গল্প
রত্নাঙ্ক স্নান সেরে এসে দেখল তেরোটা মিসড্ কল। তেরোটাই
ত্রিধার। এই ফোনটারই ভয় পাচ্ছিল সে। অন্যান্য দিনের মতো গত কালও অনেক রাত অবধি কথা
হয়েছে ওর। ও বলেছিল, না।
তাকে একা যেতে হবে না। আমিই সঙ্গে করে তোকে ডাক্তার সান্যালের কাছে নিয়ে যাব।
ডাক্তার সান্যাল স্কিনের খুব বড় নামকরা ডাক্তার। তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়াই
ভাগ্যের ব্যাপার। এখন বারোশো টাকা ভিজিট। তাও ডেট পাওয়ার জন্য তিন মাস আগে থেকে
নাম বুক করে রাখতে হয়। তবে হ্যাঁ, নিজের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে একদিন সকালে ঘণ্টা তিনেক করে বসেন।
মায়ের নামে চেম্বার। মা খুব বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে হলেও বাবা ছিলেন অত্যন্ত
ছাপোষা মানুষ। সামান্য একটা চাকরি করতেন। বাড়ির কেউ রাজি হয়নি দেখে তাঁর বিয়ের
জন্য মায়ের রেখে যাওয়া গয়নাগাঁটি নিয়ে এক শাড়িতেই তার বাবার সঙ্গে জামশেদপুর থেকে
পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। একটা
কলোনিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। খুব কষ্ট করেই চলতেন তাঁরা। তাঁদের যখন এই ছেলে হল, তখন তাকে তাঁর
বাবা-দাদার মতো একজন ডাক্তার করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন তার মা। নিজেই পড়াতেন।
স্বামীর টাকায় কুলোত না। তাই বাড়ি থেকে আনা গয়না থেকে একটা-একটা করে বিক্রি করে
তিনি তাঁর ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। সেটা দেখে তাঁর যে দু’-চার জন বন্ধু ছিলেন, তাঁদের একজন বলেছিলেন, কী রে, গয়না বিক্রি করে
ছেলেকে মানুষ করছিস? তোকে
শেষ বয়সে ছেলে দেখবে তো!
তিনি বলেছিলেন, আমি তো গয়না বিক্রি করছি না। আমি গয়না
গড়াচ্ছি।
সত্যিই তাঁর ছেলে তাঁর অলঙ্কার হয়ে উঠেছিল। দুর্দান্ত ভাল
রেজাল্ট করে ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছিল। আর চান্স পেয়েই আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে ও এত
মেতে উঠেছিল যে শুধু সহপাঠীদেরই নয়, অনেক সিনিয়রকেও মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই
পিছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল।
সেই মা আর নেই। তিনিও অনেক বড় হয়েছেন। যথেষ্ট টাকাপয়সা রোজগার
করেছেন। বিশাল একটা প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছেন। সেই বাড়ির নাম রেখেছেন মায়ের
নামে। যত কাজই থাক, প্রতি
সপ্তাহে একেবারে নিয়ম করে সেখানে বসেন। আগে থেকে নাম লেখানোর কোনও ব্যাপার নেই।
আগে আসার ভিত্তিতে প্রথম দশ জনকে তিনি দেখেন। না। বিনে
পয়সায় নয়। তিনি মনে করেন,
বিনে
পয়সায় কিচ্ছু হয় না। সামান্য হলেও কিছু দাও। তাই টিকিটের দাম রেখেছেন এক টাকা। ফলে
সকাল থেকে নয়, তাঁকে
দেখাবার জন্য আগের দিন রাত থেকেই লাইন পড়ে যায়।
এই ডাক্তারের সঙ্গে রত্নাঙ্কর খুব ভাল সম্পর্ক। সম্পর্ক ভাল
হওয়ার কারণ, ডাক্তার
সান্যালের মা। তিনি ওকে খুব পছন্দ করতেন। ভালও বাসতেন। ডাক্তার সান্যাল তো তাঁর
ডাক্তারি নিয়েই সারা দিন ব্যস্ত থাকতেন। তাই তাঁর ইচ্ছে থাকলেও মাকে খুব একটা সময়
দিতে পারতেন না। তাঁর মা শনিবার-শনিবার উপোস করে বড় ঠাকুরের পুজো দিতে যেতেন
পাশের পাড়ায়। টুকিটাকি জিনিস কিনতে
যেতেন এ দিকে ও দিকে। কোনও কোনও দিন বাচ্চাদের একটা অনাথ আশ্রমে যেতেন ফলমূল দিতে।
এর পাশাপাশি তাঁর আর একটা শখ ছিল, ফুল গাছের। প্রায়ই
সার আর চারা গাছ কেনার জন্য এ নার্সারি ও নার্সারিতে ঢু মারতেন। তখন তাঁর সঙ্গে
যেত এই রত্নাঙ্ক। রত্নাঙ্কর কোলেই মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তিনি। না।
ডাক্তার ডাকার কোনও সুযোগ দেননি। চলন্ত গাড়িতে হঠাৎ বুকে ব্যথা, ব্যাস। সব শেষ। সেই
সুবাদেই ডাক্তার সান্যালের সঙ্গে রত্নাঙ্কর এত ভাল সম্পর্ক।
রত্নাঙ্কর সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই এক স্কুলে পড়ত ত্রিধা।
ক্লাস এইট পর্যন্ত ওই স্কুলেই ছিল। তার পর ত্রিধারা বাড়ি কিনে চলে যায় বাইপাসের
ধারে, পঞ্চান্ন
গ্রামে। বহু দিন কোনও যোগাযোগ ছিল না। এত দিন বাদে আবার নতুন করে দু’জনের দেখা। ভাল লাগা।
এই নতুন আলাপ তখন সবেমাত্র তিন দিন গড়িয়ে চার দিনে পড়েছে।
প্রেম হব হব করছে। তখন একদিন গড়িয়াহাট মোড়ের আলেয়া’য় সিনেমা দেখতে
গিয়েছিল ওরা। হল থেকে বেরিয়ে দু’জনে সবে রাস্তা পার হতে যাবে, হঠাৎ তাদের সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াল
একটা ঝকঝকে অডি গাড়ি। পেছন সিটের জানালার কালো কাচ নামিয়ে মুখ বার করে রত্নাঙ্ককে
গাড়ির সওয়ারি জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিকে যাবি?
রত্নাঙ্ককে কথা বলতে দেখে ত্রিধা একটু সরে দাঁড়াল। লোকটাকে সে
চেনে না। দু’জনকে
পাশাপাশি দেখলে কী ভাববে কে জানে! যদি ওদের বাড়ির কেউ হয়! যদি কেউ নাও হয়, ওদের দেখে অতি উৎসাহী
হয়ে যদি ওদের বাড়িতে গিয়ে বলে দেয়! সব জানাজানি হয়ে যাবে না! ওদের নিজেদের মধ্যেই
এখনও সে রকম কিছু গড়ে ওঠেনি। রত্নাঙ্কর সমস্যা হবে না! তবু লোকটাকে আড়চোখে দেখার
চেষ্টা করতে লাগল ত্রিধা। গাড়িঘোড়ার শব্দের মধ্যেও কান খাড়া করল, উনি কী বলছেন, যদি শোনা যায়!
রত্নাঙ্ক জানে লোকটার বাড়ি ফার্ন রোডে। তাই সে বলল, আমি সোজা যাব। রুবির দিকে।
— রুবি? চলে আয়। আমি তো রুবি
হয়েই যাব।
এই রে,
সেরেছে… নিজের মনেই বিড়বিড়
করল রত্নাঙ্ক। কেন যে রুবির দিকে বলতে গেলাম!
— কী
ভাবছিস? উঠে
আয়। বলেই, গেটের
লক খুলে সিটের ও দিকে সরে গেলেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে আলতো করে দরজা ঠেলে জানালার কাছে মুখ নিয়ে
রত্নাঙ্ক বলল, তার
আগে আমাকে একবার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে যেতে হবে। তাই…
— ও… ঠিক আছে, যা তা হলে। ভাল আছিস
তো?
— হ্যাঁ।
আপনি?
— এই
তো… অনেক
দিন তো আসিস না। মা নেই বলে কি আমরাও নেই? একদিন চলে আয় না...
— হ্যাঁ, যাব। এর মধ্যেই যাব।
এখন আছেন তো?
— হ্যাঁ, এই মাসটা আছি। তার পর
চার মাসের জন্য একটু বাইরে যাব।
পেছনে পর পর কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। তারা ঘনঘন হর্ন
বাজাচ্ছে। অটোগুলো পাশ কাটিয়ে গাড়ির ও পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে তাদের
দিকে বিরক্তিসূচক চাহনি ছুড়ে দিচ্ছে। তাই রত্নাঙ্ক বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে… এর মধ্যেই যাব। বলেই, জানালা থেকে মুখ
সরিয়ে নিল।
গাড়িটা জানালার কাচ তুলতে তুলতে হুস করে চলে গেল। গাড়িটা
যেতেই ত্রিধা বলল, ইনি
ডাক্তার সান্যাল না?
— হ্যাঁ।
কেন? তুমি
চেনো?
— না
না। আমি চিনব কী করে! আমি বলছি, উনি নিজে থেকে গাড়ি থামিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বললেন!
— হ্যাঁ, না বলার কি আছে! উনিও
মানুষ। আমিও মানুষ।
গদগদ হয়ে ত্রিধা বলেছিল, উনি কত বড় ডাক্তার জানো?
— উনি
কত বড় ডাক্তার আমি জানি না। তবে, উনি কত বড় মাপের মানুষ, সেটা আমি জানি।
— তোমাকে
খুব ভাল করে চেনেন, না?
রত্নাঙ্ক বলেছিল, কেউ যদি কোনও ভাইকে জিজ্ঞেস করে, তার দাদা তাকে খুব
ভাল করে চেনে কি না, সেই
প্রশ্নটা যেমন হবে, তোমার
এই প্রশ্নটাও ঠিক সেই রকম…
— উনি
তোমার দাদা?
— না।
ঠিক দাদা নন। দাদার মতো। তবে দাদার চেয়েও বেশি…
ওটা শুনেই ত্রিধা বলেছিল, তাই? তা হলে ওনার সঙ্গে আমার একটা
অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করিয়ে দাও না…
— অ্যাপয়েন্টমেন্ট!
কেন? কার
জন্য?
— এই
দ্যাখো না, গালের
এই ছিট ছিট দাগটা… আগে
এইটুকুনি ছোট্ট একটা তিলের মতো ছিল। এত গাঢ়ও ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে। এই
ক’বছরে এত বেড়ে গেছে
না… কারও
সামনে যেতে বড্ড লজ্জা করে।
— কোনও
ডাক্তার দেখাওনি?
— কত
ডাক্তার দেখিয়েছি। প্রথমে আমাদের পাড়ার এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দেখাতাম। কমছে
না দেখে কে যেন বলেছিলেন,
কোনও
কবিরাজকে দেখাতে। তিনিই বোধহয় কারও নাম-ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কিছু দিন সেই
কবিরাজকেও দেখিয়েছিলাম। কিন্তু যে কে সে-ই। কোনও লাভ হয়নি।
— তার
পর?
— আমার
বাবাকে তাঁর এক বন্ধু বলেছিলেন, ওই সব কবিরাজি-টাজি, হোমিওপ্যাথি-ফ্যাতি ছাড়। মেয়েকে ভাল
কোনও ডাক্তার দেখা।
— তার
পর?
— আমাদের
ওখানকার একজন বেশ নামকরা ডাক্তারকে দেখালাম। তিনিই দেখেটেখে রেফার করে দিলেন
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ট্রপিক্যালে। সেই সক্কালবেলায় যেতে হত। ওরা প্রথমে
ভেবেছিল, আমার
বুঝি কুষ্ঠ হয়েছে। তার পর ওখানকারই একজন বড় ডাক্তার বললেন, না না, কুষ্ঠ না। এটা একটা
মামুলি চর্মরোগ। তবে অনেক দিনের পুরনো তো... গেড়ে বসেছে। সারতে একটু সময় লাগবে।
কিন্তু অত সময় কার আছে! তাই বাবা বললেন, মেয়ে বলে কথা। গালে ও রকম দাগ থাকলে কেউ
বিয়ে করবে? যত
টাকা লাগুক রঞ্জিত পাঁজাকে দেখাব। উনি তখন স্কিনের এক নম্বর ডাক্তার। যে দিন বাবা
আমাকে নিয়ে যাবেন ঠিক করলেন, তার আগের দিন রাত্রেই শুনলাম, তিনি মারা গেছেন। আমি তখন কত ছোট...
— তার
পর?
— তার
পর আর কী? একের
পর এক প্রচুর ডাক্তার দেখিয়েছি। পাতার পর পাতা ওষুধ খেয়েছি। এ মলম লাগিয়েছি। সে
মলম লাগিয়েছি। কিন্তু যে কে সে-ই। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি।
— ট্রপিক্যালে
আর যাওনি?
— নাঃ।
— কেন?
— রোজ
রোজ কে নিয়ে যাবে?
— নিয়ে
যাওয়ার কী আছে? তুমি
কি বাচ্চা নাকি, কোলে
করে নিয়ে যেতে হবে? একাই
যাবে।
— ও
বাবা, মেয়ে
না! আমাদের বাড়ি থেকে ছাড়বেই না। ভীষণ স্ট্রিক্ট।
— তার
পর?
— তার
পর এই তো কিছু দিন আগে একটা চ্যানেলে এই ডাক্তারকে দেখলাম। তখনই জানতে পারলাম এনার
কথা। শেষ চেষ্টা হিসেবে এঁকে একবার দেখাব ঠিকও করলাম। অনেক খুঁজেপেতে ওনার ঠিকানাও
জোগাড় করলাম। যোগাযোগও করলাম। কিন্তু যা শুনলাম! তিন মাসের আগে ওনার কোনও ডেটই
পাওয়া যাবে না…
— তুমি
দেখাতে চাও?
হাতের মুঠোয় যেন স্বর্গ পেয়েছে, এমন ভাবে ত্রিধা বলল, দেখো না, যদি একটা ডেট পাওয়া
যায়…
— ডেট
পাওয়ার কী আছে? কবে
যেতে চাও বলবে, নিয়ে
যাব।
— আগে
তো জানতে হবে উনি কোথায় কোথায় বসেন?
— তোমাকে
নিয়ে গেলে কি ওঁর চেম্বারে নিয়ে যাব?
— তবে?
সহজ ভঙ্গিতে রত্নাঙ্ক বলল, ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাব।
— বাড়িতে!
— হ্যাঁ।
আরে বাবা, আমার
সঙ্গে কি আজকের সম্পর্ক নাকি?
সে দিনই ত্রিধা বলেছিল, তা হলে তুমি ডাক্তার সান্যালের সঙ্গে
কথা বলো না… উনি
যদি কাছাকাছি কোনও একটা ডেট দিয়ে দেন…
— ডেট
নেওয়ার কী আছে? তুমি
যে দিন যেতে চাও বলবে, নিয়ে
যাব।
— না… উনি কবে থাকবেন, না-থাকবেন…
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রত্নাঙ্ক বলল, ঠিক আছে। আমি কালই
কথা বলে নেব। চলো।
কিন্তু না। সেই কাল আর কোনও দিনই আসেনি রত্নাঙ্কর। অবশ্য আসেনি
বললে ভুল হবে, ও-ই
চায়নি। ডাক্তার দেখালে… না।
থাক।
কিন্তু কত কাল আর এ ভাবে ওকে এটা সেটা বানিয়ে বানিয়ে বলে
এড়িয়ে যাওয়া যায়! যত বার ত্রিধা জি়জ্ঞেস করে, কি গো, ডাক্তার সান্যালের সঙ্গে কথা হয়েছে? তত বারই কোনও না-কোনও
একটা অজুহাত তুলে ধরে ও। আজ ফোনে পাইনি। কিংবা উনি মিটিংয়ে ছিলেন। বা অপারেশনে
ছিলেন। নয়তো, কয়েক
দিনের জন্য উনি একটু বাইরে গেছেন। অথবা যত বারই করেছি, শুধু এনগেজড আর
এনগেজড…
কিন্তু না। কাল আর কোনও অজুহাত খুঁজে পায়নি ও। বাইপাশের ধার
ঘেঁষে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ত্রিধা এমন করে বলছিল যে, ডাক্তার সান্যালকে
ফোন না করে ও আর পারেনি। বাধ্য হয়ে তার সামনেই ফোন করেছিল। রিং হতেই না-হতেই
ত্রিধা বলেছিল, স্পিকারটা
অন করো না… অন
করো… অন
করো …
ওর কোনও উপায় ছিল না। স্পিকার অন করে দিয়েছিল। অন করতেই, ও প্রান্ত থেকে ভেসে
এসেছিল, হ্যালো…
— আমি
রত্নাঙ্ক বলছি।
— হ্যাঁ, বল…
— বলছিলাম, আমার একটা পরিচিত
মেয়ে আপনাকে দেখাতে চায়, তাই
একটা ডেট…
— আরে, তোর পরিচিত লোককে
নিয়ে আসবি, এতে
এত হেজিটেট করার কী আছে! নিয়ে আয়।
— কবে
যাব?
— কাল
সকালে তো আমি বাড়িতে বসব। চলে আয়।
— সে
তো দশ জনের বেশি দেখেন না।
— না-হয়
তোর জন্য কাল এগারো জনকে দেখব, কী আছে,
চলে
আয়।
— ঠিক
আছে।
এত সহজে যে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা হয়ে যাবে ত্রিধা ভাবতেই পারেনি।
সে একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। তার পরে যতক্ষণ দু’জনে একসঙ্গে ছিল, আর অন্য কোনও কথা নয়, শুধু ডাক্তারকে নিয়েই
কথা হয়েছিল।
রাত্রেও তাই। ফোন ছাড়ার আগে ত্রিধা জিজ্ঞেস করেছিল, তা হলে কাল কখন বেরোব?
রত্নাঙ্ক বলেছিল, সকালে।
— সে
তো জানি। কিন্তু সকালে মানে কত সকালে? ক’টা নাগাদ? আমাদের যেতেও তো সময় লাগবে।
— ওই
বেরিয়ো না… তোমার
সুবিধে মতো… বেরোবার
আগে আমাকে শুধু একটা ফোন করে নিয়ো।
মুখে এ কথা বললেও, রত্নাঙ্কর একদম ইচ্ছে নয়, ত্রিধাকে নিয়ে
ডাক্তারের কাছে যাওয়ার। কারণ, এই ডাক্তার সান্যালদা চর্মরোগের ক্ষেত্রে একেবারে ধন্বন্তরী।
তাঁর বিশ্বাস, একবার
গেলেই উনি এমন ওষুধ দেবেন যে, দু’-চার
দিনের মধ্যেই ত্রিধার গালের ওই ছিট ছিট দাগগুলো একবারে মিলিয়ে যাবে। আর ওটা মিলিয়ে
গেলেই, সে
মুখ আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। শুধু সুন্দর হলে না-হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু তার থেকেও
বড় কথা, যে
মুখ নিয়ে আর পাঁচ জনের সামনে যেতে তার লজ্জা করে। যে মুখ নিয়ে সে হীনমন্যতায় ভোগে।
কারও সামনে যেতে চায় না। সে
সব একেবারে চিরদিনের জন্য ঘুচে যাবে। তখন!
ও ত্রিধাকে বলেছিল, বেরোবার আগে আমাকে শুধু একটা ফোন করে
নিয়ো। কিন্তু না। একটা নয়,
রত্নাঙ্ক
স্নান করে এসে দেখল, তার
মোবাইলে তেরোটা মিসড্ কল। তেরোটাই ত্রিধার। এই ফোনটারই ভয় পাচ্ছিল সে। এখন উপায়!
কিছু তো একটা বলতে হবে! কিন্তু কী বলবে ও! কি!
না। ত্রিধাকে নয়। ও ফোন করল ডাক্তার সান্যালকে। যত বার ফোন করল, প্রত্যেক বারই এনগেজড
টোন। আর যত এনগেজড টোন পেতে লাগল, ততই ও অস্থির হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু তার পরেই ও আবার যখন ফোন করল, তখন একটা রিং হতে
না-হতেই ফোন ধরলেন উনি। সঙ্গে সঙ্গে ও বলল, হ্যালো, আমি রত্নাঙ্ক। বলছিলাম কি, আজকে যাকে নিয়ে আপনার
ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, সে
এখন ফোন করে জানাল, তার
মা নাকি গত কাল রাতে হঠাৎ করেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে একটা নার্সিংহোমে
ভর্তি করাতে হয়েছে। সারা রাত নাকি ওরা ওখানেই ছিল। ফলে আজ ওর পক্ষে যাওয়া…
— ঠিক
আছে। অন্য দিন নিয়ে আসিস। ও.কে।
ডাক্তার সান্যাল লাইন কাটতেই রত্নাঙ্ক ফোন করল ত্রিধাকে। ও
কিছু বলার আগেই ত্রিধা বলল,
কী
হল, তখন
থেকে ফোন করছি। কোথায় ছিলে?
— ডাক্তার
সান্যালের বাড়িতে।
— ডাক্তার
সান্যালের বাড়িতে!
— তা
হলে আর বলছি কি। এই তো ওঁর বাড়ি থেকে এলাম।
— কী
হয়েছে?
— না।
ওঁর কিছু হয়নি। হয়েছে ওঁর বাবার। আসলে আজ ভোররাতে উনি নাকি বাথরুমে পড়ে গেছেন।
পড়ে গিয়েই একটা স্মাইল স্টোকের মতো… বয়স হয়েছে তো…
— সে
কী! এখন কেমন আছেন?
— এখন
বিপদমুক্ত। ভাগ্যিস উনি বাড়িতে ছিলেন। না-হলে যে কী হত, কে জানে! উনি অবশ্য
রিক্স নেননি। সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিলেন। বড় বড় ডাক্তাররা তো সবই
ওঁর বন্ধুবান্ধব। তাঁরা নাকি বলেছেন, এ যাত্রা উনি বেঁচে গেলেন… তবে ডাক্তাররা ও কথা
বললেও, ডাক্তার
সান্যাল কিন্তু খুব টেনশনে আছেন। তারই মধ্যে কে যেন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাড়িতে আপনার জন্য
পেশেন্টরা তো সব বসে আছেন,
কী
করবেন? উনি
তখন আমার সামনেই তাঁকে ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দিতে বললেন, আজ আর উনি বসবেন না… কেউ যেন অপেক্ষা না
করেন...
— ও… তাই…
— তোমাকে
অন্য কোনও দিন নিয়ে যাব। কেমন?
— না
না। সে ঠিক আছে। অন্য দিন যাবখ’ন। আমি সেটা বলছি না। বলছি, তুমি বরং পারলে বেলার দিকে একবার গিয়ে
ওনাকে দেখে এসো। বুঝেছ? তুমি
ফোন ধরছ না দেখে আমি তো ভাবলাম তোমার আবার কী হল…
— আরে, তাড়াহুড়োর মাথায়
বেরিয়েছি তো… ফোন
নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
— ও...এখন
কী করছ?
— এই
তো সবে ওখান থেকে এলাম। এখনও হাতমুখ ধুইনি।
— ঠিক
আছে, ঠিক
আছে। যাও। ফ্রেশ হয়ে নাও। পরে কথা হবে।
অন্য সময় হলে ইনিয়ে-বিনিয়ে রত্নাঙ্ক আরও কিছুক্ষণ কথা বলত।
কিন্তু না। আজ আর একটাও কথা বাড়াল না ও। কী বলতে কী বলে ফেলবে, তখন আর এক
কেলেঙ্কারি। কোনও মিথ্যেকে ও বেশিক্ষণ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। ধরা পড়ে যেত। সে
জন্যই তাড়াতাড়ি ফোনটা ছেড়ে দিল।
ফোন ছাড়ার পরেই তার মনে হল, এটা কি ও ঠিক করল! ও যে ভয়টা করছে… গালের দাগগুলো মিলিয়ে
গেলে সে আরও দেখতে সুন্দর হয়ে যাবে। অনায়াসে এখানে ওখানে যাবে। এর তার সঙ্গে আলাপ
হবে। আর সে রকম কোনও ছেলে পেয়ে গেলেই আলাপ থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে মেলামেশা।
মেলামেশা থেকে ঘনিষ্ঠতা। ঘনিষ্ঠতা থেকে নিবিড় সম্পর্ক। আর অন্য কারও সঙ্গে
সম্পর্ক গড়ে উঠলেই আস্তে আস্তে তাকে দূরে সরে যেতে হবে… এটা তো অমূলকও হতে
পারে। পারেই। তা হলে!
আমি কি তাকে ডাক্তার সান্যালের কাছে নিয়ে যাব! না, যাব না! যাব! না, যাব না! যাব! না, যাব না! রত্নাঙ্ক
ভাবতে লাগল। ভাবতেই লাগল।
সিদ্ধার্থ সিংহ : কপিরাইট লেখক কর্তৃক
সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন