভয়ানক। গণ্ডোলা পর্যন্ত পৌঁছতেই দেয় না। টিকিটের লম্বা লাইন থেকে
বাঁচতে দালালের খপ্পরে পড়তে হয়। আগে থেকে অনলাইন টিকিট খেটে রাখলে সুবিধা। অবশ্য
বন্ধের জন্য পৌঁছতে না পারলে টিকিট বাতিল করে পয়সা ফেরত পাওয়া যায় কিনা জানি না।
আমাদের পাঁচ জনের পারিবারিক টিমের যা দশা তাতে গুলমার্গ যাওয়া যাবে না শুনে বেশ
স্বস্তি পেলাম। অতীতের গৌরীমার্গ ১৫৫১ সালে সুলতান ইউসুফ শার সৌজন্যে আজকের গুলমার্গ।
বানিয়ে বানিয়ে গুলমার্গ ভ্রমণের বৃত্তান্ত শোনানো অসম্ভব ছিল না ইন্টারনেট আর
হাজারো পত্রিকার যুগে। কিন্তু সত্যিটা হল,মা বাবা আর বর হোটেলের কুঠুরিতে
কাটাল। আর আমি মেয়েকে নিয়ে বেরোলাম কাছাকাছি বাদ পড়ে যাওয়া স্থানগুলো দেখতে।
হজরতবাল
মসজিদ
শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে ডাললেকের
পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই মসজিদ বা দরগা খুঁজে পেতে সর্দারজি হিমশিম। সোনমার্গের পথেই তো দেখেছিলাম। যাইহোক
ভেতরে ঢুকলাম। পুরুষরা নমাজ পড়ে ভেতরে একটা বড় হলঘরে আর নারীরা বাইরের চত্বরে।
একদম ভেতরে কাচের আধারে হজরত মহম্মদের গোঁফের একটি কেশ নাকি রক্ষিত। আমাদের সেখানে
বোধহয় প্রবেশাধিকার নেই, শুধু বাইরের কাউন্টারে দান করে ধন্য হতে পারি। কবুতরের
সমাহার ছাড়া তেমন কিছু দর্শনীয় লাগল না। এই মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আর একটা
কারণেও। এখান থেকেই কাশ্মীরের স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত, যা বর্তমানে পর্যটন
অর্থনীতির প্রলোভনে স্তিমিত হলেও নির্বাপিত ভাবলে ভুল হবে। সেখানে একটা কাউন্টারে
কিছু মানুষের বিশ্বাস মতে যিশু খ্রীস্টের
সমাধি ‘খানিয়ার’ যাবার পথ নির্দেশ চাইতে
প্রশ্ন এল
“আপ
ক্রীস্চান হেয়?”
বললাম,“ইনসান হুঁ। মজহব
ইনসানিয়ত”।
ক্ষীরভবাণী
মন্দির
গাণ্ডেরোয়াল তহশিলের তুল্লামুল্লায় অবস্থিত কড়া
নিরাপত্তায় ঘেরা মন্দিরটি নাকি রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠা। বনবাসকালে দেবী
রাগন্যারপূজো করেন এবং বনবাসান্তে দেবীর ইচ্ছায় তাঁকে পুরোন স্থান থেকে বর্তমান
স্থানে হনুমানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেন। দুধ ও ক্ষীর নিবেদন করা হোত বলে নাম
ক্ষীরভবাণী। মে মাসে আটদিন উপবাসে থেকে ভক্তরা পূজো দেয়। নবম দিনে আসাএ কথা
কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের। দশমীর দিনটিকে আবার ‘বিজয়া দশমী’ বলে। তবে বর্তমান
নির্মাণটি মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদের ফিতে কাটায় ২০০৩ সালে তৈরি। এখানে নানা
রকম সমাজসেবামূলক দাতব্য কর্মশালা চলে প্রায়ই। স্বাস্থ্যশিবির, কম্বলদান এসব চলছিল।
পূজোর সামগ্রীর মুসলমান দোকানিও চোখে পড়ল।
আকবর
কেল্লা ও কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়
ফেরার পথে পুলিস বা কোনও স্থানীয় বাসীন্দা,কেউই হরিপর্বতের ওপর
নির্মিত ‘আকবর ফোর্ট’-এর পথনির্দেশ দিতে পারল
না। ড্রাইভারের তো যাবার ইচ্ছা ছিলই না। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৬ সালে এই দুর্গ তৈরি
করান। ভেতরে নাকি অনেক হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরও আছে। রাস্তায় চোখে পড়ল। দূর থেকে
ছবি তুললাম। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলানা রুমি প্রবেশদ্বার দেখতে পেলাম। যেটুকু
চোখে পড়ল ভেতরের দৃশ্য,তাতে মনে হল বাগিচাগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটাও
কম দর্শনীয় নয়।
হোটেলে ফিরে সন্ধ্যেয় মায়ের মন রাখতে
শাল কিনতে হেঁটেই বেরোলাম। পাবলিক বাসে চেপে লালচকে গেলাম। সাধারণ যাত্রী ও
কন্ডাকটারদের ব্যবহারে আন্তরিকতা দেখে হোটেলমালিক ও কর্মীদের সাথে মেলাতে পারছিলাম
না। অনেকেই বাংলা বলে মন কাড়ার চেষ্টা করছিল। একজন দোকানের দালাল ছাড়া আর কারও
কিন্তু কোনও স্বার্থ ছিল না। কাশ্মীরের সত্তর শতাংশ পর্যটক যে বাঙালি এ তথ্য
গউসিয়ার মালিকের ভাইয়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। একে মরশুম তার ওপর ভারত সরকারের কাশ্মীর
প্যাকেজ। ডাললেকের আশপাশে কলকাতার অষ্টমীর রাতের জনস্রোত। এই জনজোয়ারে পর্যটকও
নাকাল হয়,
স্থানীয়
বাসিন্দারাও বদনাম হয় – মন্তব্য করল একজন। জনহিতার্থে জানাই, হোলসেল মার্কেট বলে
লোকদেখানো যে শোরুমগুলো রয়েছে সেগুলোতে মোটেই ন্যায্য দামে জিনিস পাওয়া যায় না। আর
একটা ভালো ব্যাপার নজর করলাম। অন্যান্য হিল স্টেশনে যেমন দুপা দূরে দূরে মদের
দোকান,
এখানে
একটাও চোখে পড়ল না। তবে প্রতিভাবান ব্যক্তিরা ঠিক সন্ধান করে নেয়।
পহেলগাঁও
যাত্রা
ভোর পাঁচটা থেকেই চেক আউটের তাড়া আসতে
লাগল। দরজা ধাক্কা,সংঘাত, চেঁচামেচি,বিদ্যুৎ সরবরাহ কেটে
দেওয়া ইত্যাদির মধ্যে বেরিয়ে আসার আগে ‘চার আখবারোমে লিখতি হুঁ মেয়’ এই ফাঁকা আওয়াজের ফলে ইরামের
নতুন লিজ নেওয়া মালিকের সিংহ থেকে মুষিকে পরিণত হয়ে ‘ম্যাডাম, ম্যাডাম..স্যর স্যর’ করাটা বেশ উপভোগ করলাম।
জলখাবার খেতে বসে জানলাম ঘোষ পরের বুকিংটা গউসিয়া
থেকে বাতিল করেছে। গউসিয়ার মালিকের মন্তব্য এল ‘ডার্টি বেঙ্গলি’। জবাবে শান্ত শভঙ্করও
জ্বলে উঠল।
সকাল সকাল শ্রীনগর থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে ২১৯৫
মিটার উচ্চতায় স্থিত পহেলগাঁও-এর পথে। হোটেলবাসের মালিন্য কাটিয়ে দিল পথের
সৌন্দর্য্য। রাস্তায় আপেল আখরোটের বাগান, উইলো কাঠনির্মিত ক্রিকেট ব্যাটের কারখানা। নাইনসিটার
থেমে কয়েকটা ব্যাট কিনল। বাকি দুটো বাসের যাত্রীরা কিনেছিল কেউ কেউ। জাফরান কেনারও
আওহ্বান ছিল। মে মাস আপেল, জাফরানের বেগুনি ফুল, টিউলিপ কোনওটারই সময় নয়; শুধু আমাদের বাচ্চাদের
স্কুলের ছুটি। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে লিডার নদী, বরফমণ্ডিত চূড়াগুলো মনে হচ্ছে
হাতছানি দিচ্ছে। মোহিত হয়ে তাই দেখছি। এক জায়গায় নদীর ওপর র্যােফটিং-এর আয়োজন আছে।
তীব্র ইচ্ছা দমন করে শুধু চা খেয়ে আর শাল কিনে এগিয়ে গেলাম। আমাদের যা অবস্থা তাতে
বেশি অ্যাডভেঞ্চার মানায় না। শিকারা বা ঘোড়ায় চাপার চেয়ে এই রাইড অনেক বেশি
আকর্ষনীয় ও নতুনতর হোত বলা বাহুল্য। পত্রিকায় পড়া অবন্তীপুর, খানাবল আলাদা করে দেখা
গেল না। পৌঁছে গেলাম ১২টি তুষারশৃঙ্গে ঘেরা পহেলগাঁওতে বিকেল বিকেল। ‘হোটেল অমরনাথ’। শ্রীনগরে হাজতবাস করে
এসে এই হোটেল দেখে মন ভালো হয়ে গেল। বারান্দায় বসেই দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে। একতলা
আর কমোড,
এই দুই
পেতে গিয়ে ভালোতর ঘর ছেড়ে অন্যদিকে পাশাপাশি দুটো ঘর নিলাম। বিকেলেই আমরা তিনজন
ঘুরে নিলাম ‘ডিয়ার পার্ক’ আর স্থানীয় একটি পার্ক।
ডিয়ার পার্কে চিতল, কস্তুরী
মৃগ, চিতা, ভালুক সব ছাড়িয়ে চোখ
চলে যায় দূরের তুষারশৃঙ্গের দিকে। চন্দনবাড়ি যে পর্বতের নীচে,মানে যেখান থেকে
অমরনাথের পদযাত্রা শুরু সেই পর্বতের শিখরের ছবি তুললাম। এরপর হোটেলের কাছে
পার্কটায় এসে খানিক বসলাম। আমাদের সহযাত্রী নাইনসিটার নেওয়া দলটির দেখা পেয়ে খানিক
গল্পগুজব করতে করতে ঠাণ্ডা বেশ বেড়ে গেল। ফিরে এলাম। অমরনাথ থেকে কাশ্মীর আসার পথে
এটাই এক সময় ছিল পহেলা গাঁও; তাই পহেলগাঁও নাম। সন্ধ্যায় সহযাত্রী কতগুলো বাচ্চার
বায়নায় আমাদের ঘরের টিভি অপসারণের সময় জানলাম ২৭মে কলকাতা নাইট রাইডার্সের সাথে
চেন্নাই সুপার কিংস-এর ফাইনাল। পরে অবশ্য আমরাও সৌরভহীন কেকেআর-এর জয় দেখলাম।
বেতাব
ভ্যালি
বাইরের গাড়ির এখানে অনুমতি নেই। সর্দারজির
বিশ্রাম। স্থানীয় মারুতি ভাড়া নিয়ে পাঁচজনের দল বেরিয়েছি ঠিকই কিন্তু গাড়ি থামলে
মা গাড়িতে আর বাবা একটা দোকানে বসে রইলেন। ছোট্ট মনোরম নদীতট, কাঠের সাঁকো।‘বেতাব’ হিন্দী ছবিটির
শ্যুটিং-এর দৌলতে এই নামকরণ।
চন্দনবাড়ি
চন্দবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার সময় বেঁধে দিল।
গাইড ঘ্যানঘ্যান করে পিছু নিলেও এড়াতে পারলাম। গুঁড়ো বরফের ওপর পায়ে চলা সিঁড়ির
মতো হয়ে গেছে। খানিকটা উঠে আমার মেয়ে কেন আমিও আত্মহারা। এতটুকু শীত নেই। উজ্জ্বল
রোদ। অথচ পায়ের তলায় বরফ। ফট্ফটে সাদা নয় যদিও,তবে বেশ খেলা যায়। উর্বী তো
নামতেই চায় না। আমরা ক্যামেরা তাক করলে কী হয় হিরোইনের শ্যুটিং-এ মন নেই। বরফ দিয়ে
শিল্পকর্মে ব্যস্ত। যে উচ্চতায় উঠেছিলাম সেখান থেকে স্লেজে করে নামলে চমৎকার
জয়-রাইড হোত। কিন্তু আমার মেয়ে সোনমার্গের স্মৃতিতে এতটাই ভীত ছিল যে কিছুতেই
স্লেজে চাপতে রাজি হল না। দারুণ সময় কাটিয়ে নেমে এলাম। এসে নিজেদের গাড়ি খুঁজে
পেতে বেশ বেগ পেতে হল। পহেলগাঁও-তে ঘোড়া, গাইড বা স্লেজ কেউ উৎপাৎ করছে না বলাতে চালক জানাল
ট্যুরিস্টদের বিরক্ত করার নালিশ পুলিস বা মোতায়েন আধাসেনার কাছে গেলে হাতে গরম
শাস্তি। তাই এরা অনেক ভদ্র। বলা বাহুল্য বাবা এখানেও মাকে গাড়িতে সঙ্গ দিলেন।
নাতনি দিদার জন্য যে বরফের গোলা পাকিয়ে এনেছিল, তা তখনও পুরোটা গলেনি।
চন্দবাড়ির মাটিতে পা না ফেলতে পারলেও হাতে কাদাবরফের তাল উঠল। আরো সরকারি Wild
Life Sanctuary আরোতে।
গাড়িতে উপবিষ্ট চারজন পূর্ণবয়স্কের ১০০ টাকার টিকিট কাটতে হলেও নামল যথারীতি দুজন
বড় আর একজন ফাউ। এখানেও নাকি সময় বাঁধা। ফাইন হবে। ঘোড়া করলে হয়ত দেখা যেত
খানিকটা। আমরা পায়ে হেঁটে কিছুদূর উঠে জন্তু জানোয়ারের হদিস না পেয়ে ফিরে এলাম। ভাগ্যিস
এলাম। মায়ের তখন আপৎকালীন ডাক! আরও একটা পার্কে গাড়ি থামাতে চেয়েছিল চালক। আমারা
পড়িমরি করে হোটেল ফিরলাম। আঃ!! সিলেবাস শেষ। সন্ধ্যায় কিচেন স্টাফরা এসে কাদায় পড়া
এই পাঁচজনের কাছ থেকে ছশো টাকা বখশিস নিয়ে গেল। পরে জানলাম তেরোজনের দলও দুশো
ত্রিশ দিয়ে ছাড় পেয়েছে। যাক। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েই রওনা হবার প্রস্তুতি। জওহর
টানেলের যানজটের ভয়ে রাত বারোটায় জম্মুর দিকে যাত্রা। জম্মু পৌঁছে গেলাম সকাল
আটটার মধ্যে। শুভঙ্কর মায়ের জন্য চাইছিল একটা হোটেল ভাড়া নিতে। আমি চাইছিলাম
স্টেশনের রিটায়ারিং রুম। দলের সিং চাইছিল তাড়াতাড়ি জম্মুতে ওর বাড়ি যেতে। ভাড়ার
অতিরিক্ত পাঁচশো টাকা টিপস্ নিয়ে সে আমাদের কুলি আর হুইলচেয়ারের জিম্মা করে বিদায়
নিল। সন্ধ্যেবেলায় আবার তাকে বেরোতে হবে আর এক পার্টিকে স্বর্গ দর্শন করাতে। আর
আমরা রইলাম বাকি উনিশখানা অক্ষত হাত পা নিয়ে ৩১মে ভারত বন্ধ-এর দিন কীভাবে কলকাতা
স্টেশন থেকে যথাক্রমে নার্সিংহোম আর বাড়ি যাব সেই চিন্তা মাথায় সন্ধ্যে সাতটার
জম্মুতাইয়াই এক্সপ্রেসের অপেক্ষায়।
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়: কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
প্রয়োজনীয়
তথ্য
(২০১২-য় ভ্রমণের
পরিপ্রেক্ষিতে)
কখন যাবেন: বরফ
চাইলে ডিসেম্বর থেকে মার্চ। টিউলিপ ফুলের জন্য মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল। মে মাসে
ভিড় বেশি। বর্ষা এড়ানোই ভালো। তবে অমরনাথের পথ খুলতে খুলতে বর্ষা এসে যায়। অমৃতসর
ও কাটরা যে কোনও সময় যাওয়া যায়।
কীভাবে যাবেন:
সূচীতে অমৃতসর থাকলে হাওড়া স্টেশন থেকে অমৃতসর মেইল,
পাঞ্জাব মেইল বা কলকাতা স্টেশন থেকে
অকালতক্ত ধরে অমৃতসর পৌঁছে যান। বাস বা গাড়ি ভাড়া নিয়ে অমৃতসর দেখে নিন। কাটরা
যাওয়ার সরকারি ও বেসরকারি বাস পাওয়া যায়। বৈষ্ণোদেবী দর্শনের জন্য পবন্ংসের
হেলিকপ্টার পেতে এক মাস আগে অনলাইন বুকিং করে রাখতে হবে। পদব্রজে যাওয়ার জন্য
চেষ্টা করুন দর্শনের আগের দিন রাতেই পর্চি সংগ্রহ করে হাঁটা শুরু করতে। ডাণ্ডি ও
ঘোড়াও পেতে পারেন। হেলিকপ্টারে গেলে অবশ্য দিনের দিন রওনা হতে হবে। হেলিপ্যাড থেকে
মন্দির পর্যন্ত দু কিলোমিটার রাস্তা কিন্তু হেঁটে বা ঘোড়াতেই যেতে হবে। পাটনি টপ ও
শ্রীনগর ছোটবাস, টাটাসুমো
বা অন্য গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নিতে পারেন। গুলমার্গে গণ্ডোলার অনলাইন আগাম টিকিট বুক
করতে পারলে ভালো। না হলে দালালের সাহায্য নিতে হবে। কোনও কারণে গুলমার্গ সফর বাতিল
করতে হলে আগাম টিকিটের দাম ফেরৎ পাওয়া যায় কিনা জানিনা। পহেলগাঁওতে স্থানীয়
ভ্রমণের জন্য স্থানীয় স্ট্যান্ডের গাড়িই নিতে হবে। যে গাড়ি ভাড়া করে পহেলগাঁও
গেছেন, তাতেই
ফিরতে পারেন জম্মু বা অমৃতসর স্টেশনে। হাতে অবশ্যই সময় নিয়ে বেরোবেন। জওহর টানেলে
যানজটের আশঙ্কা থাকে।
কোথায় থাকবেন:
অমৃতসর স্টেশন ও বাস-স্ট্যান্ডের কাছে অনেক হোটেল। গোপালজীতে থাকলে দৈনিক
১০০০টাকার মধ্যে হয়ে যাবে। কাটরায় হরি রিসর্ট চমৎকার হোটেল (১৮০০ টাকা থেকে শুরু)।
শ্রীনগরে অসংখ্য হোটেল। গৌসিয়া ও ইরাম হোটেলের ভাড়া ৭০০টাকা+ হলেও মরশুমে যা খুশি
হতে পারে। ভালো দৃশ্য চাইলে বাগিচাগুলোর আশেপাশে খোঁজ করুন। পহেলগাঁওতে হোটেল
অমরনাথ( ২০০০টাকা) ভালো।
গাড়ি ভাড়া: কাটরা
বা অমৃতসর থেকে নিজস্ব টাটাসুমো বা শেভরোলে ট্যাভেরা নিলে দৈনিক ২৯০০টাকা। গাড়ি
আপনার ইচ্ছামতো ঘুরবে। ট্রাভেল এজেন্টের সাথে না গেলে স্বাধীনতা বেশি।
সঙ্গে রাখবেন:
গরমে গেলেও শীত বস্ত্র রাখা জরুরি। রোদ উঠলে বরফের ওপরেও আরামদায়ক। বৃষ্টি পড়লে
গরমজামা অত্যাবশ্যক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন