আবদুল্লা আবু সায়ীদের শাড়ীকথা




বিবধ 


শাড়ি নিয়ে আবদুল্লা আবু সায়ীদ স্যারের লেখাটি পড়লাম।  অনেকের কাছেই তিনি একজন অসম্ভব প্রিয়  আলোকিত মানুষ। একটি দুটি নয় কয়েকটি প্রজন্মের চিন্তা চেতনার প্রবহমানতাকে তিনি সমৃদ্ধ করে চলেছেন। এটা  অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময়ে অসাধারণ উপস্থাপনায়, বাকনৈপুণ্যে তিনি এ দেশে  অদ্বিতীয়, অনন্য গুণ এবং মেধাসম্পন্ন একজন মানুষ। শাড়ি নিয়ে তাঁর একটি লেখার কারণে সারা দেশে এতটা  প্রতিক্রিয়া হয়েছে দেখে বেশ খারাপ লেগেছে। এতটা বাড়াবাড়ি করার আসলে তেমন কিছু নেই। দেখতে হবে কোথায় তিনি লেখাটি লিখেছেন , তিনি শাড়ি নিয়ে লেখাটি লিখেছেন সাহিত্যের পাতায় , এটা  কিন্তু নিউজ নয় , এটা হল লেখার মাধ্যমে একান্তই একটি শিল্প-নির্মাণ , শিল্প-নির্মাণে যুগে যুগে কবি সাহিত্যিক এবং লেখকেরা নানাভাবে সৌন্দর্যের উৎস নিয়ে ভাবেন , নিজের চিন্তাকে বিকশিত করেন। এটা একটি শিল্পের নান্দনিক দিক; যেমন ,আমরা কালিদাসের মেঘদূত পড়েছি, আলাওলের পদ্মাবতী পড়েছি। ভারতবর্ষের শিল্পনির্মাণের ঐতিহ্য খুঁজতে গেলে বহু ভাস্কর্যের পরিচয় পেয়েছি যা অসাধারণ মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম।  এ সমস্ত শিল্পনির্মাণের পেছনে নারীর সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে যে শিল্পনির্মাণ সেটাকে শিল্পের নান্দনিক প্রকাশ বলে আমরা এতকাল জেনে এসেছি। এসব বিবেচনায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এ লেখাটি এমন কিছু অশ্লীলতাকে উসকে দেয়নি। তবে আধুনিক যুগের নারীরা পোশাক হিসেবে শাড়িটাকে প্রায় ছেড়েই দিতে চাচ্ছেন , সেটা নিয়ে তিনি ভেবেছেন , যেহেতু শাড়ি আমাদের নারীর সৌন্দর্য বিকাশের অন্যতম উপকরণ, শাড়ি পরা ছেড়ে দিলে পুরুষের চোখে নারীকে দেখার এবং আবেগতাড়িত হবার সুযোগ সংকুচিত হয়। আবার অপরপক্ষে নারী সবসময়ই নিজের সৌন্দর্য বিকাশে এবং নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী হসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সেটা কি অস্বীকার করার মত? তাহলে দেশের এত প্রসাধনী কোম্পানি এবং বিউটি পার্লারগুলো কী করছে ? 

নারীর শরীর হল সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কর্ম। সেই শরীরখানি ঢেকে রাখার জন্য এবং একই সঙ্গে বিকশিত করার জন্য  শাড়ি পরিয়েছে পুরুষ। পুরুষই আবার শাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে বয়নশিল্প, কারখানা মিল, ইন্ডাস্ট্রি। এসব শিল্পের বিকাশের সঙ্গে পুরুষের ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জনের অভীপ্সা।  নারী একটুকরো লম্বা  দৈর্ঘের কাপড়কে শরীরে তুলে নিয়েছেন লজ্জা নিবারণের উপায় এবং উপকরণ হিসেবে। এই পোশাকের প্রকৃত চেহারা পূর্বে এমন ছিল না। যুগে যুগে পুরুষ তার ব্যবসার উপকরণ  হিসেবে এই শাড়ির সৌন্দর্য বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। মূলত  নারীর সৌন্দর্যকে ঘিরে পুরুষ চরিত্র নিজেদের জীবন জীবীকার এবং নিজের যে কোনো রকমের শৈল্পিক সত্তাকে বিকশিত করে রুচিবোধের উন্মাদনার উপকরণ তৈরি করেছে। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের  ইতিহাস আমাদের জানা।  নারী ছাড়া কোনো শিল্প সাহিত্যই পুরুষের মনে ঔৎসুক্য সৃষ্টি করতে পারেনি বলেই , এবং পণ্যায়ন সম্ভব নয় বলেই প্রতিটি পণ্যের নেপথ্যে আছে নারীর বিকশিত  সৌন্দর্য  অথবা প্রস্ফূটিত যৌবনের হাতছানি। যাকে বলা হয় যৌনাবেদন।

 আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যা লিখেছেন সেটা সেই সত্যেরই প্রকাশ।  তবে বাংলাদেশে বাঙালির নানা রকম চিন্তাচেতনার ধারায় সব শব্দ সবাই গ্রহণ করার মত মানসিক সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি। এটা  এমন কোনো শব্দ নয় যে এতটা প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন আছে। এই শব্দটির অর্থ হল আকর্ষণীয়, রমণীয় , রমণীয় বললে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারত না। কারণ রমণীয় শব্দটি নিয়ে কারো আপত্তি নেই। আপত্তি হল যৌনাবেদনে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে শাড়িতে যে কোনো অনুষ্ঠানে নারীদের রূপের প্রকৃত সৌন্দর্য বিকশিত হয়। নারীর সৌন্দর্য এবং প্রকৃতিতে বসন্তের সৌন্দর্যের একটি অন্তর্নিহিত অর্থ আছে যা কবি সাহিত্যিকদের সবসময় মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। বসন্ত যেমন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে নারীও তেমনি রমনের মাধ্যমে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। তাই রমণ শব্দটির এত গুরুত্ব।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা পড়ে এই বিষয়টির একটি ধারণা পাওয়া যায়।  রমণী শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রমণের সম্পর্ক। আমাদের নারীরা জেনে না জেনে রমণী শব্দটি মেনে নেয়। সে শব্দটি আসলে  পুরুষের রমণের বা রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। আমরা নারীরা কি কখনো বলেছি আমরা রমণী নই আমরা নারী ? একই সঙ্গে দেখা যায় জনক জননী শব্দের অর্থগত বিষয়টা কী? জনন করে যে সে পুরুষ হলে জনক আর নারী হলে জননী যদি এই জনন কর্মের মাধ্যমে সন্তান হয়। সুতরাং দেখা যায় শব্দের গ্রহণযোগ্যতার হেরেফেরে আমাদের কথার অন্তর্নিহিত ভাব বদলে যায় , অনেক সময় যা বলতে চাই বা যা বোঝাতে চাই সেটা না বুঝিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়।   নারীও নিজেকে সবার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। প্রার্থিত পুরুষের কাছে রমণীয় করার জন্য চিত্রাঙ্গদার আকুলতার মধ্যে নিহিত রয়েছে নারীর সেই রমণের সক্রিয় আত্মনিবেদনের কথা, যা প্রকৃতির ধর্ম। শাড়ি হল নিজেকে বিকশিত করার সেই উপকরণ। যার মাধ্যমে নারীর সৌন্দর্য বিকাশে বসন্তের সেই ভূমিকা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যে বিষয়ে বলেছেন, শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই রমণীয় এলাকা বিভাজনের অনুপাত শারীর রচয়িতারা কি জেনে না না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।“ 

তবে একথাও সত্য যে বাঙালি নারীকে দেখার এই যে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক একটি ক্রমবিবর্তনের রূপ আমরা দেখি তাতে বোঝা যায় নারীকে দেখার যে দৃষ্টিটাই আলাদা। নির্মম সত্য এটাই যে, পুরুষের দৃষ্টিতে যৌনতার ঔৎসুক্যই লুকিয়ে থাকে । আবদুল্লা আবু সায়ীদ স্যার আসলে সেই সত্য কথাটা এই বয়সে এসে  আর গোপন করতে পারেননি , বলে দিয়েছেন। হয়তো কথা বলতে বা লিখতে গিয়ে এখানেই তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি একজন পরিশীলিত মানুষ, রাজনীতির বাইরে থেকে এতদিন ধরে তিনি যত সুন্দর করে কথা বলে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন এত প্রবল মনোযোগ আর কেউ আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। আমার কিন্তু স্যারের একটি কথা খুব নান্দনিক মনে হয়েছে, যখন তিনি বলেছেনঃ  “শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।“

জাহিদা মেহেরুননেসা : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন