পুরুষোত্তম শ্রীচৈতন্য ও গৌড়বঙ্গ



প্রবন্ধ


এক

চৈতন্যসিংহের নবদ্বীপে অবতার।
সিংহ গ্রীব সিংহবীর্য সিংহের হুঙ্কার।।
..................

দৈর্ঘ্য বিস্তারে যেই আপনার হাতে।
চারি হস্ত হয় মহাপুরুষ বিখ্যাতে।।
........

আজানুলম্বিত ভুজ কোমললোচন।
তিনফুল জিনি নাসা সুধাংশুবদন।।

(চৈতন্য চরিতামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)

মধ্যযুগে চৈতন্য আবির্ভাব - বাংলার আকাশে ধর্মীয় নবজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদেশী শাসকের অহেতুক অত্যাচারের হাত থেকে সনাতন ধর্ম তথা বাংলার সুবিদিত সভ্যতাকে সুপরিকল্পিত ভাবে রক্ষা করার এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ। চৈতন্য পরবর্তী যুগে সুচিন্তিত চৈতন্য গবেষণার কোনো অভাব কোনোকালেই দেখা যায় নি। সমসাময়িক বৃন্দাবন দাস ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যে ডঃ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী - বিভিন্ন কালে আমরা বহু চৈতন্য জীবনী ও গবেষণা গ্রন্থের মাধ্যমে চিনতে পেরেছি সেই সিংহপুরুষকে। কিন্তু সকল গবেষণাকে আমরা যদি দুভাগে ভাগ করে নিই, তাহলে দেখবো একটি বিভাগে ধর্মের বন্ধনে চৈতন্য জীবনীতে অবতারতত্ব অর্পণ করে প্রাচীন গ্রন্থকাররা সেই সুবিশাল ব্যাক্তিত্বের সামগ্রিক পরিচয় ধরতে পারেন নি। কোনো একটি বই থেকে আমরা তাঁর সমগ্র জীবনচরিত সংগ্রহ করতে পারি না। ১৮৮৬ ক্রীষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী যে মহাপুরুষের জন্ম নদীয়া জেলার জনপদ নবদ্বীপে, সময়ের সাথে তাঁর বেড়ে ওঠা ও সমগ্র ভারতে ধর্মীয় সচেতনতার মাধ্যমে জনমানসে এক বলিষ্ঠ অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠার কাহিনী আজ আমরা সঠিক ভাবে কতটা জেনে উঠতে পেরেছি, তা অবশ্যই প্রশ্নচিহ্নের মুখে।

প্রকৃত অর্থেই সেই সময় ছিল ভারতের স্বর্ণযুগ। বাংলায় চৈতন্য, উত্তরে রামানন্দ, পশ্চিমে নানক, তুকারাম, মীরাবাঈ দক্ষিণে রামানুজ, ব্যাসরায়-দের সুযোগ্য নেতৃত্বে স্বকীয়তার সাথে এগিয়ে চলেছে ধর্মীয় গণঅভ্যুত্থান। আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগেও বাংলার মাটিতে এক আসনে খেতে বসছেন ব্রাহ্মণ ও তথাকথিত চণ্ডাল - এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য। সপার্ষদ চৈতন্যদেবের সিংহহৃদয়েই হয়তো ছিল এমন নিহিত শক্তি - যা খুব অনায়াসেই তাঁকে দেবত্ব আরোপ করেছিল। বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মানুষের আরাধ্য হয়ে ওঠেন খুব সহজে। কিন্তু মহাভারতে এক দক্ষ রাজনীতিজ্ঞ কৃষ্ণকে না জানলে যেমন প্রকৃত কৃষ্ণচরিত্র অধরা থেকে যায়, ঠিক তেমনি চৈতন্যচরিত্রের বহুমুখী দিকগুলো এবং তাঁর নেতৃত্বদানের কৌশলী দক্ষতা অজানা থাকলে তাঁকে অর্ধেক জানা হয়। এই মহামানব সম্বন্ধে বিবেকানন্দ বলছেন - "একবার মাত্র এক মহতী প্রতিভা জাল ছেদন করিয়া উত্থিত হইয়াছিলেন - ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। একবার মাত্র বঙ্গের আধ্যাত্বিক তন্দ্রা ভাঙিয়েছিলো।" তাঁর মহান ব্যাক্তিত্ব ও ক্ষুরধার দর্শনের কাছে ক্ষুদ্র ছিল শাসকের ইচ্ছে, সমাজপতিদের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মের বেড়াজাল। এমনকি সেযুগের কাহিনীকারদের কলমে আমরা প্রমান পেয়েছি যে  'গৌড়' 'গৌর' প্রায় সমার্থক ছিল। তাঁর চরিত্রের সাথে সাথে আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণের মহান উদ্দেশ্য ও সামনে থেকে নেতৃত্বদানের বিষয়গুলি দেখবো।

পূর্ব ভারতের একমাত্র স্বাধীন বৈষ্ণব সম্রাট উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপরুদ্রদেবের(১৪৯৭-১৫৪০) প্রতি তাঁর বিশেষ প্রভাববিস্তার ও দক্ষিণে সুবেদারদের মধ্যে বৈষ্ণব আচার বিতরণ তাঁর সুচিন্তিত নেতৃত্ত্বেরই দাবি রাখে। দক্ষিণ ভারতে আর এক বৈষ্ণব রাজা বিজয়নগরের কৃষ্ণদেব রায়(১৫০৯১৫২৯) ছিলেন মহামতি ব্যাসরায় এর শিষ্য আর গজপতি মহারাজা ছিলেন আমাদের প্রানপ্রিয় চৈতন্যদেবের। এমনকি উড়িষ্যায় গজপতি বংশে বর্তমান কয়েক পুরুষ বাদ দিলে পূর্বের সকল রাজাই ছিলেন গৌড়ীয় চৈতন্য মতে দীক্ষিত।

সেযুগে গৌড়ের কথায় যদি আসতে হয়, তাহলে প্রথমেই দেখতে হয় রাজন্যবর্গের সামাজিক পরিকাঠামো ও তার শাসনপ্রণালীর শৃঙ্খলাগুলি। বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা ছিলেন মহারাজ সুবুদ্ধি খাঁ। গৌড় শাসনে তার প্রধান ভিত্তি ছিল সুশাসন ও প্রজার সন্তোষ। কিন্তু তারই বিশ্বস্ত মুসলিম কর্মচারী হোসেন খানের ষড়যন্ত্রে তিনি অন্যায়ভাবে সিংহাসনচ্যুত হন। হোসেন খান 'শাহ' উপাধি যোগে লাভ করেন বাংলার সুবেদারী। রাজ্যশাসনের সুবিধার জন্য বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত করেন মুসলিম কাজী। প্রামাণ্য গ্রন্থ অনুযায়ী জানা যায় তৎকালীন নবদ্বীপের তেমনই কাজী ছিলেন চাঁদ খাঁ। স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও রাজাদের আনুকূল্যে তাঁরা সন্তুষ্ট রাখতেন বাংলার সুলতানকে। কর বাবদ যা আয়-উপায় হতো তার কিছু অংশ নিজে রেখে বাকিটা পাঠাতেন সুলতানের নজরানায়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কাজীর শাসনকার্যে বিঘ্ন ঘটায় সাধ্য কার। এমন শাসনপদ্ধতির বেড়াজালে সেকালের হিন্দু বৈষ্ণবগণের যে ধর্মে-কর্মে খানিক বাধা উপস্থিত হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন সমাজ কাঠামোয় আমরা পরবর্তীকালে দেখবো সেই উন্নত কাঁধ আর শক্ত চোয়ালের অধিকারী চৈতন্যদেবের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তিনি শুধু বলিয়ানের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজের অন্তজ শ্রেণীর ভগবান। নামের মাহাত্ম আর কর্তালের সুর অস্ত্র করে তাঁর নৃত্যকলা ও সিংহদৃষ্টি যেন আষ্টেপিষ্টে ধরেছিলো সমাজের শ্রেণীবৈষম্যকে। গঙ্গাতীরের ছোট্ট 'নিমাই' (একমাত্র শচীদেবী এই নামে ডাকতেন প্রভুকে) কখন যে হয়ে ওঠেন আপামর ভারতবর্ষের নয়নের ধন, নররূপী নারায়ণ - তা বোধহয় তৎকালীন সময়ও লিখে রাখতে পারে নি।

বিস্তৃত বঙ্গভূমির বাইরে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তখন চঞ্চল। ভারতবর্ষের প্রতাপশালী হিন্দু রাজা উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপরুদ্র ছিলেন যুদ্ধে ব্যাতিব্যাস্ত। তাঁর প্রধান শত্রু বলতে বাংলার হোসেন শাহ আর দক্ষিণে কর্ণাটের (তৎকালীন বিজয়নগর) হিন্দু রাজা কৃষ্ণদেব রায়। পরবর্তী কালে আত্মীয়তার বন্ধনে সন্ধি হলেও দুই হিন্দু রাজা বহুকাল ছিলেন শত্রুতায় মেতে। কথিত আছে গজপতি রাজা যুদ্ধ জয় করে দক্ষিণে কাঞ্চি শহরের দেবতা শ্রীগণেশকে নিয়ে আসেন নীলাচলে। তারপর তাঁর রাজ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কাঞ্চিগনেশ মূর্তি। আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে আমরা স্বমহিমায় তাঁর উপস্থিতি দেখতে পাই। আবার ওপর দিকে দেখা যায় মহারাজা কৃষ্ণদেব রায় উড়িষ্যার উদয়গিরি দুর্গের কৃষ্ণ মূর্তি হরণ করে বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহু জমি দেবোত্তর করে দেন। সঙ্গে নির্মাণ করেন সুবিশাল শ্রীকৃষ্ণ মন্দির। এমনি ছিল দুই শক্তিশালী বৈষ্ণব রাজার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের চরিত্র।

তারপরও ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দু রাজ্য ছিল উড়িষ্যা। বহুকালে বহু বিদেশীশক্তির আক্রমণ থেকে এই রাজ্য কখনো  রক্ষা পায় নি। কিন্তু গজপতি রাজন্যবর্গের প্রতাপে শত্রু প্রতিহত হয়ে উড়িষ্যা বারে বারে পেয়েছে সতন্ত্রতার সম্মান। আজও গজপতি রাজা দিব্যসিংহদেব বাহাদুরকে আমরা প্রতি রথযাত্রায় ভক্তি সহযোগে রথ মার্জনা করতে দেখি।

তখন রাজ্যশাসকদের সামাজিক বৈষম্যরক্ষায় সদিচ্ছার অভাবের সুযোগ নিয়ে বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠছিল তথাকথিত ধর্মীয় অন্ধত্বের দিকগুলি। চৈতন্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়গুলিতে আমরা দেখতে পাই হিন্দু ও মুসলিম ধর্মগুরুদের গোঁড়ামির উদাহরণ। কখনো শুধুমাত্র হরিনাম করার মাসুল দিতে ভক্ত হরিদাসকে বাইশ বাজার ঘুরে সহ্য করতে হয় নির্মম বেত্রাঘাত, অথবা বৈষ্ণব ধর্মাচরণের পথে বারে বারে নেমে আসে জানা অজানা বিভিন্ন অন্তরায়। এমন প্রতিকূল সমাজে অন্তরের দৃষ্টিকোণ খুব স্পষ্ট রেখে বৈষ্ণব আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়া যে যুগপুরুষের পক্ষে বেদমন্ত্র হয়ে উঠেছিল, তিনিই তো 'চৈতন্য'

দুই

এই পর্বে কয়েকটি চৈতন্য জীবনীগ্রন্থ এবং তার পদকর্তাদের কথা আলোচনা করব। চৈতন্যদেবের জীবনীপর্যায়গুলো যে সকল গ্রন্থে রূপ পেয়েছে, তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হিসাবে ধরা হয় শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' কে। এই গ্রন্থের গ্রন্থকার শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী। চৈতন্য গবেষকদের মতে এই গ্রন্থ চৈতন্যজীবনের সর্বাধিক প্রামাণ্য দলিল। ১৪৯৬ ক্রিস্টাব্দে এক বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম হয় গোস্বামীর। জীবনের শেষ পর্বে পৌঁছে এক ব্রজবাসীর ইচ্ছানুসারে তিনি সৃষ্টি করেন 'চৈতন্যচরিতামৃত'। তাঁর কাব্যসৃষ্টিতে মূল প্রেরণা ছিল গুরু রঘুনাথ দাসের চৈতন্য সঙ্গলাভ এবং পূর্ব গ্রন্থকার মুরারি গুপ্ত রচিত 'কড়চা'। চৈতন্য জীবনীকাব্যগুলির মধ্যে  অন্যতম এই 'মুরারি গুপ্তের কড়চা'। সব গ্রন্থের মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম রচিত চৈতন্যপদ। অন্য একটি প্রধান জীবনীগ্রন্থ বৃন্দাবন দাস রচিত 'শ্রীচৈতন্যভাগবত'। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতানুযায়ী তিনি চৈতন্য লীলার ব্যাস। ভক্তিবাদ ও কাব্যমাধুর্যে এই গ্রন্থ যে শ্রেষ্ঠ, তা এককথায় অনস্বীকার্য। অন্যতম চৈতন্য পর্ষদ শ্রীবাস পন্ডিতের ভাইঝি নারায়ণী দেবীর গর্ভে ১৫০৭ ক্রিস্টাব্দে অবতীর্ণ হন বৃন্দাবন দাস। ১৫৩৫ ক্রিস্টাব্দে তিনি রচনা করেন চৈতন্যভাগবত। পূর্বে নাম চৈতন্যমঙ্গল থাকলেও পরে লোচনদাসের চৈতন্য জীবনী গ্রন্থের একই নাম থাকার সুবাদে বৃন্দাবন দাসের কাব্যকে চৈতন্যভাগবত নামে চিহ্নিত করা হয়। চৈতন্যচরিত্রে ভগবৎ দর্শন আরোপ করে তিনি চৈতন্যদেবের মহিমাকে গৌরবান্বিত করেন, একথা সকল বৈষ্ণব সমাজ মানে। অন্য একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হলো লোচনদাস রচিত 'চৈতন্যমঙ্গল'। উৎকৃষ্ট এই গ্রন্থ মোট চারটি পর্যায়ে বিভক্ত- সূত্রখণ্ড, আদিখণ্ড, মধ্যখণ্ড, শেষখণ্ড। চারখণ্ডে রচিত এই গ্রন্থের পদগুলি বৈষ্ণব কীর্তনেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে আসে। বর্তমানে গবেষণার ক্ষেত্রে এইসকল জীবনীগ্রন্থই একমাত্র   মাধ্যম এবং চৈতন্যসূত্র।

চৈতন্য পূর্ব যুগে রচিত বিভিন্ন বৈষ্ণবপদকর্তাদের মধ্যে মৈথিলী ভাষার প্রয়োগ বেশ লক্ষণীয়। বড়ু চন্ডিদাস বা বিদ্যাপতির প্রতিটি পদে আমরা এই রীতি লক্ষ্য করি। মূলত রাধা-কৃষ্ণের পার্থিব প্রেমভাব ও অষ্টসখীর কৃষ্ণ মাথুরের বর্ণনার দিব্যভাবে আলোকিত এইসকল গ্রন্থ। কবি জয়দেবও তাঁর 'গীতগোবিন্দম'এ উদার কাব্যমাধুর্যে গোপিনীদের কৃষ্ণ বিরহের কথা লিখেছেন, যেখানে আমরা প্রথম সরল কথ্য সংস্কৃত ভাষার প্রয়োগ দেখতে পাই। কিন্তু আদ্যোপান্ত বাংলা শব্দের প্রয়োগে নিপূণভাবে বৈষ্ণব কাব্যরস বিতরণের ধারা তৈরী হয় চৈতন্য পরবর্তী কাব্যে। চৈতন্যদেব বাংলার এক প্রকৃত যুগভেদ, সময়ের মানদণ্ড। তাঁর জন্মের পর যে সকল চৈতন্যপদ ও রাধাকৃষ্ণ জুগলকীর্তন রচনা হয়, সেগুলিতে আধুনিক বাংলা ভাষার দক্ষ লিপিকরণ বেশ লক্ষণীয়। আজও বাংলা ভাষা ও বাঙালির কাছে এগুলি পরম সম্পদ। সমস্ত আলোচনা থেকে আমরা বেশ বুঝতে পারি যে গৌর আবির্ভাব বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, কাব্যিক ও লৌকিক মানচিত্রে এক উজ্জ্বল ক্ষণ।

বিশেষ করে বাংলা ও উৎকলের মাটিতে তাঁকে আঁকড়ে যে ভাবাবেগ জন্মেছিলো, তা আজ প্রায় ৬০০ বছর পরেও অটুট। তাঁর মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে দুটি বেশ সুস্পষ্ট অধ্যায় লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ২৪ বছর জন্মস্থান নবদ্বীপে বাল্য বয়স থেকে কৈশোরে প্রবেশ এবং তারপর বাকি ২৪ বছর সন্ন্যাস গ্রহণের পরে তৎকালীন নীলাচলে(বর্তমানে পুরী বা শ্রীক্ষেত্র) অবস্থান। এই শেষ ২৪ বছরের মধ্যে দীর্ঘ ৬ বছর কাটিয়েছেন দাক্ষিণাত্যের স্থানে স্থানে। সুবিশাল ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, তাঁর চরণধূলি পড়েনি, এমন যেন কোন স্থানই নেই। শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে অনাড়ম্বর, একলা যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী শুধু দুই ঠোঁটের মাঝে কৃষ্ণনাম এবং মনেপ্রাণে এক তীব্র আকুতি নাম মাহাত্ম প্রচারের। পরবর্তী বিভিন্ন পর্বে আমরা তাঁর ধর্মীয় গণআন্দোলন ও চেতনার অনেক উদাহরণ খুঁজতে চেষ্টা করবো। পুরীধামের শ্রী জগন্নাথদেব বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণরই অভিন্ন বিগ্রহ। তাই সন্ন্যাস গ্রহণের পর বৃন্দাবনধামে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও শচী মায়ের অনুমতিক্রমে তিনি নীলাচলবাসী হন(বাংলা থেকে নীলাচলের দূরত্ব ও অবস্থানগত সুবিধার জন্য মা তাঁকে এই অনুমতি দেন)। তাই তাঁর এই দুই লীলাক্ষেত্র (বাংলা ও উৎকল) আজও স্মৃতি বুকে ধরে জাগিয়ে রেখেছে ৬০০ বছরের অমলিন ইতিহাস। এমনকি শোনা যায় বর্তমান ওড়িশাতে চৈতন্য মহাপ্রভুর মন্দির ও পুজনস্থলের সংখ্যা বাংলার থেকেও বেশি।

তিন

এই পর্যন্ত আলোচনায় সমকালীন সমাজ ও চৈতন্য জীবনীকারদের সম্বন্ধে আমরা কিছু ধারণা পেয়েছি। এবার সময় আসছে সেই সময়ের সাথে সাথে নবদ্বীপের সমাজচিত্র ও শিক্ষার সামগ্রিক রূপটি নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ করার। দক্ষিণ রাঢ় বাংলায় গঙ্গার পশ্চিমে নদীয়া জেলার অন্তর্গত গ্রাম নবদ্বীপ। সংস্কৃত ও ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষায় তখন সমগ্র ভারতের মধ্যে অগ্রগণ্য এই গ্রাম। দূরদূরান্ত থেকে ছাত্র আসতেন ব্যাকরণ ও ন্যায়ের পাঠ নিতে। সংস্কৃত ব্যাকরণে নবদ্বীপের পন্ডিতরা সমগ্র দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। আমাদের প্রাণের মানুষ চৈতন্যদেবের বাবাও (পন্ডিত জগন্নাথ মিশ্র) ছিলেন ব্যাকরণের বিশেষ পন্ডিত। তিনি নিজ পান্ডিত্যগুণে 'পুরন্দর' উপাধিও লাভ করেছিলেন। সেই সময় নবদ্বীপের পথে-ঘাটে ব্যাকরণ ও ন্যায় নিয়ে মুখে মুখে আলোচনা ও তর্ক লেগেই থাকতো। কিন্তু নবদ্বীপের পন্ডিতরা শাস্ত্র ও ব্যাকরণে চিরন্তন বুৎপত্তি লাভ করলেও বাংলায় ন্যায়শাস্ত্রের প্রচার ও শিক্ষাপ্রদানের কৃতিত্ব যদি কারো প্রাপ্য থাকে, তা একমাত্র দিগ্বিজয়ী পন্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্যের। পরে তিনিই ওড়িষ্যার রাজদরবারে আমন্ত্রিত হন রাজপণ্ডিতের আসন অলংকৃত করতে। তিনি আজও বাংলার গৌরব, প্রত্যেকটি ন্যায়ের ছাত্রের কাছে প্রাতঃস্মরণীয়।

একটি সময়ে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের একমাত্র পীঠস্থান ছিল মিথিলা। মিথিলার পন্ডিতদের কাছে বাংলা থেকে অগণিত ছাত্র ছুটে যেতেন শুধুমাত্র ন্যায় অধ্যয়নের জন্য। কিন্তু বাংলার ছাত্রদের মেধা ও পান্ডিত্যের জন্য আশঙ্কায় থাকতেন মৈথিলী পন্ডিতের দল। তাই ন্যায়ের কোনো টীকাগ্রন্থ সঙ্গে করে বাংলায় নিয়ে আসা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। এই প্রতিকূল অবস্থায় পন্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য সমস্ত ন্যায়ের টীকা কণ্ঠস্থ করে বাংলায় ফিরে আসেন এবং শুরু করেন ন্যায়শিক্ষার টোল। তাঁর এই ঋণ বাংলা কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।

ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলছেন- "নবদ্বীপে ন্যায়ের টোল তখন হিন্দুস্থানে অদ্বিতীয়; দর্শন, কাব্য, অলংকার প্রভৃতি শাস্ত্রেরও সেইসময় বিশেষরূপে চর্চা হইতেছিল।" তাঁর ভাষায়- "পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে নবদ্বীপ তিনটি শ্রেষ্ঠ পুরুষকে উপহার দিয়াছে - রঘুনাথ শিরোমনি, স্মার্ত রঘুনন্দন ও চৈতন্যদেব।" প্রথম দুজন শাস্ত্রকার সেইযুগের গর্ব। আর তৃতীয় জন? চলতে থাকুক, ধীরে ধীরে

জানবো তাঁর পান্ডিত্য, ভক্তিরস ও দর্শন।

এই হলো নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজ ও শিক্ষার সামগ্রিক ছবি। কিন্তু ধর্ম? চৈতন্য জন্মের আগে সমাজের চিরকালীন ভেদাভেদ ও ধার্মিক সংকীর্ণতার ওপরে কখনোই উঠতে পারেনি শিক্ষিত নবদ্বীপ। উঁচু নীচু ব্রাহ্মণ শুদ্রের ভেদাভেদ কুরেকুরে খেতে থাকে সমাজের ভিতকে। চৈতন্যদেব ছিলেন উদার। তাঁর মানবধর্ম জাত চেনেনি কখনো। নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও থোড়-মোচা বিক্রেতা গরিব শুদ্র শ্রীধরের সাথে যেমন তিনি মজা করে তর্ক করতেন, তেমন ভিক্ষুক শুক্লাম্বরের ঝুলি থেকে খাদ্য গ্রহণ করতেও পিছপা হতেন না কখনো। আজও মানুষ আত্মগরিমা প্রতিষ্ঠা করেন প্রতি ক্ষণে। কথায় কথায় স্থাপন করেন কাজের অহংকার। আর পঞ্চদশ শতকে তিনি ছিলেন সেসবের উর্দ্ধে। এখানেই তাঁর যুগোত্তীর্ণ মানবতা। তাই তিনি মানুষের দেবতা, অন্তজের প্রাণ।

রাতের অন্ধকারেও আকাশে থাকে আলোর তৃপ্তি, বয়ে নিয়ে যাওয়া ভালোবাসা। একটি মাত্র উজ্জ্বল চাঁদের উপস্থিতি চিনিয়ে দেয় আকাশের অস্তিত্ব। কিন্তু তারপাশেও অগণিত জ্যোতিষ্কের ভিড় যেন প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করে চাঁদের স্বকীয়তাকেই। মহামানব কখনো একা আসেন না, সঙ্গে আনেন তাঁর পারিষদদের। চৈতন্য আবির্ভাবের পূর্বে নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজে অগ্রগণ্য ব্যাক্তিত্ব ছিলেন পন্ডিত অদ্বৈত আচার্য। চৈতন্য জীবনী বিশ্লেষণে তাঁকে উপেক্ষিত রাখলে যেন অধরাই থেকে যায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্বের আদি রূপ। তিনি ছিলেন তৎকালীন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অবিসংবাদী নেতা। শান্তিপুরের কমলাক্ষ ভট্টাচার্য নিজ নেতৃত্বগুনে হয়ে উঠেছিলেন অদ্বৈত, সংখ্যালঘু ভাববাদী বৈষ্ণবসমাজের গুরু। শুদ্ধ চিত্তে তিনি প্রতি সকালে গঙ্গাজল ও তুলসী নিয়ে আবাহন করতেন স্ময়ং নারায়ণকে। বৈষ্ণব সমাজ আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, চৈতন্যদেব তাঁরই ডাকে অবতীর্ণ হন নদিয়ায়, মান্যতা দেন অন্তজ শ্রেণীর সংগ্রামকে।

আর একজনের প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। তিনি চৈতন্য আমলে বৈষ্ণব সমাজের দ্বিতীয় নেতা নিত্যানন্দ প্রভু (পিতৃদত্ত নাম 'কুবের গোস্বামী')। ধারে, ভারে, ও ব্যাক্তিত্বে তিনি সেই শতকের এক উজ্জ্বল পুরুষ। বীরভূম জেলার একচক্র বা একচাকা গ্রামে (বর্তমানে তারাপীঠের নিকটে বীরচন্দ্রপুর গ্রাম) ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় একজন অবদূত রূপে সারা ভারত ভ্রমণ করে কাটিয়ে দেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে অচেনা সন্ন্যাসীর সঙ্গে ঘর ছেড়ে তাঁর বেরিয়ে পড়া ঈশ্বর উপলব্ধির উদ্দেশ্যে। তারপর বৃন্দাবন থেকে শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে চৈতন্যদেবের কথা শুনে তাঁর নবদ্বীপে আগমন। আর সেই থেকেই শুরু দুই ভাইয়ের মানবধর্ম প্রচার। চৈতন্য জীবনী ঘাঁটতে গিয়ে আমরা বারে বারে তাঁর ওপর চৈতন্যদেবের অগাধ শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার বিশেষ পরিচয় লক্ষ্য করেছি। একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারলাম না - চৈতন্যদেব তখন মানুষের ঈশ্বর, ভক্তের ভগবান। তিনি একে একে বরদান করছেন সকল ভক্তকে। এমনকি আচার্য অদ্বৈতকেও। কিন্তু বরদান করলেন না শুধু প্রভু নিত্যানন্দকে। উপরন্তু প্রভুর পরনের বস্ত্র ছিঁড়ে তিনি শ্রদ্ধাভরে প্রদান করলেন আর তাঁর পাদোদক পান করতে বললেন সকল ভক্তকে। এই হলো নিত্যানন্দ স্বরূপ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁকে স্ময়ং বলরাম বলেই বিশ্বাস করেন। চৈতন্যদেবও নবদ্বীপে নিত্যানন্দ আগমনকালে হলধর বলরামের স্বপ্ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

এমনই ছিল তখনকার নবদ্বীপ। শিক্ষায়, চেতনায়, ধর্মসচেতনতায় সারা ভারতের মধ্যে তার স্থান ছিল সবার ওপরে। এহেন নবদ্বীপের জ্যোতি সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে নি। তারসঙ্গে যোগ হয়েছিল এতোগুলি মহামানবিক চেতনার আধার- তাই পঞ্চদশ শতকে নবদ্বীপ তথা বাংলার পথ আটকায়, এ সাধ্য কার। খুব তাড়াতাড়িই এই বৈষ্ণব সমাজে প্রচলিত মানবধর্মের ছাতার তলায় এসে পড়েন ভারতবর্ষের বিভিন্ন দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক, যুগপুরুষ এবং অগণিত সাধারণ মানুষ। পরবর্তী খণ্ডগুলিতে আমরা দেখবো কিভাবে অকূল চৈতন্য প্রভাবে সমাজের মাথা,রাজা, মুসলিম কাজী পর্যন্ত নগরে কীর্তন করতে করতে হেঁটেছিলেন নীচ চণ্ডালদের হাত ধরেও।

আজও আমরা মুক্তি পাইনি ধর্ম সংকীর্ণতার প্রকোপ থেকে। আজও একজন মুসলিম বা হিন্দুকে নির্মমভাবে মরতে হয় নিছক জাতিদাঙ্গার কারণে, ধর্মাচরণের কারণে। ৬০০ বছর আগে সেই মহামানব যে ধর্মের পথ তুলে এনেছিলেন সমাজের সামনে, তার প্রত্যেকটি মুহূর্ত হয়তো আজও সমান প্রাসঙ্গিক, শিক্ষণীয়ও বটে। জাত নয়, ধর্ম হয়, মানুষের একমাত্র ধর্ম মানবধর্ম। আজও বারে বারে ফিরে আসে চন্ডিদাসের উক্তি - "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"।

চার

চৈতন্যদেবের নবদ্বীপে বাল্যজীবন নিয়ে আলোচনার আর কোনো অবকাশ থাকে না৷ তা নিয়ে বহু গ্রন্থে ও গবেষণায় বহুবার আলোচনা হয়েছে৷ অন্নপ্রাশন, উপনয়ন থেকে গোয়ায় পিতৃকার্য এবং ঘর ছেড়ে নীলাচল গমন- এই পর্যায়টুকু বহুল আলোচিত এবং সর্বজনজ্ঞাত৷ তবু জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে নবদ্বীপে চৈতন্য জীবনকে সরাসরি দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়৷ প্রথম পর্যায়ে যদি আমরা পরম জ্ঞানী, বিদ্যানিধি অধ্যাপক নিমাই পন্ডিতকে দেখি, তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায় কৃষ্ণপ্রেমে দিব্যোন্মাদ এবং সংকীর্তনরত বিশ্বম্ভরকে৷ এই পরিবর্তনের পটভূমিকা হয়তো সাজানো ছিল বহু আগেই, শুধু গয়ায় শ্রীপাদ ঈস্বরপুরীর সংস্পর্শে এসে তিনি দিব্য চৈতন্য লাভ করেন৷ পিতৃকার্য সেরে গয়া থেকে নবদ্বীপ ফিরে আসার পর বৈষ্ণবরা পেয়েছিলেন এক নতুন নেতা'কে - সংকীর্তন কান্ডারি প্রভু বিশ্বম্ভরকে৷ এই সময়েই দূর হয়েছিল তাঁর সমস্ত পান্ডিত্যের অহংকার আর অধ্যাপনার ইচ্ছে৷ তথাপি ছাত্ররা আর কেউ অন্যত্র শিক্ষালাভে যেতে রাজি ছিলেন না৷ তাই সকলে মিলে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়৷ নবদ্বীপের পথে ঘটে সন্ধেবাতি আর শাঁখের শব্দের সাথে ধ্বনিত হতে লাগলো খোল কর্তালের মাতন৷ সুসজ্জিত চৈতন্যদেবের অগ্রভাগে নাচ ও কীর্তনের মাধ্যমে নেতৃত্বদানে বৈষ্ণবরা পেলেন এক নতুন উদ্যমশক্তি৷

নগর কীর্তনে জমায়েত হতে শুরু করলেন অগণিত মানুষ৷ শুধুমাত্র চৈতন্যদেব নন, বৈষ্ণব সমাজের কান্ডারীদের মধ্যে নেতৃত্ব দিলেন দ্বিতীয় নেতা তথা অবধূত নিত্যানন্দ,

আচার্য অদ্বৈত, বণিক শ্রীবাস, গায়ক মুকুন্দ, গদাধর প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ৷ বাংলার ইতিহাসে শাসকের অত্যাচারের ওপর কার্যত এ এক প্রথম প্রতিরোধ৷

জীবনী গ্রন্থকার বৃন্দাবন দাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই সময়কালে প্রভুর একাধিকবার ভাবাবেশে যাবার কথা উল্লেখ করেছেন৷ দশ অবতারের ভাব থেকে হলধর ভাব- বিভিন্ন সময়ে ভক্তরা দেখতেন প্রভুর আবেশ৷ নিত্যানন্দ আগমনের পূর্বেও হলধর ভাবে আবিষ্ট হন চৈতন্যদেব৷নিত্যানন্দ আসছেন এই স্বপ্ন দেখে প্রভু বলছেন

কহিতে প্রভুর বাহ্য সব গেলো দূর

হলধর ভাবে প্রভু গর্জয়ে প্রচুর

"মদ যান, মদ যান" বলি প্রভু ডাকে

হুঙ্কার শুনিতে যেন দুই কর্ণ ফাটে

(চৈ:ভা:)

হলধর বলরাম মদিরা পান করতেন৷ তাই হলধর আবেশে মদিরার কথাই বলতে শোনা যায় বিশ্বম্ভরের মুখে৷ এমন নিত্য আবেশে বাল্যচাঞ্চল্য প্রকাশ থেকে অবতার ভাব দর্শন- প্রতি মুহূর্তে চলতো নিত্য নতুন লীলা৷

চৈতন্যদেবের নবদ্বীপ পর্যায়ে আরো দুটি বিখ্যাত ঘটনা হলো নবদ্বীপের অত্যাচারী চাঁদ কাজী এবং কোটাল জগ্ননাথ ও মাধবের মধ্যে মানবপ্রেমের বীজবপন৷ চৈতন্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা শাসক ও রাজশক্তির সামনে চৈতন্যপ্রভাব বারে বারে দেখে থাকি৷ নবদ্বীপে কাজী থেকে উড়িষ্যার প্রবল পরাক্রমশালী গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রদেব বা দক্ষিণের রাজশক্তি রায় রামানন্দ - প্রত্যেকেই ছিলেন একনিষ্ট চৈতন্য সেবক৷ এমনকি গৌড় সুলতান হুসেন শাহের দুই উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারী দবীর খাস ও সাকোর মল্লিক উড়িষ্যায় থাকাকালীন চৈতন্যদেবের সাথে গোপনে দেখা করতেন৷ পরবর্তী সময়ে এঁরাই বৃন্দাবনে বিখ্যাত ছয় গোঁসাইয়ের অন্যতম রূপ ও সনাতন গোস্বামী নামে শ্রীকৃষ্ণের গুপ্তলীলা প্রকাশ করেন৷ তবে অনেক গবেষকের মতে চৈতন্যদেব রাজা প্রতাপরুদ্র ও উড়িষ্যাকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন৷ উড়িষ্যার প্রধান শত্রু বাংলার দুই প্রধান কর্মচারীকে কৃপাপ্রদান তারই অঙ্গ কিনা তা অবশ্য প্রমাণসাপেক্ষ৷ তবে বিভিন্ন সংকটে তিনি যে উড়িষ্যা ও তাঁর গজপতি রাজশক্তিকে ছায়াপ্রদান করেছিলেন তা অনস্বীকার্য৷ এই কারণেই তাঁর আর এক নাম 'প্রতাপরুদ্র সংত্রাতা'৷ উড়িষ্যার বিভিন্ন লৌকিক ও অলৌকিক ক্রিয়ার বিবরণগুলি পর্যায়ক্রমে আমরা পরবর্তী পর্বগুলিতে নিশ্চই আলোচনা করবো৷

চৈতন্য চরিত্রে প্রকট ছিল অনেকগুলি সত্ত্বা৷ নবদ্বীপে কখনো তাঁকে দেখা যেত শিশুর মতো গঙ্গায় জলক্রীড়া করতে৷ আবার কখনো বলিষ্ঠ নেতার মতোই দৃঢ় ছিল তাঁর বজ্রকঠিন নেতৃত্ব৷ তাঁর নেতৃত্বগুনে দেখা যেত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আকুতি, দোষীকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা এবং জাতিভেদকে তুচ্ছ করে মানবধর্মকে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার মতো দৃঢ়চেতা কাঁধ৷ তাঁর দণ্ডদানের সমতাভাব বোঝাতে নবদ্বীপের একটি ঘটনা আলোচনা করা যেতেই পারে৷ তিনি বলেছিলেন শচীমাতার বৈষ্ণব অপরাধ ছিল৷ আচার্য অদ্বৈতর কাছে তিনি অপরাধী ছিলেন৷ তাই তাঁর প্রেম ভক্তি পাবার অধিকার ছিল না৷ শচীমাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিস্বরূপ ছিলেন আচার্যের ছায়াসঙ্গী৷ পরবর্তী সময়ে নিমাইও হয়ে ওঠেন তাঁর সহচর৷ স্বভাবতই মাতা শচী সবসময় সংকিত থাকতেন এবং আচার্য কে খুব একটা পছন্দ করতেন না৷ তাই বিশ্বম্ভর বলেন আচার্যের পদধূলি গ্রহণ করলে তবেই মা হবেন অপরাধমুক্ত৷ এই কথা শুনে আচার্য অদ্বৈত বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং সেই অবসরে শচীমাতা আচার্যের পদধূলি গ্রহণ করেন৷ এমনই ছিলেন চৈতন্যদেব৷ মানবশিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে তিনি ছিলেন কাঁচের থেকেও স্বচ্ছ৷ তাঁর কাছে আপন পর তুচ্ছ৷ তিনি নির্দ্বিধায় বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন ভিক্ষু শুক্লাম্বর কে আবার অবলীলায় ত্যাগ করতে পারেন রাজ্ আমন্ত্রণ৷

এহেন প্রভুর আবির্ভাবে নদিয়ার লোকজন যে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হবেন, তা বলাই বাহুল্যতা৷ চৈতন্যের শক্তিতে তাঁরা সকলে ছিলেন বলীয়ান৷ যে সময় নবদ্বীপের কাজী চাঁদ খানের সাথে বিবাদ বাঁধে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের, সেই সময় তিনি নিজে সংগঠিত করেন মানুষের আন্দোলন৷ কাজী হরিনাম সংকীর্তনের বিরোধিতা করবার জন্য নির্বিচারে মৃদঙ্গ ভাঙতেন, ছত্রভঙ্গ করতেন কীর্তন মিছিল৷ তখন প্রভু নবদ্বীপ থেকে বিশাল মিছিল সহযোগে এগিয়ে এসেছিলেন কাজীর দরজায়৷ প্রত্যেকের হাতে শান্তির মশাল৷ সেই সময় ভারতবর্ষ দেখেছিলো প্রথম মানুষের আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ৷ সেই প্রেম ভক্তির বন্যায় ভেঙে যায় কাজীর যাবতীয় প্রতিরোধ, কাজীও হয়ে ওঠেন চৈতন্য অনুগামী৷ বাংলার ইতিহাসে এ এক অনন্য গৌরবের কাহিনী৷ শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষের মুক্তিলাভের কথা৷ নেপথ্যে সেই চৈতন্যদেব৷

তাঁর মতো বলিষ্ঠ তথা সহানুভূতিশীল নেতা বর্তমান ভারতবর্ষের কাছে উদাহরণস্বরূপ৷ তাঁর অনুগামী ও ভক্তদের মধ্যে যে একতা এবং মৈত্রীভাব দেখা যেত, তা চৈতন্য পরবর্তী ভারতে সত্যিই বিরল৷ পন্ডিত শ্রীবাসের পুত্রের মৃত্যু হয় তাঁর ঘরে চৈতন্যদেবের কীর্তন সময়ে৷ অন্য ভক্তদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটবে বলে তিনি ঘরের রমনীদের কাঁদতে পর্যন্ত বারণ করেন৷ এমনকি বেদনায় মর্মাহত শ্রীবাস নিজেও কীর্তনে মেতে থাকেন বহু সময়৷ পরে চৈতন্যদেব জানতে পারলে নিজে হাতে শ্রীবাসের পুত্রের দেহ সৎকারে নিয়ে যান নবদ্বীপের গঙ্গার পাশে৷ মধ্যযুগের বৈষ্ণব ইতিহাসে এ এক উজ্জ্বল সময়৷ মৈত্রীর এমন উপমা সারা বিশ্ব কতবার দেখেছে, তা আজও গুনে বলা যায়৷

কৌশিক চক্রবর্ত্তী:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন