রাস উৎসব



প্রতিবেদন


রস কথাটি থেকেই রাস কথাটির উৎপত্তি।  রস অর্থে সার বা নির্যাস বা আনন্দ বোঝায়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে(২/৭)) রসকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মূলত মধুর রসকে বোঝায়। আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন এই মধুর রসের আধার। তাই তাকে ঘিরেই রাস উৎসবের সূচনা বৈষ্ণবীয় দর্শনে। বৈষ্ণবদের কাছে রাস হল ভক্ত ও ভগবানের মিলন উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে  সনাতন বৈষ্ণব ভাবধারার ধর্মীয় উৎসব। ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মধুর রসকথাকে জীবাত্মার মধ্য দিয়ে পরমাত্মায়, দৈনন্দিন জীবনের আবেগ অনুভুতিকে প্রেম ও আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত করে জগতের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। পদ্মপুরাণে (৫২/১০৩-১০৫) শারদরাস ও বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়) বাসন্তীরাস এবং শ্ৰীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে (৫/১৩/১৪-৬১) শুধুমাত্র শারদরাসের বর্ণনা আছে। হরিবংশে ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাঁকে "রাস" নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুপুরাণের মতে, কৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপরমণীদের সঙ্গে। শ্ৰীধর স্বামী বলেছেন, বহু নৰ্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষের নাম রাস– “রাসো নাম বহু নৰ্ত্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।” শ্ৰীমদ্ভাগবতের অন্যতম টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, —“নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তন্ময়ী যা ক্রীড়া বা রাসক্রীড়া”। শ্ৰীমদ্ভাগবতের মতে, কৃষ্ণ যোগমায়াকে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন পুণ্য বৃন্দাবনে।।"

শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ আপনাপন কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন; বলেন, তাঁদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন। ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাঁদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের অধীন বলে ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হল, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। ভগবানকে ‘একমাত্র আমার’ বলে ভেবে অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাই তাঁকে কোনো মায়া-বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। তখন গোপিনীবৃন্দ একাগ্রচিত্তে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাঁদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দও জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাসোৎসবের প্রচলন ঘটে।

নবদ্বীপের রাস------

কার্ত্তিকী পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত নবদ্বীপের সেরা লোকায়ত উতসব হল রাস। এখানে ভরা পূর্ণিমার রাতে বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে বিশাল বিশাল ও শতাধিক শাক্তমূর্তির সাড়ম্বরে পূজা করে শক্তি আরাধনা করা হয়।  এখানকার রাসে তন্ত্রাচারের পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায়।

-------উৎস-----------
নবদ্বীপের রাসের উৎস সন্ধান করতে গেলে চলে আসে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কথা। তার রাজত্বকালে(১৭২৮-৮২)ই রাসের বাড়বাড়ন্ত পরিলক্ষিত হয়। রাজা অনেক জনকল্যাণকর কাজ করতেন। তিনি বহু মঠ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, বারোদোল মেলা, জগদ্ধাত্রী পূজাও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রবর্তন করেছিলেন। তার সময়েই নবদ্বীপের রাস অন্য মাত্রা পায়।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজে শাক্ত ছিলেন। তিনি নদীয়া,  অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ ও উলা এই চারসমাজের সমাজপতি ছিলেন। তিনি চাইতেন শুদ্ধাচারে শাক্তসাধনা হোক। তিনি চৈতন্যবিদ্বেষী ছিলেন না কিন্তু চৈতন্যদেবকে অবতার রূপে পূজার ঘোর বিরোধী ছিলেন। চৈতন্যদেবের অনুগামীরা ব্রাম্ভণ্যস্মতি মানতেন। এটা রাজা পছন্দ করেননি। তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপের শাক্তমূর্তির পূজাকে আরো উতসাহ দেন। মূলত রাজানুগ্রহেই নবদ্বীপের রাস ছাড়িয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে। তবে রাজানুগ্রহ পাওয়ার আগেই কালীমূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। শাক্ত ঐতিহ্য অনুসারে বঙ্গদেশ ছিল  তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান,  দ্বাদশ -ত্রয়োদশ শতক থেকেই সমগ্র বাংলায় তন্ত্রসাধনার বিকাশ ঘটে। ব্রাক্ষ্মণ্যসংস্কৃতির দাপটে মানুষ তন্ত্রকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তখন তন্ত্রসাধকরা নিষ্ঠাসহকারে নিয়মনীতি মেনে দেবতার উপাসনা করতেন। কথিত আছে নবদ্বীপের বিশিষ্ট তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের(জন্ম ১৬০০ খ্রী:) তন্ত্রসার গ্রন্থরচনার পর কালীপূজার প্রসার ঘটে, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত "কালী সপর্যাবিধি" গ্রন্থ থেকে জানা যায় বাংলাদেশে তখনও তেমনভাবে কালীপূজার প্রসার ঘটেনি। কয়েকটি মাত্র ছিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রত্যক্ষ পোষকতায় ব্যাপকভাবে কালীপূজার প্রসার ঘটে। গঙ্গার ভাঙনে বিপর্যস্ত নবদ্বীপ সংলগ্ন ভাগীরথীর অপর পাড়ে অবস্থিত ফুলিয়া পাহাড়পুরে তিনটি শাক্তপূজার প্রচলন ঘটেছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বদান্যতায়।

নবদ্বীপের রাস উৎসবের সূচনা হয়ে যায় পাটা পুজোর মাধ্যমে। বিজয়া দশমী, লক্ষ্মী পুজো এবং কালী পুজোর দিন এই পাটা পুজো হয়। মহা ধুমধাম সহকারে মূল কাঠামোকে পূজা করা হয়। এরপরই ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু করা হয়। সাধারণত লক্ষ্মী পুজোর দিন বেশি আওয়াজ না করার রীতি থাকলেও নবদ্বীপে পাটা পুজোর সময় (লক্ষ্মী পুজোর দিন) বাজি, শব্দ বাজি ফাটানো হয়।

নবদ্বীপ রাস প্রতিমার ইতিহাস::
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলের এ্যালানে কালী :----
শক্তি উপাসক ভৃগুরামের উত্তরপুরুষদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ঢাকানিবাসী ভৃগুরাম ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে এসে ভাগীরথীর তীরে মহাশ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে শক্তি আরাধনায় ব্ৰতী হন, এই কালীর নাম এ্যালানে কালী। কথিত আছে, প্রখ্যাত পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ (জন্ম, আনুমানিক ১৭১৭ খ্রি.) যখন রাজসভার সভাপণ্ডিত তখন এ্যালানে কালী পূজার প্রবর্তন হয়েছিল।

বড় শ্যামা ----
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ৰ ভৃগুরামকে ১২০০ বিঘা জমি দান করেন। ভৃগুরামের তিন পুত্র এখানে বসতি স্থাপন করলে এই অঞ্চলের নাম হয় তেঘরি। ভৃগুরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র গদাধর তেঘরিপাড়ায় বড়শ্যামা মাতার পূজা প্রতিষ্ঠা করেন।

এই সময়ে চারিচারপাড়ায় ভদ্রাকালী পূজার সূচনা হয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায়। শোনা যায়, সেকালে রাজবাড়ি থেকে পূজা আসত, মহারাজের নামে সংকল্প হতো।

কুলিয়া তখন নদী ভাঙনে পড়েনি, ফলে পূজা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়নি। কুলিয়া গ্রামে এই তিনটি শক্তিপূজার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি এ্যালানে কালীর পূজা প্রাঙ্গণে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং এখানে অলোকনাথ শিবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশ্বরচন্দ্রও ছিলেন কৌলাচারী। তিনিও হাজার হাজার মণি নৈবেদ্য, বস্তু-খণ্ড এবং নানা উপাচারে কালী আরাধনায় ব্ৰতী থাকতেন।” তাঁর আমলে (১৭৮৮– ১৮০২ খ্রি.) প্রথম নবদ্বীপের মূল ভূখণ্ডে রাজাদের পোষকতায় শক্তি পূজার প্রচলন ঘটে। অন্তত তিনটি শক্তিপূজা প্রচলনের ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে আগমেশ্বরী পাড়ার মহিষাসুরমর্দিনী, হরিসভাপড়ার ভদ্রকালী এবং ব্যাদাঁড়াপাড়ার নৃত্যকালী (কুলিয়া-পাহাড়পুরে)। মহিষাসুরমর্দিনী পূজা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজপুরোহিত লক্ষ্মীকান্ত ন্যায়ভূষণ। সূচনা পর্বে এই শক্তিপূজাগুলি অনুষ্ঠিত হত অমাবস্যা তিথিতে। কারণ ভৃগুরামের মতো শক্তিসাধক এবং লক্ষ্মীকান্ত ন্যায়ভূষণের মতো খ্যাতিমান পণ্ডিত যখন দেবীপূজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন তা শাক্ত-ঐতিহ্য মেনেই করেছিলেন। সূচনা পর্বে এই দেবীপূজাগুলি রাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়নি, কারণ তখনও নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন ঘটেনি।

নদিয়ারাজ গিরীশচন্দ্র (১৮০২-৪২ খ্রি.) ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের প্রকৃত উত্তরসূরি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাংলার মাটিতে তন্ত্রাচারের যে বীজ বপন করেছিলেন, গিরীশচন্দ্রের উপযুক্ত পরিচর্য ও জলসিঞ্চনে তা হয়ে উঠেছিল মহীরূহ। গিরীশচন্দ্ৰ ছিলেন নিষ্ঠাবান তন্ত্রসাধক ও পরধর্মসহিষ্ণু। বৈষ্ণব-ঐতিহ্য অনুসারে তীর আমলেই নবদ্বীপে গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণবীয় মন্দির এবং সূচনা হয়েছিল উৎসব, অনুষ্ঠান ও চৈতন্যচর্চার। তাঁর আমলেই প্রচুর অর্থব্যয়ে হটহটিকা বাসন্তীপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রকাণ্ড মূর্তি নির্মাণ করে। শান্তিপুর সন্নিহিত সূত্রাগড়ে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন র্তারই কীর্তি। নবদ্বীপের রথযাত্রা ও দোলযাত্রায় তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। ব্যাদড়বংশের আদি পুরুষ রাজারাম পূর্ববঙ্গ থেকে নবদ্বীপে এসেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। বর্তমানে (২০০৫ খ্রিঃ অনুযায়ী) এই বংশের নবম পুরুষ আসীন। হিসাব অনুযায়ী ২৫×৯ = ২২৫ বছর আগে অর্থাৎ (২০০৫—২২৫) = ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তিনি নবদ্বীপে এসেছিলেন, এই তথ্যানুযায়ী ব্যাদাড়াপাড়ার শবশিবার প্রতিষ্ঠাকালও কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরকালে। কারণ রাজারাম নবদ্বীপে এসে প্রথমে ঘর গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন; বাসস্থান নির্মাণ, অন্নের সংস্থান প্রভৃতি বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পর তবেই তিনি শক্তিপূজা প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ক্ষেত্ৰ সমীক্ষা করে জানা যায় যে, ব্যাদাঁড়াবিংশের আদিপুরুষ রাজারাম কর্তৃক শব্বশিবার পূজা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গিরীশচন্দ্রের আমলে। মূর্তির অভিনব রূপ কল্পনায় সাংখ্যের ত্ৰিগুণাত্মিক প্রকৃতিতত্ত্ব এবং তন্ত্রের বিপরীত তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে এখানে। শবশিবা ছাড়াও তারই আমলে যেসব রাস প্রতিমা পুজোর সূচনা ঘটেছিল নবদ্বীপে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—নন্দীপাড়ার মহিষাসুরমর্দিনী, পুরাণগঞ্জ ও বুড়োশিবতলার বিন্ধ্যবাসিনী, মহাপ্রভুপাড়ার গোঁসাইগঙ্গা, দণ্ডপাণিতলার মুক্তকেশী, আমপুলিয়াপাড়ার শবশিবা, রামসীতাপাড়ার কৃষ্ণমাতা ইত্যাদি। আমপুলিয়াপাড়ার শব্বশিবা ছিলেন মহামহােপাধ্যায় শিতিকণ্ঠ বাচস্পতির ইষ্টদেবী। পুরাণগঞ্জ গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার পর এখানকার বিন্ধ্যবাসিনী উঠে আসে শ্ৰীবাস অঙ্গনে।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজা গিরীশচন্দ্রের পোষকতায় প্রবর্তন হয় রাস উৎসবের। সূচনাপর্বে পুজো হতো পটে, নাম ছিল পট-পূর্ণিমা’। পরবর্তী পর্যায়ে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে পূজো অনুষ্ঠিত হতো। এই সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্রের আমলে প্রবর্তিত কালীমূর্তিগুলির পূজার কাল পরিবর্তিত হয়ে কার্তিকী পূর্ণিমায় হয়েছিল এবং রাস উৎসবকে প্রাচীনত্ব প্রদান করেছিল।

রাসপর্বে শান্তিপুরে যেমন রঙ্গতামাসা এবং বহুলোকের সমাগম হয়, নবদ্বীপেও এই পূর্ণিমায় পটপূজা উপলক্ষে সেইরূপ সমারোহ হইয়া থাকে। নবদ্বীপের পটপূজা অতি প্রসিদ্ধ ব্যাপার। নামে পটপূজা কিন্তু বাস্তবিক ইহা নানাবিধ প্রতিমার পূজা। দশভূজা, বিন্ধ্যবাসিনী, কালী, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা প্রভৃতি দেবদেবীর মুর্তি গঠিত হয়।

বৈষ্ণব রাসের উদ্ভব এবং শাক্ত রাসের সাথে সংঘাতও হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মুষ্টিমেয় ভক্তিবাদীদের হাতে যখন বৈষ্ণবীয় ভক্তি আন্দোলন দানা বঁাধে তখন কৌলাচারী তন্ত্রসাধকদের সঙ্গে এদের শুরু হয় সংঘাত। প্রায় তিনশো বছর এই দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব ছিল অব্যাহত। নবদ্বীপের রাসেও পড়েছিল এর অনিবার্য প্রভাব। আজকের বাতাবরণ সম্পূর্ণ আলাদা, আজ আর কুটিল দ্বন্দ্বের লেশমাত্র নেই, নেই কোনও আবিলতা।

শর্মিষ্ঠা মুখার্জী : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন