বিবিধ
- “সরস্বতী
আরে ও সরস্বতী কোথায় গেলি ? কী যে ঝামেলায় পড়েছি আমি! আর পারি না কত্ত বেলা হল বড় বাড়ীর ছেলে মেয়েরা অঞ্জলি দিতে
বেড়িয়ে পড়েছে। আরে ও সরস্বতী কোথায় গেলি তুই ?”
মঙ্গলা নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে...
আজ সাত দিন হয়ে গেল সরস্বতী এসেছে এই বাড়ীতে কিন্তু কিছুতেই
নিজের এই নতুন নামটা সে নিজের অভ্যাসে আনতে
পারছেনা। তাই বাথরুমের ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সরস্বতীর কানে
মঙ্গলার ডাক পৌঁছালেও ,তার মনের ভেতর প্রবেশ করল না।
অদ্ভুত এই স্কুল বাড়ীটায় সরস্বতীর
সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এই বাথরুম। দরজা বন্ধ করলে সে একেবারে একা ,দুনিয়ার কোন কিছুকেই তখন আর ওর ভয়
করে না। যদিও দরজাটা এখন খোলাই আছে কারন তার হাতে যে বাটিটা মঙ্গলা মাসী ধরিয়ে দিয়ে
গেছে সেটা নিয়ে ও যে কি করবে তাই বুঝতে পারছে না।
সরস্বতীও নিজের মনে বিড়বিড় করে...
-“এর থেকে বাপু গৌরী’মা এক থোক হলুদ নিমপাতা বাটতে বললি ভাল
হত, এটা নিয়ে আমি কি যে করি ? এখন মঙ্গলা মাসীকে জিগাতে গেলি ঝাঁটা হাতে তাড়া করবে।”
খুব অদ্ভুত এই ইস্কুল বাড়ী ,তাদের
গ্রামের ইস্কুলে ভাঙ্গাচোরা হলেও টেবিল ছিল,বেঞ্চি ছিল। এখানে বাড়ীটা পাকা খুব বড় কিন্তু
কোন বেঞ্চ, টেবিল কিচ্ছু নেই । বড় বড় তিনটে ঘর , সেই ঘরে ছোট ছোট চৌকি পাতা ,প্রত্যেকটা
ঘরে তার মত অনেক গুলো ছেলে মেয়ে । লম্বা বারান্দার পাশে বড় রান্নাঘর, সেখানে একটা বড় উনানে মঙ্গলা
মাসী দু বেলা খিচুড়ি আর লাবড়া রান্না করে। সব ছেলে মেয়েরা মাসীর কাজে সাহায্য করে আর
সেই মুস্কো লোক দুটো সারাদিন লোহার দরজার পাশে বসে তাস খেলে আর বোতল থেকে কী যেন খায়।
গৌরী’মা মাঝে মাঝে আসে ।
এই তো আজ সকালেই এসেছিল,মঙ্গলা মাসীকে বলে গেল...
- আজ সরস্বতী পুজো খুব ভাল দিন! আজ থেকে আমাদের সরস্বতীও
স্কুলে যাবে। মঙ্গলা! হলুদ নিমপাতা বাটা মাখিয়ে, স্নান করিয়ে মেয়েটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে
রাখ ! আর শোন ! একটা হলুদ শাড়ি পড়িয়ে দিস, মেয়েটার শ্যামলা রঙা চামড়ায় খুলবে ভালো।
সন্ধ্যে বেলা আমি এসে ওকে নিয়ে যাব।
আজ সরস্বতীর খুব খুশীর দিন যদিও
একটা কথা সে ভেবে পাচ্ছে না। তাদের গ্রামের স্কুলে সরস্বতী পুজো হতো না কারন স্কুলের
দিদিমণিরা শহর থেকে আসতো। তাই সেই দিন স্কুল ছুটি থাকত। তবুও গ্রামের বাবুদের বাড়ীর
পুজা ও দেখেছে তাই জানে সারস্বতী পুজা দিনেই হয়। কিন্তু গৌরীমা রাত্তির বেলা আবার কোন
স্কুলে তাকে নিয়ে যাবে!
হঠাৎ করে মায়ের কথা খুব মনে পড়ে...
এই তো সেই দিন সাত সকালে ঊঠে বাবা বলেছিল...
-তোর এত পড়ার শখ!
চল আজ তোকে বড় স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসি।
ছোট ভাই টা ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল আর বলছিল...
“কেন দিদি একা যাবে
আমিও যাব, আমিও দিদির মত নতুন জামা পড়ে স্কুলে যাব ” ... সেই শুনে বাবা বলেছিল তোকে
শহরের বড় স্কুলে পড়াব দিদির স্কুলে তোকে যেতে হবে না।
মা’টাও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছিল ...
আমি কিন্তু গৌরী মার স্কুলে পড়তে
যাব ভেবে খুশীতে পাগল হয়ে গেছিলাম। আমাদের গ্রামের ভাঙাচোরা প্রাইমারী ইস্কুল বাড়ীতে
মাঝে মাঝেই আসত গৌরী’মা, সাথে দু তিনটে মুসকো লোক। কোন সময় তাদের সাথে থাকত ঝুড়ি ভর্তি
ফল, কোন সময় ব্যাগ ভর্তি পুরনো জামা কাপড়।
শুনেছিলো এই ইস্কুলের পড়া শেষ হলে গৌরিমা কিছু ছেলে মেয়েকে পছন্দ করে শহরে নিজের
বড় স্কুলে নিয়ে যায়। অনেক অপেক্ষার পর একদিন গৌরীমার চোখ পড়ল আমার ওপর ...
-এই মেয়েটা আয়
এদিকে আয় আমার কাছে , মুখখানা বেশ টলটলে দেখছি
- বয়স কত তোর
?”
-মা বইলছে মোর
বয়স দশ ।
-বাড়ী কোথায় তোর?
বাবার নাম কি ?
-বাবার নাম সনাতন
মাঝি ।
- হেই যে নদীর
ধার ঘেঁষা পথ দেখছো এটা গেছে মালো পাড়ায়, সেই হানেই মোর ঘর।
- কি করে তোর
বাপ ?
- মা বলে আগে
নৌকা বাইত,বিরিজ হবার পর সারা দিনমান পর বাড়ী আইসা মা রে পিটায় আর ভোঁস ভোঁস কইরা ঘুমায়।”
সেই দিন তাদের বাড়ীর রাস্তায় সন্ধ্যে
পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল গৌরীমার টাটা সুমো গাড়ি। সাঁজ নামলে ঢুলতে ঢুলতে বাবা যখন ফিরছিল
বাড়ীতে গৌরীমা গাড়ি থেকে নেমে এসে বাবাকে ধরেছিল । আমি আর মা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি
মারছিলাম। কথা শেষে গৌরীমা গাড়িতে উঠে চলে গেলে খুশি খুশি মুখে বাবা মা কে বলল ...
-আমাদের কপাল খুইল্যা গেলো রে মালতি,আমাদের ফুলিরে গৌরীমার
মনে ধরসে তারপর আমার রুক্ষ চুল ঘেঁটে দিয়ে বাবা বলল…
-তোর এত পড়ার
শখ ফুলি,এই বার তোর শখ পুরলো । তোরে আমি শহরে গিয়া গৌরীমার বড় ইস্কুলে দিয়া আসব।
আজ সাতদিন হয়ে গেল এই বড় ইস্কুলে এসেছে ফুলি। প্রথম দিন বাবার
হাত ধরে ঢোকার সময় দেখেছিল বিরাট লোহার দরজাটার ওপর বড় বড় করে লেখা গৌরী অনাথ আশ্রম।
বাবা চলে গেলে গৌরীমা ফুলি কে মঙ্গলার হাতে তুলে দিতে দিতে বলেছিল...
-খুব লেখাপড়া করার শখ না তোর! তোর স্কুলের সেই সিড়িঙ্গে চশমাওয়ালি
দিদিমণি বলেছিল তুই নাকি সরস্বতীর মানসপুত্রী
তাই আজ থেকে তোর নাম সরস্বতী।
তারপর হাসতে হাসতে মঙ্গলা মাসীকে বলেছিল ...
_ এই ফুলি আজ থেকে সরস্বতী হলেও আমাদের জন্য কিন্তু সাক্ষাৎ
মালক্ষ্মী ,একে ভাল করে যত্নআত্তি কর মঙ্গলা,সরস্বতী পুজার রাতেই বিশ হাজারের বদলে
আমাদের ঘরে কড়কড়ে তিন লাখ টাকা এনে দেবে আমাদের মালক্ষ্মী ...
সুদীপ্তা বুয়া চট্টোপাধ্যায়: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন