প্রতিবেদন
এক
শিশুটির
বয়স ৫ মাস এগারো দিন। উচ্চতা ও ওজন স্বাভাবিক। চিকিৎসক বলেছেন, এখন থেকে মায়ের
দুধের পাশাপাশি শক্ত খাবার খাওয়াবেন। মা চাকুরে। মায়ের অবর্তমানে শিশুটির দেখভাল
করেন ছোট বোন। অফিসে যাবার আগে মা বুক নিংড়ে দুধ রেখে যান। মা যখন শিশুটিকে সরাসরি
বুকের দুধ খাওয়ান, তখন সে বিরক্ত করে না। যত বিরক্তি মা না
থাকলে! কান্না থামাতে শরীরে হাত বুলাতে হয়। বাঁশি বাজানো, খেলনা
দেখানো ও দোলনায় চড়ানো কত্তো কি চেষ্টা! অবশেষে বাসার টেলিভিশনের চাবি খুলে শব্দময়
ছবি দেখিয়ে শিশুটিকে খাওয়ানো আরম্ভ! মায়ের অবর্তমানে শুরু হলো শিশুকে খাওয়ানোর
অবিরাম প্রচেষ্টা। এভাবে চলতে থাকলো বেশকিছু দিন! বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ!
সন্তানের পরিচর্যায় বোনের ওপর পুরোপরি ছেড়ে দিলেন। মা মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচলেন!
তারপর শুরু হলো কৌটের দুধ, সেরিলাক আর খিচুড়ি খাবার। ২২ বছর
বয়সী বোন। গ্রাম থেকে এসেছেন। অভাবগ্রস্ত ও পরনির্ভশীল বোন মহানগরীর চাকচিক্যে
রঙিন পৃথিবী রচনা করার জন্য ঢাকায় আসা। চাকুরে সেজ বড় বোন শিক্ষা ও বিয়ের মাধ্যমে
তাকে সুন্দর জীবন দিবেন বলে তার সংসারে যুক্ত করেছেন। কিন্তু তা আর হয় না। তার
শিশু পুত্রের পরিচর্যার জন্যই ছোট বোনকে তার কাছে আনা। বোনের শিশু সন্তানকে পালন
করতে গিয়ে প্রায় সময়ই অমনোযোগী থাকেন তিনি। শিশুর কৃত্রিম খাদ্য খাওয়ানোয় টেলিভিশন
এবং শব্দময় চেঞ্জার ব্যবহার চলতেই থাকে। প্রশাসনে কর্মরত মা রাতে বাসায় ফিরেন।
ভোরে আবার ডিউটি। শিশুপুত্র কি খাচ্ছে তার স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা
এসবে তার নজর নেই খুব একটা। ভয়ে বোন শিশুটার অনেক বিষয়ই গোপন করেন। প্রায় সময়ই
শিশুটা খাবার বমি করে ফেলে দেয়। টেলিভিশন চালিয়ে ফের তা জোর করে খাওয়ানো হয়! এভাবে
কেটে যায় সোয়া ৩ বছর। প্রায়ই শিশুটার ঠা-া জ্বর এবং রক্তবমি হয়। এর মাত্রা যখন
প্রকট হলো তখন শিশুটিকে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসক বললেন ওর
খাদ্যে জীবাণু ঢুকেছে। ওষুধ দিলেন এক মাসের। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো না।
আড়াই মাস পর মা শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে গেলেন। নানা পরীক্ষা। শিশুটির
শরীর থেকে সব রক্ত বের হলো। তারপর মায়ের রক্ত প্রবেশ করানো হলো। ৩ দিন পর অন্যান্য
অঙ্গের পরীক্ষা করে জানা গেলো শিশুটি কানে কম শুনে এবং চোখে কম দেখে।
দুই
টেলিভিশনের
টম জেরি সিরিজ শিশুটির বেশ প্রিয়। ওটা দেখে বেশ হাসে! মজা পায়। হাসতে হাসতে মেঝেতে
লুটিয়ে পড়ে সে। মাত্র প্রায় চার বছরের শিশুটি টম জেরির মতোই বেশ উচ্ছল। তবে খাওয়ার
প্রতি অনীহা তার। ফলে উচ্চ শিক্ষিতা মা বেশ বিচলিত থাকেন। খাওয়ার সময় টেলিভিশনে
কার্টুন দেখা চাই তার। এই নিয়ে প্রকৌশলী বাবা বেশ রাগ করেন মায়ের ওপর। ‘সারাদিন কি
করো তুমি?একটা বাচ্চাকে মা-মেয়ে মিলে খাওয়াতে পারো না? বাবুকে
ড্রয়িং রুমে নয়,ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে খাওয়াবে।’ভদ্রলোকের স্ত্রীর এই সন্তান প্রসব হওয়ার ২ মাস আগে থেকেই শাশুড়িকে বাসায়
নিয়ে এসেছেন। নাতিকে শক্ত সামর্থ্য করবেন! শাশুড়ি থাকেন কাছেই,একমাত্র ছেলের বাসায়। নাতি, মেয়ে আর উনি এই ৩ জনের
সবার টেলিভিশন দেখার অভ্যাস। নাটক ও চলচ্চিত্র তাদের দু’জনের
প্রিয় আর শিশুটির কার্টুন। টিভিতে কার্টুন দেখে দেখে খাওয়ার অভ্যাস শিশুটির। এটা
কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না। এ নিয়ে ম্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায় সময়ই ঝগড়া লেগে
থাকে। কার্টুনপ্রিয় শিশুটা বড় হতে থাকে। কিন্তু টেলিভিশনে কাছ থেকে কার্টুন দেখা
তার কমে না! খাওয়া ছাড়াও সে দিনের বেশিরভাগ সময় টিভি দেখায় মশগুল থাকে। বয়স যখন
সাড়ে ৪ হলো তখন তাকে স্থানীয় বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো।
বাবা ছুটির দিনেই ছেলেকে লেখাপড়া করান। অধিকাংশ সময় মা-ই ছেলেকে বিদ্যালয়ে আনা
নেয়া করেন। লেখাপড়ার বাড়ির কাজ তৈরিতে সহায়তা করেন। শ্রেণিশিক্ষিকা একদিন
অভিভাবিকা মাকে তলব করেন। বললেন, আপনার ছেলে শ্রেণিকক্ষে বেশ
অমনোযোগী। খেয়াল রাখবেন। শিক্ষিকা আরেকদিন বললেন, প্রথম
সারিতে বসেও আপনার ছেলে খাতায় লিখতে পারে না। এ অভিযোগ একাধিকবার করলেন তিনি।
ভদ্রমহিলা
বাসায় এসে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন সে বাড়ির কাজ খাতায় লিখে আনে না? ছেলে বললো,
সে বোর্ডের লেখা দেখতে পায় না! এরপর চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে
ছেলেকে নিয়ে জানতে পারলেন ছেলের ২টি চোখেই দৃষ্টিশক্তি কম। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন
চশমা দেয়া হলো। ছেলেটি এখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। শুরু থেকেই চশমা ব্যবহার করায়
সহপাঠীদের কাছে ও হাসির পাত্র! বিদ্যালয়ের প্রায় সবাই ওকে বলে ‘ভারী ফ্রেম অর্ক’।
তিন
ছেলেবেলার
বন্ধুর বোনের বাসায় গিয়েছি ক’দিন আগে। সাহেব বিদেশে জনশক্তি রফতানি করেন।
বন্ধুভগিনীর ২ ছেলে ও ২ মেয়ে। সবাই বয়সে পিঠেপিঠি। রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। বাসার
বৈঠকখানাটি বেশ বড়। সে ঘরের বসার আসনে দশ বারো জন আরামে বসতে পারে। বিলাসবহুল
সোফা। এক পাশে কুশনের পরিপাটি বিছানা। তাতে ৫ থেকে ৭ বছরের ৪টি ছেলেমেয়ে। নুশরাত,
আদিবা, রুবায়াত ও সোহান। সোহান ও আদিবার কাছে
ট্যাব। বাকী দু’জনের হাতে দামী স্মার্টফোন। সবাই মগ্ন তড়িৎ
প্রকৌশল যন্ত্রের ছোট পর্দায়। প্রায় সর্বোচ্চ মাত্রার উজ্জল আভায় নেশায় মত্ত ওরা।
নিমগ্ন দৃষ্টি দেখে মনে হলো ওরা যেন বিশাল কিছু সৃষ্টি করতে চলেছে! আমার হতচকিত
মুখাবয়ব দেখে আপা চমকে গেলেন বোধ হয়! পাশে সোফায় বসে বললেন ‘আর
বলো না বেশ অশান্তিতে আছি এদের নিয়ে! স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই ট্যাব আর মোবাইল।
প্রায় সারাদিনই টিপাটিপি!’ না দিলে খাবে না। জিনিস ভাঙচুর
করে।
বললাম,কি দেখে ওরা বেশ
মনযোগে?
‘কার্টুন
আর ফানি ভিডিও!’-আপার সপ্রতিভ উত্তর। মিরপুরেও খেলার মাঠ নেই এখন। সারি সারি সুউচ্চ ইমারত।
ফাঁকা পেলেই দালান তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কোথায় খেলবে বাচ্চারা? প্রায়
সারাদিনই বাসার চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকে ওরা ! আর ফার্স্ট ফুড। কথাগুলো
বন্ধুভগিনীর। আমি বললাম, আপা অপরিপক্ক বয়সে ওদের হাতে ‘ট্যাব’ ও ‘অ্যান্ড্রয়েট’
ফোন না দিলেইতো পারেন? ওদের জীবনতো বিপর্যয়ের
দিকে ঠেলে দিচ্ছেন! শিশুদের এসব যন্ত্রের রেডিয়েশন মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাত আনতে
পারে!আপা আমার কথার খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না। শুধু বললেন ‘বুঝিতো সব কিছুই এখন
কি করুম।’দেশের সমাজ ব্যবস্থার এই তিনটি সংসারের বাস্তব
ঘটনাচিত্রে প্রতীয়মান হয় শিশুর সুষম মানসিক বিকাশে টেলিভিশন ও সেলফোন বড়
প্রতিবন্ধক! বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী কমিশনের (বিটিআরসি) গত সেপ্টেম্বর
মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ভ্রাম্যমাণ
ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৫ কোটি ৩০ লাখ। একজন
গ্রাহকের নামে গড়ে তিনটি সিম থাকলে দেশে ভ্রাম্যমাণ ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ৫
কোটি ১০ লাখ। বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৮
বছরের কম শিশু কিশোরদের ভ্রাম্যমাণ (মোবাইল) ফোন ব্যবহার নিষেধ। কিন্তু আমাদের
দেশে এ নিষেধাজ্ঞা কেউ মানছে না। বয়স বাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন অ্যাপসে
হিসাব খুলছে আমাদের শিশু ও কিশোররা। স্মার্টফোন, ট্যাব এবং
ডেক্সটপ কম্পিউটারে তারা দিনের বেশির ভাগ সময় ফেসবুক, ইমো,
ভাইবার, স্কাইপি, ইনস্টিগ্রাম,
হোয়াটস আপ ইত্যাদিতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আজকাল শিশু ও কিশোররা
শ্রেণিকক্ষে ঝিমায়। এর কারণ রাত জাগা।
ভারতের
জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দি হিন্দু’সংবাদপত্রে ২০০৮ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত হয়
শিশু-কশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ভয়াবহ দিক! সে দেশের টেলিযোগাযোগ প্রকৌশল
কেন্দ্রের এক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সে ফলাফল উল্লেখ করে দি
হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভ্রাম্যমাণ
(মোবাইল) ফোন থেকে নির্গত বিকিরণ (রেডিয়েশন) স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ায়।
মোবাইল এন্টিনার বেস কেন্দ্র থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক
রেডিয়েশন অর্থাৎ তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ মোবাইল ফোনে ঢুকে। এ ফোন থেকে নির্গত বিকিরণ
সবচেয়ে ক্ষতি করে শিশু থেকে ১৬ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের। রাজধানীতে কোয়ান্টাম
ফাউন্ডেশন আয়োজিত সচেতনতামূলক এক বক্তৃতামালায় সম্প্রতি দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক
নাক কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত এ বিষয়টিকে তুলে ধরেন। তিনি
বলেন, অনুপাত ও শতকরা হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ
মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী দেশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) একাধিক সমীক্ষার সাম্প্রতিক ফলাফল দেখাতে গিয়ে তিনি
বলেন, মোবাইল ফোনে এক নাগাড়ে ২০ সেকেন্ডের বেশি কথা বলা উচিত
নয়। এতে কানের সমস্যা হতে পারে। মস্তিষ্ক ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। মোবাইল ফোন
দেখিয়ে বাচ্চাদের না খাওয়ানোর জন্য তিনি অভিভাবকদের পরামর্শ দেন। ডাঃ প্রাণ গোপাল
দত্ত বলেন, শিশুরা যে খাবার খাচ্ছে ‘ট্যাব’
ও ‘অ্যান্ড্রয়েট’ ফোন
দেখে, তাতে তার পুষ্টি নষ্ট করে স্বাস্থের ভয়ানক ক্ষতি করছে
মোবাইল ফোনের বিকিরণ! দেশের নতুন প্রজন্ম মানে ভবিষ্যৎকে আমরা নষ্ট করে চলেছি।
শিশু কিশোরদের সুস্থ মানসিক বিকাশে ‘ট্যাব’ ও ‘অ্যান্ড্রয়েট’ ফোন বা
মোবাইল ফোনের বিকিরণজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান নাক
কান ও গলা রোগের এই খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ ।
প্রণব মজুমদার: কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন