কবি নজরুল –একটি ফেনোমেনন



প্রবন্ধ


মহাজাগতিক কোন বিশেষ ঘটনা যখন ঘটে, তার বহু আগে থেকেই তার কার্যকারণ গুলো পরপর সংঘটিত হতে থাকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, হোমের অগ্নিহোত্রী মন্ত্রের আগে যেমন আচমন করা হয়, তেমনই আর কি। এই সব কার্যকারণ  একসূত্রে গাঁথা হয়ে হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করে কোন মহাজাগতিক বিস্ময় একে যদি ঈশ্বর বলেন তো ঈশ্বর, যদি   প্রকৃতির খেয়াল বলেন তাহলে প্রকৃতির খেয়াল আর যদি বলেন কাকতালীয় ঘটনা, তবে তাই পড়ে দেখুন তো আমার বলা  কথাগুলো আমি কতদূর প্রমাণ করতে পারলাম আসানশোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকের চুরুলিয়া গ্রামের কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয়া স্ত্রী জাহেদা বিবির পর পর চারটি সন্তান বাঁচল না এরপর যে ছেলেটি জন্মাল তার বেঁচে থাকা টুকুই তখন বাবা মায়ের পরম প্রাপ্তি আর সেই আশা-নিরাশায় আশঙ্কিত মন শিশুর নামকরণ করল দুখু মিঞাকেউ কি তখন জানত, দুখু মিঞার  জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে রাখা আছে কত অজস্র দুঃখের ঘুর্নিএমন কথা  ভেবে  কেই বা করে, শিশুর  নামকরণ? কিন্তু কি আশ্চর্য সমাপতন কার্যকারণের! ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ শে মে জন্ম নেওয়া এই দুখুই যে আমাদের প্রিয় বিদ্রোহী কবি, প্রিয় প্রেমিক কবি, প্রিয় আত্মভোলা কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সে কি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে?
   
শিশু দুখু মিঞার শিক্ষা শুরু হল স্থানীয় মসজিদে, যেখানে তার বাবা ছিলেন  মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। এখানকার মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। এরপর দেখুন কেমন তৈরি হচ্ছে ঘটনার সাজসজ্জা ... কিভাবে এক নক্ষত্র জন্মানোর প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে ১৯০৮ সাল, মাত্র নয় বছরের ছেলে দুখু ... তার পিতৃ বিয়োগ ঘটে গেল অভাব আর দারিদ্র্যের ক্ষমাহীণ নিষ্পেষণে দুখুকে শিক্ষায় মুলতুবী দিয়ে কাজে নামতে হল আয়ের তাগিদে এবার সে মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঐ মক্তবেই শিক্ষক ...  একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আযান দাতা) ইসলামীয় রীতি নীতি, আচার আচরণের হাতে কলমে পাঠ নেওয়া হয়ে গেল কিন্তু এখানেই তো থেমে যেতে পারে না কোন তারকার প্রস্তুতি পর্ব এগিয়ে চলে নিয়তির অমোঘ বিধানে এবার দুখু ঘর ছাড়ল,রাঢ় বাংলার অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান-বীরভূম এলাকার কবিতা-গান আর নাচের মিশ্র আঙ্গিকে নির্মিত লোকনাট্যের দল বা   লেটোর গানের দলের সঙ্গে এই খানেই যে তার হাতেখড়ি  হবার ছিল সাহিত্যের সঙ্গে এখানে এসেই পরিচয় হল সংস্কৃত আর বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পুরান জানল, হিন্দু ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে পরিচয় হল বালক নজরুলের সৃষ্টিতে ধরা পড়ল শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, মেঘনাদ বধ ইত্যাদি   এ সবই কিন্তু চক্রান্ত! কার বলুন তো? কালের ... নিয়তির ... বিধাতার। তার কলম দিয়ে যে লেখাতে হবে ... কোরান পুরান বেদ বেদান্ত বাইবেল ত্রিপিটক / জেন্দাবেস্তা গ্রন্থসাহিব পড়ে যাও যত শখকিন্তু কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল / দোকানে কেন এ দর কষাকষি, পথে ফুটে তাজা ফুল

লেটোর গানের দলে বেশিদিন থাকে নি দুখু মিঞা থাকলে চলবে কেন? সাহিত্যের রাজদরবারে তার যে এখন অনেক কিছু দেবার বাকি আছে ফিরে এল সে আবার কিছু কার্যকারণ যোগে ভর্তি হল রাণীগঞ্জের শিয়ারসোল স্কুলে ১৯১০ সালে ওই টুকু বয়েসেই কিন্তু তার জনপ্রিয়তা দীপ্তি প্রদর্শন করতে শুরু করেছে নাহলে লেটোগানের সঙ্গীসাথীরা তাকে নিয়ে গান বাঁধে, “আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ",? ওখান থেকে পরবর্তীতে ভর্তি হলেন  মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে  যা পরবর্তীতে  নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিত এখানে প্রধান শিক্ষক, কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক কি বলবেন একে, কালের গভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া? আরো এক ষড়যন্ত্রের খবর দিচ্ছি আপনাদের, মিলিয়ে দেখুন একবার শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে দুখুর সঙ্গে দেখা হয় শিক্ষক তথা যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটকের যাঁর দেশপ্রেমমন্ত্র বীজ বপন করে দিয়েছে বিদ্রোহী যিনি গ্রেপ্তার হতে তাঁর প্রিয় শিষ্য, দশম  শ্রেণির ছাত্র  কাজী নজরুল ইসলামের মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়, সন্দেহের তালিকায় চলে আসে তার নাম, যদিও পরে প্রমাণের অভাবে আবার দেওয়া হয় বৃত্তির টাকা কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট” ... এই কথাগুলো জন্মানোর প্রস্তুতি যজ্ঞের আচমন তখনই শুরু হয়েছে যে 
   
এরপর ১৯১৭ তে আমরা দেখি সৈনিক নজরুল কে, করাচীর সেনানিবাসে সেখানে প্রানোচ্ছ্বল গায়ক কবি পরিচিত ছিলেন, “হৈ হৈ নজরুলনামে ওখানেই ফার্সী ভাষা শেখেন চল্‌ চল্‌ চল্‌,/ ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল / নিম্নে উতলা ধরণীতল / অরুণ প্রাতের তরুণ দল  চল রে চল রে চলড্রামের তালে তালে বেজে যাওয়া রক্তবাহিকায় তীব্র তুফান তোলা এই লাইন গুলো সৃষ্টির জন্যে এ কি কালের ষড়যন্ত্র নয়? কি বলেন আপনারা? কাজী নজরুল ইসলাম ফিরে এলেন  করাচী থেকে কলকাতায়। সেটা ১৯২০ সাল।  ভার্সাই চুক্তির ফলে সৈনিক জীবনে ইতি টেনে। কলকাতার মেসে উঠলেন, কিন্তু দিন দুইয়ের বেশি থাকতে পারলেন না। তিনি মুসলিম, তাঁর এঁটো বাসন ধূতে নারাজ মেসের হিন্দু কর্মচারী। মেস থেকে বেরিয়ে এসে ফিরে গেলেন চুরুলিয়া। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে মানতে পারলেন না। চুরুলিয়ার সঙ্গে ছিন্ন হল কবির সম্পর্ক, যে সম্পর্ক মায়ের মৃত্যুতেও জোড়া লাগে নি
   
ফিরে এলেন কলকাতায়। এখানে ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁর সাহিত্য জীবন নক্ষত্রের সভায় পৌঁছানোর আয়োজন সম্পূর্ণ হল।   এই সাহিত্য সমিতির অফিসে নজরুলের সঙ্গে পরিচয় হয়  কাজী মোতাহার   মোজাম্মেল হক, কাজী আব্দুল ওদুদ, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, আফজালুল হক প্রমুখের সঙ্গে  এই সময়  কলকাতার দুটি বিখ্যাত আড্ডায়   অতুল প্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী,শিশির ভাদুড়ি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ রায়,দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন সাহিত্যের অঙ্গনে কবির আসন কাঙ্ক্ষিত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আয়োজন পূর্ণতা পেল  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পরে নজরুল কলকাতায় আসেন ভারতের আকাশে সেই সময় প্রবল অশান্ত ঘূর্ণিঝড় পরপর ঘটে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় কালি মাখানো ঘটনা গুলো এই সময়ের কিছু আগে পরে  ঘটতে থাকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার, রোওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ  হত্যাকান্ড( ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯), ... এই সব কিছু, যে সময় ইতিহাসের গতির অভিমুখ পরিবর্তনের ইঙ্গীত সূচিত করছে,ঠিক সেই সময়ে কবি নজরুল তাঁর সৃষ্টিশীলতার মধ্যগগনে বিরাজ করছেন
      
ঠিক এই সময়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সময়টা ১৯২০ থেকে  ১৯২২ সাল। সম্পূর্ণতা পায় কালের পরিকল্পনা। কবির কলম একের পর এক গর্জন নিয়ে উপস্থিত হয় কালের দরবারে কলম গর্জায়,

           “পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি  যুগের হুজুগ কেটে গেলে
             মাথার ওপর জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে
           প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
           যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ

অসহযোগ আন্দোলনে ইংরেজের প্রবল দমন নীতি সে সময় যেমন কিছু মানুষের মধ্যে আগুন জ্বেলেছিল তেমন সীমাহীন  আতঙ্ক মানুষের মনকে বিবশ করেছিল একথা বলাই বাহুল্য এও তো কালের নির্দেশ আপামর বাঙ্গালীর মনে প্রবল দেশপ্রেমের জোয়ার এনে দেওয়া রচনা বেরিয়ে এল কবির কলমে,

কারার  ওই লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল পুজার পাষাণ বেদী
ওরে ও তরুণ ঈশাণ
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ,
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীন প্রাচীর ভেদি

উদাত্ত এ গান আপামর বাঙালী প্রাণে সেদিন যে জোয়ার এনেছিল, বাঙালী বলতে পেরেছিল ইংরেজ বেয়নেটের সামনে দাঁড়িয়ে  বুক চিতিয়ে,

       “লাথি মার ভাঙ রে তালা
           যত সব বন্দিশালায়
            আগুন জ্বালা
       আগুন জ্বালাফেল উপাড়ি”...

কালের প্রবল প্ররোচনা ছাড়া এ কি সম্ভব? তবে এখানেই শেষ নয় কালের ঘুঁটি সাজানোর খেলা। অসহযোগ আন্দোলনের প্রচুর রক্তের অঞ্জলী প্রদান সত্ত্বেও আন্দোলন সাফল্য লাভ করে না। চৌরিচৌরার ঘটনার প্রতিবাদে গান্ধিজী আন্দোলন প্রত্যাহার করেন সেই  সময় ভেঙ্গে পড়া,হতাশাগ্রস্ত বিপ্লবী মন উজ্জিবীত করার জন্যেই কি মহাকাল কবির কলমে দিয়েছিল সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘বিদ্রোহী’? অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন ১৯২১ সালে সাপ্তাহিক বিজলিতে প্রকাশিত এই কবিতা ১৯২২ পরবর্তী সময়ে বীর বাঙালি মনে জ্বালিয়েছিল আত্মবিশ্বাসের অগ্নিশিখা, দেশপ্রেমের আলোকবর্তিকা। বাঙালী গর্জে উঠেছিল,

                   বল বীর
               বলো উন্নত মম শির।
              শির নেহারী আমারি নত শির 
                  ওই শিখর হিমাদ্রীর

এই পর্যন্ত যদি থাকত তাহলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম সাহিত্যের পাতায় জ্বলজ্বল করত ঠিকই,কিন্তু প্রেমিক নজরুলকে আমরা পেতাম না কালচক্রের নিশ্চিত ঘূর্নণে সে সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আলি আকবর খান, মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক , জহুরীর চোখে দেখে নিয়েছিলেন নজরুল কে আপাদ মস্তক ব্যবসায়ী আলি আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা যান কবি সেখানে পরিচিত হন আলি আকবরের বোনের মেয়ে সুন্দরী সৈয়দা খানমের প্রেমে পড়েন কবি, প্রেমে পড়েন সৈয়দা কবি তাঁর প্রিয়ার নামকরণ করেন নার্গিসবিয়ে স্থির হয় ১৭ই জুন ১৯২১, শুক্রবার সেদিন গভীর রাতে নজরুল আর নার্গিসের বিয়ের আকদ হয়ে যায় দৌলতপুরের কনের বাড়িতে কিন্তু বিষয়ী আলি আকবর কাবিননামায় শর্ত রাখেন কবিকে ঘরজামাই হয়ে দৌলতপুরেই থাকতে হবে অসম্ভব আহত হন কবি। সেই মুহূর্তে তিনি বাসর অসম্পূর্ণ রেখে নববধূকে ফেলে রেখে পায়ে হেঁটে কুমিল্লা ফিরে আসেন কুমিল্লায় এসে তিনি বিরজাদেবীর বাড়িতে এসে ওঠেন কলকাতা থেকে কুমিল্লায় যাবার পর এই বিরজাদেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন আলি আকবরই  
  
প্রেম এবং আঘাত এবং তুমুল বিরহ প্রেমের কাব্য রচনার আদর্শ পরিস্থিতি কবির সাধ্য কি তিনি কালের এই অমোঘ ফাঁদ এড়িয়ে যান দীর্ঘ ১৬ বছর পর নার্গিস কবিকে চিঠি লেখেন তার উত্তরে কবি স্বীকার করে নেন, কালের এই সুনিশ্চিত অভিসন্ধীর কথা ... তুমি এই আগুণের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না আমি ধূমকেতুরবিষ্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।  এর পর তাঁর সৃষ্টি কালজয়ি সেই গান – ‘ যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে/ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/আমি গান গাহি আপনার দুখে,/তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,/আলেয়ার মত ডাকিও না আর/নিশীথ অন্ধকারে….

একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম, আবার ফিরে যাই বিবাহবাসর ফেরৎ কবির কাছে কি হল তারপর? কবি ফিরে এলেন কুমিল্লায় সারা রাত পায়ে হেঁটে ক্লান্ত, বিধ্বস্তআহত এসে উঠলেন আলি আকবরের বাল্যবন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে এই বাড়িতে তাঁকে পরিচয় করিয়েছিলেন আলি আকবরই বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের মা বিরজাসুন্দরী দেবিকে কবি মাডাকেন কবির হৃদয়ের কোন শূণ্যস্থানে সম্ভবতঃ এই মা ডাকের অভাবটুকু লুকিয়ে রাখা ছিল বিরজাসুন্দরীর স্নেহস্পর্শে যেখানে প্রলেপ পড়ে   এখানে এসে কবি অসুস্থ্ হয়ে পড়েন এই সময় অসুস্থ্ কবির দেখাশোনার দায়িত্ব নেন বীরেন্দ্রকুমারের জ্যেঠতুতো বোন আশালতা, যাঁর ডাকনাম দুলি বা দোলন কালের নিয়মে আশালতা ওরফে দোলনের ওপরেই ন্যস্ত হয় কবির আজীবন দেখাশোনার ভার কবি তাঁর নতুন নামকরণ করেন প্রমীলা।   
  
প্রমীলাকে চিঠি পাঠান কবি ঐ দৌলতপুরের ঘটনার বছর তিনেক পর, বিয়ের আগে ...হে মোর রানী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।/ আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।/ আমার সমর-জয়ী অমর তরবারী/ দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, য়ে উঠে ভারী,/ এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি/ এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে॥/ ওগো জীবন- দেবি!/ আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,/ আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!/ আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চূড়ে,/ বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,/ যত তুণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,/ আমি বিজয়ী আজ নয়ন জলে ভেসে।
  
তাহলে কালের ষড়যন্ত্র নিশ্চিত গতিতে এগিয়ে চলল? না হলে পেতাম আমরা, ‘দোলন চাঁপাকাব্যগ্রন্থ? ১৯২৪ সালে নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় প্রমীলা সেনগুপ্তের আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এই ইন্টার রিলিজিয়ন ম্যারেজ সম্পন্ন হল এবং সেটাও কোন ধর্মান্তরকরণ ছাড়াই! আহলুল কিতাব মতে বিয়ে সম্পন্ন হয় আর এই বিয়েতে সেই সময়ে গোপনীয়তা যে রাখতেই হবে সে কথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? কনে পক্ষেও কনের মা ছাড়া কেউ উপস্থিত থাকবেন না সেটাও স্বাভাবিকই কবিকে কুমিল্লা ছাড়তে হয় আর আমরা পেয়ে যাই অজস্র কবিতা ... প্রেমের কবিতা

এই দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বির প্রেম যে সারাজীবনের স্থায়িত্ব পেয়েছিল সেকথা আমরা সবাই জানি তবুও এর পরেও আরও এক নারী কবি হৃদয়কে উদ্বেল করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী এবং সওগাত পত্রিকার একজন বিশিষ্ট  লেখিকা মিস ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগকে কিংবদন্তী তুল্য বলা যেতে পারে। কবি ফজিলাতুন্নেসাকে সাতটি চিঠি পাঠান এবং প্রত্যাখ্যাত হন কোন এক অনুষ্ঠানে কবি, ফজিলাতুন্নেসার উদ্দেশ্যে রচনা করেন ...

জাগিলে পারুল কিগো সাত ভাই চম্পাডাকে,/উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।/চলিলে সাগর ঘুরে/অলকার মায়ার পুরে,/ফোটে ফুল নিত্য যেথায়/জীবনের ফুল্ল-শাখে।।/আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,/জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা।/থেকো না স্বর্গে ভুলে,/এ পারের মর্ত্য কূলে,/ভিড়ায়ো সোনার তরী/আবার এই নদীর বাঁকে।।

পরে ফজিলাতুন্নেসা বিলেতে গিয়ে বিয়ে করেন তাঁর পছন্দের মানুষকে এই সংবাদ কবিকে ব্যথিত করে, তাঁর কলম কেঁদে ওঠে, - ‘বাদল বায়ে মোর/নিভিয়া গেছে বাতি।/তোমার ঘরে আজ/উৎসবের রাতি।।/তোমার আছে হাসি,/আমার আঁখি-জল/তোমার আছে চাঁদ,/আমার মেঘ-দল,/তোমার আছে ঘর,/ঝড় আমার সাথী।।/শুন্য করিমোর/মনের বন ভূমি/সেজেছ সেই ফুলে/রানীর সাজে তুমি।/নব বাসর ঘরে/যাও সে সাজ পরে,/ঘুমাতে দাও মোরে/কাঁটার শেজ্ পাতি।

কবি নজরুল ইসলাম একটি ফেনোমেনন, যা সৃষ্টি হয়েছে কালের ইচ্ছায়, কালের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় সে কথা তিনি নিজেও জানতেন সেই কথাই তিনি বলেছেন তাঁর জবানবন্দীতে। ১৯২১ সালে প্রকাশ্য সভায় পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলায় তিনি মামলায় জড়িয়ে পড়েন যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এক বছরের কারাদন্ড হয় মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি একটি জবানবন্দী দেন।  রাজবন্দীর জবান বন্দী নামে সুপরিচিত তাঁর কথাগুলি এই জবানবন্দীতে কবি বলেছিলেন:


আমার ওপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্যঅমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য  ভগবান  কর্তৃক প্রেরিত কবির   কন্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার  বাণী সত্যের প্রকশিকা ভগবানের বাণী সে বাণী বিচারে রাজদ্রোহী  হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়  সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে


কৌশিকা চক্রবর্তী মুখার্জী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন