প্রবন্ধ
দুই বাংলার সাহিত্য সমালোচকরা একটি বিষয়ে সহমত পোষণ করতে
বাধ্য হন কবি জীবনানন্দ দাশের পর থেকে কবি আল মাহমুদ এবং শামসুর রহমানের সময় কাল
থেকে বাংলা কবিতা চর্চার ধারা দুই বাংলায় দুই দিকে বাঁক নিয়েছে! বিষয়টি নিয়ে
যথেষ্ট বিতর্ক এর অবকাশ থাকলেও দুই বাংলায় পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী
সময়ের বাংলায় কবিতা চর্চার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এই সত্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান
হয়! এ বিষয়ে একটি আলোচনা সভায় পশ্চিমবঙ্গের সত্তর দশকের কবি কবি বীতশোক
ভট্টাচার্য 50 পরবর্তী দশকে দুই বাংলায় কবিতা চর্চার ধারা নিয়ে বলতে গিয়ে
বিষয়টি নিয়ে দিকনির্দেশ করলে তাতে সহমত পোষণ করতে বাধ্য হন বাংলাদেশের ষাটের
দশকের কবি কবি আসাদ চৌধুরী! বাংলাদেশের কবিরা বেশ কিছু মহৎ কালজয়ী কবিতা লিখেছেন!
কিন্তু মহৎ কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা হাতেগোনা! এই মহৎ কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলো পঞ্চাশের দশকের কবি আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’, ষাটের দশকের কবি
হেলাল হাফিজের ‘যে
জলে আগুন জ্বলে’ এবং
আশির দশকের কবি মজিদ মাহমুদের ‘মাহফুজামঙ্গল’! ‘আমি, আমার
সময় এবং আমার কবিতা’ নামক
প্রবন্ধে কবি আল মাহমুদ নিজে লিখেছেন,’ সোনালী কাবিন’ আধুনিক কাব্যধারায়
একটি স্বতন্ত্র বই! ৩০ এর কাব্য ধারার পরবর্তী কবিদের হাত দিয়ে এসেছে! মৌলিকতার
কথা আমি বলি না, কারণ
কবিদের মৌলিকতা নির্ধারিত হয় পাঠকের ভালোবাসার মধ্যে! পাঠকের ভালোবাসা ভাসা ভাসা
কোন কবিতায় থাকেনা, গভীরতর
শেকড় আছে যে কবিতায়, পাঠকের
ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত সেখানে এসে দাঁড়ায়! সমকালীন তর্কযুদ্ধ, কবির পারস্পরিক যুদ্ধ
শেষ পর্যন্ত কোন কাজে লাগে না! যে কবিতা মাটির শিকড় এর সাথে টান হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে, সেই
কবিতার কাছে কবিরা এসে দাঁড়ায়, পাঠকরা এসে দাঁড়ায়, মানুষের সমস্ত ভালোবাসা সেখানে এসে
দাঁড়ায়, কবিকে
জিতিয়ে দেয়! আমারও মনে হয় যে ‘সোনালী কাবিন’ পর্যন্ত আমার যে কাজ সেটা ঐ সমস্ত লড়াই, কবিদের ঝগড়াঝাটি, অধ্যাপকদের
কাব্যবিচার, সব
ছাড়িয়ে সোনালি কাবিনে এসে আমাকে জিতিয়ে দিয়েছে! এ বাংলার এক সাহিত্যিক বলেছিলেন
আল মাহমুদ তার সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য!
নিজের কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে এ ধরনের কমপ্লিমেন্ট শুনে কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন
সোনালী কাবিন একটা ভালো কবিতার বই! অনেক বড় বড় লেখক ও নোবেল পুরস্কার পাননি!
সবার ভাগ্যে এর শিকে ছিঁড়েও না! এমন অনেক লেখক ও আছেন যারা এমন একটা সময় নোবেল
পুরস্কার পেয়েছেন যখন তার ছাত্র বা শিষ্যরাই হয়তো তার আগে পেয়ে গেছেন! তিনি পরে
পেয়েছেন! আবার অনেকে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন! নোবেল পুরস্কার পাওয়া
না পাওয়ার উপর বিশ্ব সাহিত্য নির্ভর করে না! তবে নোবেল পুরস্কার আমাদের কিছু কিছু
সাহিত্য কে চিনতে সাহায্য করে! কবি আল মাহমুদের কলকাতা থেকেই সোনালি কাবিনের ১৪ কয়েকটি
সনেট নিয়ে একটি ছোট পকেট বই বের হয়! পরে ওই ১৪ কয়েকটি সনেট এবং আরো কিছু কবিতা
দিয়ে সোনালী কাবিন নামে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বের হয়! সনেট গুলি প্রকাশিত
হওয়ার পরই কেবল যে আলোড়ন তুলেছিল তা নয় শুরু হয় তুমুল আলোচনা! পত্রপত্রিকায়
সেই আলোচনা বিরামহীনভাবে চলে প্রায় চার দশক ধরে! এমন আশ্চর্য সফল পংক্তিমালা জন্ম
কথা শোনাতে গিয়ে সদ্য প্রয়াত কবি আল মাহমুদ লিখেছিলেন, একদা প্রেমের কবিতা
লেখার ইচ্ছাতেই আমি সোনালী কাবিন এর সনেটগুলো লিখে ফেলি! একটা বই ৪০ বছর ধরে
সমাদৃত হচ্ছে এর সনেটগুলো পড়ে আজও পাঠক আপ্লুত হচ্ছেন একজন কবির জন্য এর চেয়ে
বড় পাওনা আর কি হতে পারে! কবিতার জন্য ছুটে বেড়িয়েছি কত না চরাচর এ ঘাট ও ঘাট!
সোনালী কাবিন নামে সনেটগুলো যখন লিখি তখন প্রবল এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম! থাকতাম
চট্টগ্রামের বোরখা ডাক্তার লেনের একটি বাড়ির চারতলায়! একাই থাকতাম! পাশেই থাকত
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরা! তাদের কালচার টাই ছিল আলাদা! চলাফেরা পোশাক-আশাক সবই
আলাদা রকমের! নিজেদের বাইরে সাধারণত তারা কারও সঙ্গে মিশতে না কিন্তু আমার সঙ্গে
বেশ ভাব ছিল! মাঝেমধ্যে তাদের অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করতো খাওয়াতে চেষ্টা করতো
এটা সেটা! তারা মাহমুদ উচ্চারণ করতে পারতো না তাই আমাকে ডাকত মেহমুদ নামে! তারা
বলত মেহমুদ ইজ দ্যা পোয়েট গ্রেট পোয়েট! এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরা দেখা হলেই
আমাকে বলতো পোয়েট ওহে পোয়েট! জবাবে আমি বলতাম ইয়েস মাদাম! আসলে তারা আমাকে
পছন্দ করতো! আমিও যেতাম তাদের কাছে! মনে আছে প্রথমে একটানে আমি সাতটি সনেট লিখে
ফেলি! এরপর লিখি আরও সাতটি সনেট মোট ১৪ টি! কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও সোনালী
কাবিন সিরিজে এই 14 টির বেশি সনেট লিখতে পারিনি! তখন আমার মনে হয়েছিল এটা হয়তো
কোন দৈব ব্যাপার! সে সময় চট্টগ্রামে যারা আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন তাদের ছিল
বইয়ের ব্যবসা! ফলে আমার ঘরটি ছিল বইপত্রে ঠাসা! ঘরের একটু খালি জায়গায় ছিল একটা
চেয়ার ও একটা টেবিল! ওখানেই বসেই লিখতাম! ওই চেয়ার-টেবিলে লিখেছিলাম সনেটগুলো!
একদিন হঠাৎ ই লিখে ফেললাম সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে
পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি এক নম্বর সনেট টি! লেখার পর আমার সেকি উত্তেজনা ঘরের
ভিতরে পায়চারি শুরু করি,
নিজের
কবিতা নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়ি! এক একটি সনেট লিখতাম আর ঘরের ভেতর পায়চারি করতাম!
শেষ মুহূর্তের কথা বর্ণনা করা যাবে না! আর এখনতো বয়সের ভারে আমার স্মৃতি বিস্মৃতি
সবই একাকার! তাই অনেক কিছু এখন আর মনে করতে পারি না! সনেট আঙ্গিকে আমি প্রেমের
কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম! এজন্য আগেই এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি! প্রথমে ৮ পরে ছয়
লাইন সনেটের এইযে ফ্রম একসময় ইতালিয়ান বেদেরা এভাবে গান গাইতেন! তাদের বলা হত
ত্র বাদুড় র! তারা যাযাবর ছিলেন বেদেদের গান কে কবিতার ফর্ম এ প্রথম রূপ
দিয়েছিলেন পেত্রার্ক! এরপর অনেকেই এ ধারায় লিখেছেন! কিটস ও লিখেছেন এই ধারায়!
বাংলা ভাষায় ও অনেকে লিখেছেন সার্থক হয়েছেন! মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেট চৌদ্দ
মাত্রার! এর অনেক পরে আমি লিখলাম সোনালী কাবিন! লেখার পরই মনে হয়েছিল সনেটগুলো
বাংলা সাহিত্যে আমাকে অমরতা এনে দেবে! আজ দেখি আমার ধারণা বেঠিক নয় আশ্চর্যজনক
ভাবে সফল হয়েছে সনেটগুলো! সোনালি কাবিনের তখন আমি খুব সাহসের সঙ্গে কাবিন শব্দটি
ব্যবহার করেছি! আমার আগে বাংলা কাব্যে এ শব্দের ব্যবহার হয়নি!
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আল মাহমুদের সোনালি কাবিন কাব্যগ্রন্থকে অনন্য কাব্যগ্রন্থ বলে মনে করতেন এবং সেই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশে এরকম সনেট আর লেখা হয়নি! আর কবি সুবোধ সরকারের মতে, আল মাহমুদ একজন বড় কবি এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম আধুনিক কবি! শামসুর রহমান কে মাথায় রেখেই বলছি আল মাহমুদের মত কবি বাংলাদেশে আর জন্মায়নি! সাহিত্য সমালোচক আবিদ আনোয়ার তার ‘কবি আল মাহমুদ আধুনিকতায় লোকজ উপাদান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, আবহমান বাঙালি সমাজের নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য ঐতিহ্য, প্রাচীন বঙ্গ ভূমির সমাজ ব্যবস্থার ও আল মাহমুদের কালের বাঙালি সমাজের নানা বিসংগতি থেকে ফসলের সুষম বন্টন অর্থাৎ সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনা পর্যন্ত স্থান পেয়েছে কবিতাগুলোতে! অবশ্য 1,2,3,5,8,13 ও 18 নম্বর সনেটএ কেবলই রয়েছে এক নারীর প্রতি কবির ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতির প্রকাশ! আল মাহমুদের অন্যান্য প্রেমের কবিতার মতোই সোনালী কাবিন সনেটগুচ্ছে ও প্রেম প্রকাশিত হয়েছে নর নারীর সংসার জীবনের বাস্তবতার আলোকে! শরীরী প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় তেমন চোখে পড়ে না,
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আল মাহমুদের সোনালি কাবিন কাব্যগ্রন্থকে অনন্য কাব্যগ্রন্থ বলে মনে করতেন এবং সেই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশে এরকম সনেট আর লেখা হয়নি! আর কবি সুবোধ সরকারের মতে, আল মাহমুদ একজন বড় কবি এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম আধুনিক কবি! শামসুর রহমান কে মাথায় রেখেই বলছি আল মাহমুদের মত কবি বাংলাদেশে আর জন্মায়নি! সাহিত্য সমালোচক আবিদ আনোয়ার তার ‘কবি আল মাহমুদ আধুনিকতায় লোকজ উপাদান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, আবহমান বাঙালি সমাজের নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য ঐতিহ্য, প্রাচীন বঙ্গ ভূমির সমাজ ব্যবস্থার ও আল মাহমুদের কালের বাঙালি সমাজের নানা বিসংগতি থেকে ফসলের সুষম বন্টন অর্থাৎ সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনা পর্যন্ত স্থান পেয়েছে কবিতাগুলোতে! অবশ্য 1,2,3,5,8,13 ও 18 নম্বর সনেটএ কেবলই রয়েছে এক নারীর প্রতি কবির ব্যক্তিগত প্রেমানুভূতির প্রকাশ! আল মাহমুদের অন্যান্য প্রেমের কবিতার মতোই সোনালী কাবিন সনেটগুচ্ছে ও প্রেম প্রকাশিত হয়েছে নর নারীর সংসার জীবনের বাস্তবতার আলোকে! শরীরী প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় তেমন চোখে পড়ে না,
‘বিবসন
হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে হব চিরচেনা’!
কিংবা
‘চরের
মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়’!
অথবা
‘বাঙালি
কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানে না যা বাৎসায়ন আর যত আর্যের যুবতী’!
৪, ৯
ও ১১ নম্বর সনেটে কবির দয়িতার প্রতি তাঁর প্রেম প্রকাশের ভঙ্গিতেই মিথ ও
সাহিত্য-ঐতিহ্যের ব্যবহারে কবি যে-দক্ষতা
দেখিয়েছেন তা লক্ষণীয় :
পূর্বপুরুষেরা ছিলো পাট্টিকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব…
কী করে মানবো বলো, শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এই
শীলভদ্র নিয়েছিলো নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস…
সাম্যবাদের মতো রাজনৈতিক ভাবনাও অত্যন্ত শিল্পিতভাবে প্রকাশিত
হয়েছে ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১২ নম্বর সনেটে।
কাজী নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্য বাদে অন্যদের হাতে রচিত যেসব সাম্যবাদী
কবিতা আমাদের সাহিত্য-ভান্ডারে রয়েছে তার অধিকাংশই স্লে¬াগানসর্বস্ব
পদ্যস্তরের রচনা। সে-বিবেচনায় আল মাহমুদের এই কবিতাগুলোয় অত্যন্ত শিল্পিত
প্রকাশভঙ্গি লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় উদ্দিষ্ট নারী হয়ে উঠেছে অনেকটা
দেশমাতৃকার অনুরূপ :
ধ্রুপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড়
ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা;
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না-দেখার ভান করে কতকাল দেখবে চঞ্চলা…
লুলিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বারবার
বর্গিরা লুটেছে ধান, নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো, হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ…
৬ ও ১১ নম্বর সনেটে প্রকাশ পেয়েছে যথাক্রমে আমাদের মধ্যযুগ ও
বর্তমান কালের কবি-সাহিত্যিক তথা পন্ডিতসমাজের ভন্ডামি ও রাজনৈতিক চাপের মুখে
তাদের মেরুদন্ডহীনতার কথা,
যা
কবির ভাষায় ‘ফসলের
সুষম বণ্টনে’ ও
‘লোকধর্মে ভেদাভেদ’ দূর করতে প্রবল বাধা
হয়ে আছে :
পূর্বপুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল – রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার…
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝুলে আছে বিষণ্ণ বাদুড়,
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?--
বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাস,--
আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা…
আল মাহমুদের সমগ্র রচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সোনালি কাবিন
সনেটগুচ্ছ শুধু নয়, এই
কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য কবিতায়ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম ফসল ফলিয়েছেন তিনি।
কবি সুন্দরের পূজারী ছিলেন, নিজস্ব বাকরীতি নির্মাণে তিনি সেই
প্রকাশ রেখেছেন কাব্যে! নারীর শরীর –কথায়, বক্ষ বন্দনায় তার চিত্রকল্প নির্মাণ
পাঠক কে মুগ্ধ করে! চিত্তাকর্ষক এবং কামোদ্দীপক!
‘সিম্ফোনি’ কবিতায় লিখেছেন-
‘শঙ্খমাজা
স্তন দুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি’!
কখনো যোনির বিভার কথায় লিখেছেন- ‘
তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি
নরম গুল্মের কৃষ্ণ
সানুদেশ’
বা ‘আঘাত
থেকে আসবে ছেলেগুলো
নাভির নিচে উষ্ণ কালসাপ’!
সাহিত্যিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিশ্লেষণ, সেক্সের তিমির তীর্থ
অবিকল্প সোনালী কাবিন! 14 টি কবিতা, প্রতিটি কবিতায় 14 টি লাইন! এই
চতুর্দশপদী কবিতা গুচ্ছের একসঙ্গে নাম সোনালী কাবিন! সাবেক কুমিল্লা জেলার
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইল গ্রামের মোল্লা বাড়ির ভূমিপুত্র আল মাহমুদ
শুধুমাত্র এই 14 টি কবিতা লিখে স্থায়ী হতে পারতেন বাংলা সাহিত্যে! কবি আল মাহমুদ
কুণ্ঠাহীন লিখতে পারেন হৃদয়ের অলৌকিক অক্ষরে –
‘দেহ
দিলে দেহ পাবে, দেহের
অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি’!
ভালোবাসার যুবতীকে স্তনের উপর নখ লিখনের পদাবলী লিখে দেওয়ার
প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন,
‘বুকের
ওপর মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে লিখতে কি দেবে
নাম অনুজ্জ্বল উপাধি বিহীন’?
আল
মাহমুদের সোনালি কাবিন সেক্সের তিমির তীর্থ-
‘এ
কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ!
মনে হয় ডাক দিলে সে তিমিরে ঝাপ দিতে পারি
আঁচল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ’!
দরবিগলিত ছলকে যাওয়ার যৌন মিলনের অন্ধকার দ্রব্যতা পৌঁছায়
অপূর্ব রাগমোচনে! সঙ্গম কালের এই উত্তেজনা ও লিকুইডিটি কি সহজে খুঁজে পেয়েছে
অব্যর্থ শব্দের নিসর্গ! এই বুনোহংসীর বয়স কখনো 18 পেরোয় না! 18 বছরের মেয়েটি
উদোম হয় এই ভাষায় ‘পালক
উদাস করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম’! 18 বছরের মেয়েটির সঙ্গে সেক্স হয়ে ওঠে আদিম আদি রসের ফুটন্ত
প্রবাহ!
কলকাতায় কবি আল মাহমুদের সোনালি কাবিনের মিনিবুক সংস্করণ এর
প্রকাশক কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত মনে করেন, 14 টি সনেটের 4 নম্বর কবিতায় আল মাহমুদ
যখন লেখেন—
‘এ
তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো এই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়’—
তখন বুঝতে পারি আবহমানের বাংলাকে সেজে ধারাবাহিকতায় ধরতে
চেয়েছে, আমরা
প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে সেই উত্তরাধিকারের অংশীদার!
দেশজ ও চেতনা লোক কাহিনী ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও স্পন্দমান আবেগের
সৌন্দর্য আপ্লুত একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি হলেন আল মাহমুদ! সোনালি কাবিনের
সনেটগুচ্ছে মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বিদ্যমান অনুষঙ্গ
সমূহ! যা সোনালী কাবিন সনেটগুচ্ছে করেছে মহিমান্বিত এবং দিয়েছে অমরত্ব! বাংলা
কবিতার ভূবনে সোনালি কাবিনের মত মহাকাব্যিক কাব্যগ্রন্থ আর একটিও নেই! সোনালী
কাবিন সনেটগুচ্ছে কবি উপমা রূপক এর চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, বাংলাদেশের কবিতার
ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল! তার কবিতা স্পষ্টবাক প্রকৃতির মত
উন্মুক্ত ও স্বাভাবিক! বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে হলে আল মাহমুদের সোনালি
কাবিনের কবিতা পড়তেই হবে! আল মাহমুদ তার সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছে দেখালেন পূর্ব
বাংলার কবিতার মন-মেজাজ ও সত্তা আলাদা! আল মাহমুদের সোনালি কাবিনের সনেটগুচ্ছে
সুগভীর ঐক্য চিন্তায় মানবতাবাদী অভিনিবেশে দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ ক্ষত জর্জর
বাংলাদেশের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন যা সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থার সক্রিয় সজাগ
বিনির্মাণ!
তস্করের হাত থেকে জেওর কি পাওয়া যায় ত্বরা-
সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল!
পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিত সমাজ!
সোনালী কাবিন গ্রন্থে কবি একাধারে সাহিত্য বোধের তীক্ষ্ণতা
বিশ্লেষণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন! পাশাপাশি তার বৈচিত্র্য দামি মানুষ প্রবণতা মুখ্য
হয়ে উঠেছে! যা কবির অন্বেষার সেই গভীর ও ঐকান্তিক অভিব্যক্তির দ্যোতক! যা দেশকাল
ব্যস্ত জীবন পটভূমির অঙ্গীকারে তাৎপর্যপূর্ণ! সোনালী কাবিন কাব্যে সূক্ষ্মভাবে
একটি মতাদর্শে অবস্থান নিয়েছে!
‘শ্রমিক
সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা’!
সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থে কেবল ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছ এবং ‘তরঙ্গিত প্রলোভন’, ‘নদী তুমি’ এই দুটি কবিতা 18
মাত্রার অক্ষরবৃত্তে লেখা! অন্য গ্রন্থের তুলনায় এই গ্রন্থে সর্বাধিক মুক্তক
অক্ষরবৃত্ত আঙ্গিকের কবিতা রয়েছে! আল মাহমুদ তার অন্য কাব্যের মত এ কাব্যে শব্দের
মধ্য দিয়ে একের পরে এক ছবি এঁকেছেন! উপমা ও রূপকের মাখামাখি! শব্দ প্রতীক ও উপমার
মাধ্যমে আদিম ও তাকে চিত্রিত করেছেন! সেই চিত্র রোমান্টিক! সোনালি কাবিনের 10
নম্বর সনেটে লিখেছেন,
‘তারপর
তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে
যতটুকু অনুরাগ পারি
তারও বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ’!
চিত্ররূপময় তার লেখা! আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ বাংলা গীতিকবিতার
বিশাল ভুবনে যে কোন বিচারে এক মহাকাব্যিক কাব্যগ্রন্থ!
‘এখন
যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’
কবি হেলাল হাফিজকে বাস্তবে না চিনলেও সবাই তার রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার এ লাইন দুটির
সঙ্গে পরিচিত।বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮
সালে!মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে
বেঁচে গিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৯ সালে রচনা করেন
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি।
গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত এই কবিতাই তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে।তবে ১৯৮৬ সালে
প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত এই কাব্যগ্রন্থ হেলাল হাফিজকে ব্যাপক জনপ্রিয়
করে তোলে।একমাত্র কাব্য 'যে
জ্বলে আগুন জ্বলে'র
অভূতপূর্ব পাঠকপ্রিয়তায় কবি হেলাল হাফিজ কবিতার পাঠকের হৃদয়ে সুদৃঢ় স্থান করে
নিয়েছেন। প্রথম কাব্যের পর তিন দশকে তিনি লিখেছেন পরিমিত, তবে তাও বিপুলভাবে
পাঠকনন্দিত। আন্তরিক, গভীর
ও স্পষ্ট পঙ্ক্তিমালার কবি হেলাল হাফিজ প্রেমের কবিতায় অসামান্য এক নাম।
কবিতামগ্ন নিভৃত কবি হেলাল হাফিজ এক
সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন.,'যে
জলে আগুন জ্বলে'র
সাফল্য, খ্যাতি
আমার ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছে যে, আমি এর পর লিখতে বসলে হাত কাঁপে, বইয়ের কথা ভাবলে গা
শিউরে ওঠে।আমি আমার দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ 'বেদনাকে বলেছি, কেঁদোনা'র পাণ্ডুলিপি তৈরি
করার জন্য প্রায় দুইশ' কবিতা
নিয়ে বসেছিলাম সম্প্রতি। এই কবিতাগুলো ১৯৮৬ সালে 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হবার পর
লেখা। আমি নিজেই এই কবিতাগুলোর রচয়িতা।অথচ কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয় এতগুলি
কবিতার মধ্য থেকে আমি 56 টি কবিতা বাছাই করে উঠতে পারছিলাম না! আমার দ্বিতীয় বই
আমি এমনভাবে করতে চাইছিলাম,
যেন
প্রথম বইকে অতিক্রম করতে না পারুক, এর কাছাকাছি তো যেতে হবে।বইয়ের ৫৬টি
কবিতার অন্তত ৪০টি কবিতা পাঠকের মনন ও মগজে গেঁথে যাবে, 'যে জলে আগুন জ্বলে'র কবিতার মতো।কবি
হেলাল হাফিজ নাকি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ এত জনপ্রিয় হওয়ার ভয়ে আর কবিতার বই প্রকাশ
করেন নি। পরের কবিতাগুলো যদি জনপ্রিয়তা না পায়! এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করছেন
তিনি ‘অল্প
লিখে গল্প হয়েছেন’। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশের ২৬ বছর পর
২০১২ সালে প্রকাশ হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। তার
অন্যান্য লেখার মধ্যে রয়েছে- ‘ভালবেসো একশো বছর’, ‘বেদনাকে বলছি, কেঁদোনা’ এবং ‘আজ কবিতার জনসভা’।বলাই
বাহুল্য পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ গুলির কোনটাই 'যে জলে আগুন জ্বলে'র মতো জনপ্রিয়
হয়নি! কবি হেলাল হাফিজ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন,ষাটের দশকে আমরা যারা
লেখালেখি শুরু করেছি, আমি
বলব আমরা খুব সৌভাগ্যবান।এ সময়ে আমাদের এই ভূখণ্ডে খুব বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটে। ৬৯-এর
গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর
স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৭৫-এ
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা_ এগুলো আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রচণ্ড
প্রভাব-বিস্তারী ঘটনা। তখন আমরা টগবগে যুবক, যৌবনে পা দিয়েছি সবে। তো এই ঘটনাগুলো
আমাদের কবিতার রসদ হিসেবে,
সাপোর্টিং
ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। আর 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতাটি তো আমাকে রাতারাতি 'তারকা'খ্যাতি এনে দিল।
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না হলে এই কবিতাটি লেখা হতো না, আমিও মানুষের এত কাছাকাছি যেতে পারতাম
কি-না সন্দেহ হয়।আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। ৫৬টি কবিতার
একটি মাত্র বই।গত ৩০ বছর ধরে আমার এই কবিতাগুলো কেবলই মানুষকে প্রভাবিত করে চলেছে।
আমার যাপিত জীবনের চারপাশে যা ঘটছে, সেটা প্রেম-দ্রোহ-প্রতিবাদ-বিরহ-বিচ্ছেদ; যা-ই হোক না কেন, আমার এই ভূখণ্ডের
জনগোষ্ঠীর সব আবেগ-আকাঙ্ক্ষাকে, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে ধরতে চেষ্টা করেছি।'যে জলে আগুন জ্বলে' গ্রন্থের সব কবিতার
নিচে রচনাকাল দেওয়া আছে। সেই সময় ধরে ইতিহাসের
পাতা ওল্টালে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার কবিতা মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাইকে
অনুপ্রেরণা দিয়েছে, স্বৈরাচারবিরোধী
আন্দোলনে ব্যবহার হয়েছে, এমনকি
শাহবাগ আন্দোলনেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে আমার কয়েকটি কবিতা। আমার কবিতা ছাড়া
যেমন আন্দোলন হয় না, আমার
কবিতা ছাড়া তেমনি তরুণ-তরুণীর প্রেমও হয় না। ৩০ বছর পুরনো আমার এই বই, আমার এই অল্প কয়েকটি
কবিতা তিন তিনটি প্রজন্মকে ধরে রাখতে পেরেছে। এখানেই তো একজন কবির সাফল্য, এটাই তো একজন কবির
কামনা। আরও দূর ভবিষ্যতের পাঠকদেরও হয়তো আকৃষ্ট করবে আমার কবিতা।কবিতা দিয়ে
বিত্ত-বৈভব করব আমি এমনটা কখনও ভাবিনি। সবাই তো টাকা জমায়।আমি কবিতা দিয়ে মানুষ
জমাতে চেয়েছি।'যে
জলে আগুন জ্বলে' কাব্যগ্রন্থের
স্মরণীয় উল্লেখযোগ্য পঙক্তিগুলি পাঠ করলে কবির কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়—
‘মানব
জন্মের নামে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই!’ (দুঃসময়ে
আমার যৌবন)
‘জননীর
জৈবসারে বর্ধিত বৃক্ষের নিচে
কাঁদতাম যখন দাঁড়িয়ে
সজল শৈশবে, বড়ো সাধ হতো
আমিও কবর হয়ে যাই,
বহুদিন হলো আমি সেরকম কবর দেখি না
কবরে স্পর্ধিত সেই একই বৃক্ষ আমাকে দেখে না!’
(বেদনা বোনের মত)
‘ইচ্ছে
ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো!---
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে!’ (ইচ্ছে ছিল)
‘আমাকে
স্পর্শ করো, নিবিড়
স্পর্শ করো নারী!
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি
তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার!
আমাকে উদ্ধার করো পাপ থেকে,
পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতন থেকে!
নারী তুমি আমার ভিতরে হও প্রবাহিত দুর্বিনীত নদীর মতন,
মিলেমিশে একাকার হয়ে এসো বাঁচি
নিদারুণ দুঃসময়ে বড়ো বেশি অসহায় একা পড়ে আছি!’ (দুঃখের আরেক নাম)
‘আমি
এখন ভিন্ন মানুষ অন্যভাবে কথা বলি
কথার ভেতর অনেক কথা লুকিয়ে ফেলি,
কথার সাথে আমার এখন তুমুল খেলা
উপযুক্ত সংযোজনে জীর্ণ শীর্ণ শব্দমালা
ব্যঞ্জনা পায় আমার হাতে অবলীলায়,
ঠিক জানি না পারস্পরিক খেলাধূলায়
কখন কে যে কাকে খেলায়!’ (তোমাকে চাই)
‘একবার
ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,
কতো হুলুস্থূল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার!---
তুমি ডাক দিলে
সীমাহীন খাঁ খাঁ নিয়ে মরোদ্যান হবো,
তুমি রাজি হলে
যুগল আহলাদে এক মনোরম আশ্রম বানাবো!’ (তুমি ডাক দিলে)
‘অত
বেশি নিকটে এসো না তুমি পুড়ে যাবে,
কিছুটা আড়াল কিছু ব্যবধান থাকা খুব ভালো!
বিদ্যুৎ সুপরিবাহী দুটি তার
বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যতোটুকু দূরে থাকে
তুমি ঠিক ততোখানি নিরাপদ কাছাকাছি থেকো
সমূহ বিপদ হবে এর বেশি নিকটে এসো না!’ (ব্যবধান)
‘কোনো
প্রাপ্তিই পূর্ণ প্রাপ্তি নয়
কোনো প্রাপ্তি দেয় না পূর্ণ তৃপ্তি
সব প্রাপ্তি ও তৃপ্তি লালন করে
গোপনে গহীনে তৃষ্ণা তৃষ্ণা তৃষ্ণা!—
তবু বেঁচে আছি এক নিদারুণ সুখে
অনাবিষ্কৃত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বুকে
অবর্ণনীয় শুশ্রূষাহীন কষ্টে
যায় যায় দিন ক্লান্ত ক্লান্ত ক্লান্ত!’ (তৃষ্ণা)
‘আমার
জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর---
দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ!’ (হৃদয়ের ঋণ)
‘এখন
তুমি কোথায় আছো কেমন আছো পত্র দিও—
আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই!
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা বা কষ্ট দেবে!’ (প্রস্থান)
‘ব্যর্থ
হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন!
আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি
লাল শাড়িটা তোমার পরে এসো!’ (ঘরোয়া রাজনীতি)
সাহিত্য সমালোচক মাসুদ পারভেজ ‘হেলাল হাফিজের কবিতা ও বাঙাল লেখকের
কাঙালপনা’ শীর্ষক
এক প্রবন্ধে লিখেছেন,বহুজাতিক
পুঁজিবাদের যে-যুগটা চলছে সেই যুগে কবিতার বেঁচে থাকা বড়োই কষ্টকর। বহুজাতিক
পুঁজিবাদের কালে যখন কবিতা নিয়ে
সাহিত্যচর্চা গড়ে ওঠে কলোনিয়াল প্রেক্ষাপটে তখন কেমন হওয়া দরকার কবির
কবিতাযাপন? কবিতাযাপন
ব্যাপারটা হেলাল হাফিজের একটা কবিতার
সূত্র ধরে ‘যুগল
জীবনী’ কবিতাটা
লক্ষ করা যাক :
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে,—‘কি
নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন বেঁধেছিলে উদ্বাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।
শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনের কতো প্রয়োজন
উপেক্ষার ‘ডাস্টবিনে’ ফেলে
মনে আছে সে-ই কবে
চাদরের মতো করে নির্দ্বিধায় আমাকে জড়ালে,
আমি বাল্য-বিবাহিতা বালিকার মতো
অস্পষ্ট দু’চোখ তুলে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলাম
অপরিপক্ব তবু সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম
অতোশতো না বুঝেই বিশ্বাসের দুই হাত বাড়িয়েছিলাম,
ছেলেখেলাচ্ছলে
সেই থেকে অনাদরে, এলোমেলো
তোমার কষ্টের সাথে শর্তহীন সখ্য হয়েছিলো,
তোমার হয়েছে কাজ, আজ আমার প্রয়োজন ফুরালো?
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে,
সংগোপনে বলেছে,—‘হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর প্রতিবাদী তোমাকেই চাই’।
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,—থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।
এখানে একজন কবির কবিতা বিষয়ক ভাবনা কিংবা তার যাপিত জীবনের
বিভিন্ন অনুষঙ্গ দিয়ে কবিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এটা এক দিক দিয়ে যেমন কবির
ক্ষরণ সাপেক্ষে আর্তনাদ আবার আরেক দিক দিয়ে তার সাহিত্যিক বিপর্যয়। ‘আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না’—কথাগুলোর দিকে দৃষ্টি
ফেরালে একটা বিচ্ছেদের ব্যাপার লক্ষ করা যায়।হেলাল হাফিজের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে
তার বয়ান থেকে জানা যায়, প্রথম
কাব্যগ্রন্থের পর তার স্বেচ্ছানিরুদ্দেশের কথা, তাসের জুয়ায় জীবনের খরচ-মেটানো, সুন্দরী নারীদের সময়
বিকানো এমন অনেক তথ্য।হেলাল হাফিজের এসব কথা সত্য হলে তাকে আমার জীবনাচরণের দিক
থেকে কবি শার্ল বোদলেয়ারের মতো লাগে। যদিও সময়, প্রেক্ষাপট, স্থান ভিন্ন তবুও
যাপিত জীবনের একটা রেশ যেন থেকে যায়। বোদলেয়ার-এর কবিতায় তার যাপিত জীবনের প্রভাব
পড়েছে এভাবে : মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের শিথিলতা, প্রেমিকার চলে যাওয়া, আর্থিক সংকট, হতাশা আরও নানাবিষয়
যার সবই নেতিবাচক। তো হেলাল হাফিজের বেলা যদি এসব অনুষঙ্গের একটা মিল খুঁজি তাহলে
পাওয়া যায় : শৈশবে মায়ের মৃত্যু, হেলেন নামের এক নারীর কথা, গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী
সময়চিত্র ও রাজনীতি।‘নিষিদ্ধ
সম্পাদকীয়’ নামক
যে-কবিতাটা দিয়ে হেলাল হাফিজকে পরিচয় করানো হয় স্লোগানের কবি কিংবা এটা কবিতা
না-হয়ে স্লোগান হয়েছে সেই সময়টা বিবেচনার দাবি রাখে। আর হেলাল হাফিজ তো
ব্যক্তিজীবন দ্বারা তাড়িত এক কবি। তো তার সেই বৈশিষ্ট্য ধরে বলা যায় যে-ঘটনাটা
দেখে তিনি লিখলেন,
‘এখন
যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।
সেই সময়টা ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রয়ারি। সময়টা খেয়াল করলে বুঝা যায়, হেলাল হাফিজ যাপিত
জীবন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার কবিতার অনুষঙ্গ খুঁজলে কয়েকটি বিষয় ঘুরেফিরে আসে
: মা হারার শোক, যুদ্ধ
পরবর্তী সময়, হেলেন
নামের এক নারী, রাজনীতির
মামদোবাজি, মানবিক
আস্ফালন আর শূন্যতাবোধ।হেলাল হাফিজ টিকে গেছেন। এবং এই টিকে যাওয়াটা একটা মাত্র
কাব্য দিয়ে। যেটা প্রকাশিত হবার পর তিনি কবিতা প্রকাশ করা যেমন বন্ধ রাখেন তেমনি
নিজেকেও আড়াল করেন। তো কথা হচ্ছে বহুজাতিক পুঁজিবাদের আগ্রাসনের সময়ে প্রচার আর
প্রসারই যখন বাণিজ্যের প্রধান কলকাঠি হিশেবে জানান দেওয়া হচ্ছে তখন একজন কবি
নিরুদ্দেশ কিংবা আর কবিতা প্রকাশ না করার পরেও কিভাবে টিকে থাকলেন পাঠকের কাছে? আর যে-সময়ে কবি
নিরুদ্দেশ হচ্ছেন তখন ফেসবুক কিংবা ই-মেইল এসব মাধ্যমও ছিল না। তারপরও হেলাল হাফিজ
এই প্রজন্মের কাছেও পরিচিত হলেন তার একখান মাত্র কবিতার বই দিয়েই।হেলাল হাফিজ যে
বিষয়কে কেন্দ্র করে তার কবিতার জগৎ নির্মাণ করেন তা পরিচিত দৃশ্য। জীবনানন্দ দাশ
তার কবিতায় বনলতা, সুরঞ্জনা, সবিতা আরও অনেক নারীর
নাম নিয়েছেন আর হেলাল হাফিজ নিলেন হেলেনের নাম।হেলেন নামের এক নারী তার জীবনে
এসেছিল এমন কথা শোনা যায়। তো সেই হেলেনকে ঘিরেই যদি তার বিচ্ছেদের জগৎ তৈরি হয়
তাহলে পাঠক তাকে তকমা দিচ্ছে ‘কষ্টের ফেরিওয়ালা’। হেলাল
হাফিজ তার কবিতায় যে-কষ্ট ধরতে চেয়েছেন তা পাঠকের নির্জ্ঞান মন হতে উৎসারিত। ফলে
পাঠক যখন হেলাল হাফিজের কষ্টের কবিতা পড়ছে তখন তার নির্জ্ঞান মন সংজ্ঞান চেতনার
ওপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং কষ্টটাকেই আপন মনে করছে। হেলাল হাফিজ যে কষ্টটাকে
নির্মাণ করেছেন পাঠকের এই নির্জ্ঞান মন সেই কষ্টের একটা লিগ্যাসি তৈরি করেছে। ফলে
তার কবিতা কোনো বাণিজ্যিক প্রচারণা কিংবা কর্পোরেট আঁচড় না নিয়ে টিকে গেল।কবি
নিজেকে আরেক কবিতায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে—‘দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ’ বলে। এটা পাঠকের মনে
একটা তকমার প্রভাব তৈরি করতে পারে। তার কবিতার ভাষা খুব সাধারণীকরণ হয়ে এসেছে ঠিকই
কিন্তু আবেদনের জায়গা তাতে কমে নি। ফলে নিজের ভাবনার জগতের সঙ্গে পাঠকের ভাবনার
জগতের একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়ে গেছে।হেলাল হাফিজ যেহেতু কোনো গোষ্ঠী কিংবা
কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে যুক্ত হোন নাই ফলে তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটাও এমন হয় যে তিনি
কেন্দ্রে বাস করেও প্রান্তিক হয়ে পড়েন। কিন্তু তার কবিতা তাকে রক্ষা করে। ‘যেভাবে সে এলো’ কবিতার শেষ লাইনটার
দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক—
‘স্বাধীনতা
সব খেলো, মানুষের
দুঃখ খেলো না।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কে ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ ব্যাখ্যা আর হয়
না। এখানে একই সঙ্গে আছে হারানো আর প্রাপ্তির বোধ। তবে কবি তো আশা ভঙ্গের
ব্যাপারটাকেই তুলে ধরেছেন। প্রাপ্তি হলো স্বাধীনতার আর সেটার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা
পূরণ হয় নি ফলে তার কবিতায় উঠে এলো—
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
যে হেলাল হাফিজকে পাঠক কষ্টের ফেরিওয়ালা তকমা দিচ্ছে আর কবি
নিজেকে দুঃখের অংশীদার বানাচ্ছে সেই হেলাল হাফিজের দুঃখটা যে ব্যক্তিক দুঃখ না-হয়ে
সামষ্টিক দুঃখ হয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ ওপরের লাইনগুলো। কবি যখন বলছে, আমাদের সব দুঃখ, যৌথ-খামার, সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক
চাষাবাদ তখন পাঠকের বুঝতে আর কষ্ট হয় না মার্ক্সসিজম দ্বারা তাড়িত ছিল তার স্বপ্ন।
আর একটা সাম্যবাদী সমাজের আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। কিন্তু এই কথাগুলো কবি হেলাল হাফিজ
বলতে পেরেছিলেন কারণ তিনি করপোরেট বেনিয়ার খপ্পরে নিজেকে বাঁধেন নি। আর পুঁজিবাদের
দালালি করে সাম্যের স্বপ্ন দেখা যায় না। আর এখানেই হেলাল হাফিজ টিকে গেছেন ফলে তার
কবিজীবন নষ্ট হয় নি!
আশির দশকের অন্যতম প্রধানকবি মজিদ মাহমুদের কবিতার বই ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর ভূমিকা লেখা
হয়েছে,’মাহফুজামঙ্গল’ এখন আর শুধু একটি
কাব্যগ্রন্থ নয়! প্রথম প্রকাশের মাত্র তিন দশকের মধ্যে এটি একটি ক্লাসিক গ্রন্থে
রূপ নিয়েছে! এই সময় কালে আর কোন কাব্যগ্রন্থ বিষয়েও বাচনে এতটা ব্যাপ্তি নিয়ে
পাঠক মহলে হাজির থাকেনি! একইসঙ্গে মধ্যযুগের নিগড় ভেঙে যেমন এর বিষয় সৌন্দর্য্য
প্রকটিত, তেমনি
আধুনিকতার সীমা সরহদদাতা ও এটি যথাযথ মান্য করে নি! তাই বলে উত্তর উপনিবেশ ও
উত্তরাধুনিক পাঠ প্রপঞ্চের ভেতর এর বিষয় ও অঙ্গ শৈলী হারিয়ে যায় না! ব্যক্তি ও
জাতীয় মানুষের ব্যথা বেদনা বাঙালি মানুষের বাঙালি হয়ে ওঠা এবং অতীত ঐতিহ্যের
উত্তরাধিকারিত্ব ধারনের মাধ্যমে এ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে একের ভেতর বহু স্বরের
প্রকাশ! মানুষের প্রেম-ভালোবাসা সংগ্রাম ও স্বপ্নযাত্রা এ গ্রন্থে প্রকীর্ণ হলেও
পাঠক সহজ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন না! তিন দশকের প্রেক্ষাপটে গ্রন্থটি ক্রমান্বয়ে
খাঁটি বাঙালি কাব্য হিসাবে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছে! শব্দ চয়ন বিষয় নির্বাচন
বাচনিক দিক দার্শনিকতার বয়ান সব মিলিয়ে মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতার
ইতিহাসে এক অভিনব উপাদান! ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা পর্বে এ দেশের কবিতা
হারিয়ে ফেলেছিল যে নিজস্ব ধারা মাহফুজামঙ্গল এ তার কিছুটা পুনর্জাগরণ ঘটেছে বলে
মনে হয়! এই কাব্য পাঠ এর মাধ্যমে পাঠক এক অনাস্বাদিত আনন্দের সম্মুখীন
হন!সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা যেভাবে অ্যাবসার্ডনেস ও অ্যাবস্ট্রাকশনে ভর দিয়ে নতুন
কোনো উন্মোচনের দিকে যেতে চাইছে, সেখানে মজিদ মাহমুদের কবিতা চিন্তা ও দর্শনের সাথে লড়াই করবার
জন্য পাঠককে আত্মখননের দিকে নিয়ে চলে।১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘মাহফুজা মঙ্গল’ প্রকাশের পরে মজিদ
মাহমুদের কাব্য পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ হয়েছিলেন!।২০০১ সালে বাংলা কবিতার
কিঞ্চিত স্বাতন্ত্র্য কাব্যগ্রন্থ ‘বল উপাখ্যান’ এবং ২০০২ সালে ‘আপেল কাহিনী’ নামে অপর একটি
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।2014 সালে মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের পঁচিশ বছর পূর্তি
উৎসব অনুষ্ঠানে ঢাকায় কবি মজিদ মাহমুদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে ছিলেন তার মাহফুজামঙ্গল
কাব্যগ্রন্থের জনপ্রিয়তা এবং পাঠকপ্রিয়তা দেখে মনে হয় বল উপাখ্যান এবং আপেল
কাহিনী নামে কাব্যগ্রন্থ গুলির লেখক তিনি হলেও তার মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের
লেখক আসলে পাঠকরাই! পাঠকরাই তার কাব্যগ্রন্থ মাহফুজামঙ্গল কে জনপ্রিয় করে
তুলেছেন! ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন, মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ তার প্রথম
দিকের লেখা! এই লেখায় তার অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে! অথচ এই কাব্যগ্রন্থটি
পাঠকপ্রিয়তা এবং জনপ্রিয়তা প্রকাশের 30 বছর পরেও যে কমেনি তার প্রমাণ হলো
কাব্যগ্রন্থটির দশম সংস্করণ এর প্রকাশ! অথচ বল উপাখ্যান এবং আপেল কাহিনী এই দুটি
কাব্যগ্রন্থ তার পরিণত লেখা এবং উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও
মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের জনপ্রিয়তা এবং পাঠকপ্রিয়তার কাছে চাপা পড়ে গিয়েছে!
এ নিয়ে কবির মনে কিছুটা বেদনা থাকলেও তিনি পাঠকের মান্য তাকেই স্বীকার করে নিতে
বাধ্য হয়েছেন! কারণ একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত 30 বছর পরও কবিতা প্রিয় পাঠক অবাক
বিস্ময় পাঠ করছেন এবং এবং আলোড়িত করছে এর চেয়ে একজন জীবিত কবির আর কি বড়
প্রাপ্তি হতে পারে! মজিদ মাহমুদ লেখেন
আইডিয়া-নির্ভর কবিতা। কথা বলেন পরিচিত ভঙ্গিতে। বিশেষ বাগভঙ্গি নয়, চিত্রকল্প বা
ধনিব্যঞ্জনাও নয়, তার
কবিতার ভাববস্তুই কবিকে চিনিয়ে দেয় পাঠকের কাছে। নিজ ভূগোলের ভাব-পরিমণ্ডলে বাস
করে তিনি গ্রহণ করেছেন ভেতর ও বাইরে থেকে সুপ্রচুর। ইসলামি সংস্কৃতির চিহ্ন
উদ্ধারে, বিশেষত
সিমেটিক সভ্যতার মিথ বিচূর্ণীভবনে তার ঝোঁক লক্ষণীয়। উল্টোমিথ সৃষ্টিতেও সমান
আগ্রহ। তাকে যথার্থভাবে চেনা যায় মাহফুজামঙ্গল কাব্যে।এই কাব্যগ্রন্থে কবি মজিদ
মাহমুদ অসংখ্য স্মরণীয় পঙক্তি লিখেছেন! তার মধ্যে বাছাই করা উল্লেখযোগ্য কিছু
পংক্তি পাঠ করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন কেন মাহফুজামঙ্গল এত পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে!
তোমাকে পারে না ছুঁতে
আমাদের মধ্যবিত্ত ক্লেদাক্ত জীবন
মাটির পৃথিবী ছেড়ে সাত- তবক আসমান ছুঁয়েছে তোমার কুরসি
তোমার মহিমা আর প্রশংসা গেয়ে
কি করে তুষ্ট করতে পারে এই নাদান প্রেমিক
তবু তোমার নাম অঙ্কিত করেছি আমার তসবির দানা
তোমার স্মরণে লিখেছি নব্য আয়াত
আমি এখন ঘুমে জাগরনে জপি শুধু তোমার নাম! (কুর্সিনামা)
মাহফুজা তোমার শরীর আমার তসবির দানা
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়
তুমি ছাড়া আর কোন প্রার্থনাই
আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত---
তোমার সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর
তুমি তখন ঢাল হয়ে তার তীর্যক রোশানি ঠেকাও
তোমার ছোঁয়া পেলে আমার আযাব কমেছে সত্তর গুণ
আমি রোজ মকশো করি তোমার নামের বিশুদ্ধ বানান—(এবাদত)
আমি তো দেখি তোমার সবুজ স্তন, আগুনের খেত
অসম্ভব কারুকাজে বেড়ে ওঠা তাজমহলের খুঁটি
তোমার চুলের অরণ্যে পাই না কল্যাণ এর ঘ্রাণশক্তি--
এমন অযোগ্য কবিকে তুমি সাজা দাও মাহফুজা
যে কেবল খুঁজেছে তোমার নরম মাংস
তবু তোমার স্নেহ আমাকে ঘিরেছে এমন
এই অপরাধে কখনো করোনি সান্নিধ্য ত্যাগ! (খবর)
তোমাকে জানলে মানুষের নষ্ট হবে আহারে রুচি
করবে না আবাদ বন্ধ্যা জমিন
নিজেরাই পরস্পর মেতে রবে ভ্রুণ হত্যায়
তোমাকে জানলেই কিয়ামত হবে
মানুষের পাপ ছুঁয়ে যাবে হাশরের দিন
তুমি যেন আমার পরে হইও না সদয়
আদরে রেখো না ললাটে হাত
বরং অনাকাঙ্ক্ষিত তিক্ততায় ছুঁড়ে দাও নাগালের ওপার! (তোমাকে
জানলেই)
আমি জানিনা কি করে মুক্তি পেতে পারি এই ক্লেদাক্ত জীবন
আজ রাতে সৌম্যমান কান্তিমান বৃদ্ধ বলে গেল এসে
তোমাকে জানতে হবে পৃথিবীতে জীবন্ত লোক কিভাবে আসে
সেই ইতিহাসে লেখা আছে তোমার মুক্তির সঠিক কারণ!
ঘুমের মধ্যেই মাহফুজা তুলে নিল হাত, বলল, এখানে
এই বুকের আর নাভির নিচে বেদনায় লেখা স্বপ্নের মানে!
(মাহফুজামঙ্গল এক)
মাহফুজা আমার বিপরীতে ফিরাইও না মুখ
যেন কোনদিন বঞ্চিত না হই তোমার রহম
সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকে যেন তোমার ক্ষমা
তুমি বিমুখ হলে আমাকে নিক সর্বহারী যম
তাহলেই খুশি হব বেশ তুমি জেনো প্রিয়তমা
তুমি নারাজ হলে বেড়ে যায় আমার অসুখ! (মাহফুজামঙ্গল তিন)
তুমি আছো এরচে বড় প্রমাণ কি হতে পারে ঈশ্বর আছে
মানুষের শিল্প কোনকালে পারে কি বলো এমন নিখুঁত
ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে সশরীরে তুমি থাকো কাছে
আমি শুধু তোমার মাহাত্ম্য ভাবি প্রভু কি যে আশ্চর্য অদ্ভুত!
(মাহফুজামঙ্গল চার)
আমাকে সারাক্ষণ ধরে রাখে মাহফুজার মাধ্যাকর্ষ টান
এ ছাড়া সংসার পৃথিবীতে নেই আমার আর কোন বাঁধন
প্রবল স্রোতের মুখে ও আমার মাঝিরা দাঁড় টানে উজান
এ আলেকজান্ডার জানে না মানা শোনে না সম্রাট শাসন!
আমি যেখানেই থাকি না কেন পতিত হই তোমার বুকে
কোন শক্তি নেই তোমার অভিকর্ষ টান থেকে বিচ্ছিন্ন করে---
(মাহফুজামঙ্গল পাঁচ)
এবার আমি ফিরে যাচ্ছি মাহফুজা
তোমার সেই সব স্মৃতিময় সম্পদের ভেতর
যার ছায়া ও শূন্যতা আমাকে দিয়েছে অনন্ত বিশ্বাস
একদিন অসংখ্য ছায়াপথ ব্ল্যাকহোল অতিক্রম করে
যেসব ফেরেশতা আমাদের শূন্যতায় ভাসিয়ে দিয়েছিল
এবার আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের আলিঙ্গনের ভেতর--- (ফিরে যাচ্ছি)
তোমার অনাঘ্রাত শরীর আমাকে ডেকেছিলো পৃথিবীর পথে
আমরাই তো প্রথম শুরু করেছিলাম পাহাড় নির্মাণের গল্প
দুর্গম পর্বতের গুহা থেকে কাখের কলসিতে
পানি ঝরিয়ে দিয়েছিলাম তোমার সন্তানের উপর
তবু বহুমাত্রিক সভ্যতা আমাদের দিয়েছে বিচ্ছেদ--- (গল্প)
‘মাহফুজামঙ্গল:
একটি স্বতন্ত্র শক্তিমন্ত মৌলিক কবিতার বই’ নামক প্রবন্ধে কবি ও সাহিত্য সমালোচক
কাজী নাসির মামুন লিখেছেন,’মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থেও
মাহফুজাকে একই সঙ্গে দেবী এবং প্রিয়ার ভূমিকায় দেখি। মজিদ মাহমুদ যখন বলেন : তোমার
সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর, তখন প্রেমের শারীরিক কাঠামো ভেঙেচুরে
যায়। শরীর ছাপিয়ে অশরীরী ঈশ্বরের প্রবল দাপট যেন আমরা টের পাই। ফলে প্রেম হয়ে ওঠে
একই সঙ্গে শারীরিক এবং প্লেটোনিক। এই প্রেম প্লেটোনিক, কেননা ঈশ্বরের সঙ্গে
একমাত্র আধ্যাত্মিক প্রেমই সম্ভব। আবার এই প্রেম শারীরিক, কেননা শরীর ছুঁয়ে যে
স্পর্শসুখ অনুভূত হয়, তার
বর্ণনাও তার কবিতায় অগণিত। দুইটি
সাবলীল পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে এই ভালোবাসার দ্বৈতরূপ তিনি রূপায়ণ করেছে।
মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়।
শরীর হচ্ছে মাধ্যম। শরীরী প্রেমের মধ্য দিয়ে পৌঁছানো যাবে
ঈশ্বরে। মজিদ মাহমুদও তার শারীরিক তথা জাগতিক প্রেমকে একটি মহাজাগতিক পরিণতির দিকে
ঠেলে দিয়েছেন। ফলে তার কবিতা একরৈখিক গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে নি। বহুরৈখিক মাত্রায়
উপনীত হয়েছে। আর তাই মাহফুজা এবং ঈশ্বর একই সত্তায় লীন হয়ে গেছে। ঈশ্বর তথা
মাহফুজা তো তারই মানস-দেবতা। আর তাই হয়তো ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে
দাঁড়ায়।মাহফুজামঙ্গলে মজিদ মাহমুদের প্রেমপ্রবণতা একই সঙ্গে একেশ্বরবাদী এবং
পৌত্তলিক ঘরানার। তার প্রেমের কবিতার এটিও একটি বহুমাত্রিক দিক বলে মনে হয়। তার
ধ্যানে, জ্ঞানে, কর্ম-পরিকল্পনায় তথা
জীবনের সকল স্তরে মাহফুজার একচ্ছত্র অবস্থান এবং আধিপত্য তাকে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র মতো সর্বময়ী করে
তুলেছে। মাহফুজা আছে বলেই অন্য কোনো ‘দেবতা’র অবস্থান পোক্ত হয় নি মজিদ মাহমুদের
জীবনসত্তায়। হৃদয়বৃত্তির সকল স্তরেই পলকা হয়ে গেছে অন্য কোনো দেবদেবীর অধিষ্ঠান।
আর অত্যন্ত সরলভাবেই তিনি বলেন : মাহফুজা তুমি তো দেবী/ আর আমরা তোমার গোলাম। আর
শেষটায় জুড়ে দেন : পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক তোমার শাসন। অর্থাৎ মাহফুজাকে তিনি তার
প্রেমপ্রলুব্ধ হৃদয়ের অধিপতি হিশেবেই দেখতে চান না, তিনি চান মাহফুজার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত
হোক এক ঐশ্বরিক শাসন। মাহফুজা ঠিক এই জায়গায় একেশ্বরের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমাদৃত
হয়ে ওঠে মজিদ মাহমুদের প্রেমের দর্শনে। রোমান্টিক ব্যক্তিনিষ্ঠতা ডিঙিয়ে এক
বস্তুনিষ্ঠ ক্লাসিক্যাল পরিণতির দিকে তার প্রেম যেন আরও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রেমের
এই উপলব্ধি নতুন এবং স্বতন্ত্র তো বটেই।সুফিবাদে আমরা যেমনটি দেখি : প্রেমের মধ্য
দিয়ে ঈশ্বরে বিলীন হবার আকাঙ্ক্ষা। ‘ফানাফিল্লা’র অনন্য জগতে ঈশ্বরের
সঙ্গে মিলিত হবার প্রয়াস। কিন্তু প্রেম পরিণতি পেলেই ভক্তিমার্গে উচ্চকিত সেই
প্রেম। তারও আগে শুরু হয় মান-অভিমান, বিরহ প্রহর। চলমান হাহাকার সেই প্রেমের
বিরহকে প্রজ্বলিত করে দেয়। মজিদ মাহমুদের কবিতাতেও সেসবের বিস্তর প্রয়োগ লক্ষ
করবার মতো :
তুমি অক্ষত অমীমাংসিত থেকে যাও শেষে
তখন আমার গগনবিদারী হাহাকার
অতৃপ্তিবোধ
আরও হিংস্র আরও আরণ্যক হয়ে
ক্রুদ্ধ আক্রোশে তোমাকে বিদীর্ণ করে
তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে
তুমি ছিন্নভিন্ন হয়ে
তুমি ক্ষয়িত ব্যথিত হয়ে
আবার ফিরে আস অখণ্ড তোমাতে
আমার বিপক্ষে অভিযোগ থাকে না তোমার
কারণ তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পারে না যেতে
আমাদের দাসের জীবন। (দাসের জীবন)
তুমি চলে যাবে?
তুমি চলে যাও মাহফুজা
কাঙালের মতো আর বাড়াব না হাত
শুধু সাথে করে নিও না যদি
কোনোকালে অজান্তে করে থাকি পাপ। (কেন তুমি দুঃখ দিলে)
মিলনের শুভদিন কোনোদিন আসবে না আমাদের
অপেক্ষায় কেটে যাবে আহ্নিক গতি
বছর বছর যাবে নতুনের সমাগমে
অবনত রয়ে যাব সনাতন বিষয়ের কাছে
আমার বয়স যদি বেড়ে যায় একশ বছর
সত্তর হাজার কিংবা অনন্তকাল
তুমি তত দূরাস্ত হয়ে যাবে আমার কাছে
কেননা তোমার গতি সমদূরবর্তী সমান্তরাল লাইনের মতো।(শুভদিন)
এই গ্রন্থভুক্ত ‘মঙ্গলকাব্য’ অংশে ভক্তিমার্গ যেন
উচ্চকিত হয়ে উঠেছে :
যেন কোনো দিন প্রবঞ্চিত না হই তোমার ওম
সারাক্ষণ ঘিরে থাকে আমাকে যেন তোমার ক্ষমা। (তিন)
এমন অভিকর্ষের কথা নিউটন শোনেন নি কোনোদিন
আমার তো জানা নেই কিভাবে শোধ হবে মাহফুজার ঋণ। (চার)
মাহফুজা আমার জীবন আমার জবান তুমি
করেছ খরিদ, তাই তোমার গোলাম আমি
তোমার হুকুমের বিরুদ্ধে কেউ পারবে না আমার
স্বাতন্ত্র্য ছুঁতে, আমার ধ্বনি, আমার কবিতা, আর
আমার সন্তান, সব সম্পদ তোমারই নামে। (পাঁচ)
আমার মতো হয়তো শত কোটি মানুষের প্রণাম
তোমার পায়ে আসলে শুভক্ষণে পেতে পারি ক্ষমা। (ছয়)
মাহফুজামঙ্গলে মজিদ মাহমুদের একেশ্বরবাদী প্রবণতা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। এর
বাইরেও তার প্রেমের একটা পৌত্তলিক ঘরাণা আছে। সেখানে মাহফুজা একই সঙ্গে দেবী এবং
মানবী। মাহফুজামঙ্গলে মাহফুজা একটি রূপক বা প্রতীকের ব্যঞ্জনায় প্রতিষ্ঠিত বলে
কোনো কালসীমানায় আটকে নেই। বিশেষত আমাদের ঐতিহ্যগত মিথের ব্যবহারে অতীতকে
সমসাময়িকতায় এবং সমসাময়িকতাকে অতীতের মূল্যায়নে লীন করে দিয়েছেন মজিদ মাহমুদ। তার
কবিতা ভাষায় বোধগম্য কিন্তু ভাবে গভীর। ফলে কোনো আরোপিত টেকনিকের দ্বারস্থ হতে হয়
নি তাকে। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় একটি স্বতঃস্ফূর্ত সংবেদনশীলতা থাকে। আরো
থাকে দার্শনিক ঋদ্ধতা। বাংলাদেশের মানুষের আটপৌরে মুখের ভাষাকে কবিতায় ব্যবহারের
মধ্য দিয়ে মজিদ মাহমুদ সেই দার্শনিক ঋদ্ধতাকে নতুন করে যাচাই করেছেন। ভাষার সেই
ব্যবহার সরল কিন্তু সিদ্ধ। সেই ভাষাকে তিনি কোনো বিশেষ ছাঁচে ফেলে পরিশীলনের
চেষ্টা করেন নি। এই ক্ষেত্রে তার সাহস এবং পারঙ্গমতা আশির কবিতার মৌলধারার দিকে
চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। তার শক্তিই প্রমাণ করেছে তিনি স্বতন্ত্র এবং নিজের জায়গায়
মৌলিক।
আবু রাইহান: কপিরাইট লেখক কর্তৃক
সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন