সৌজন্যে- ফিরে দেখা



রম্যরচনা
          

     দৈনন্দিন জীবনে- নানা কাজের ব্যস্ততায় পাগল আমরা। কে যেন সারাক্ষণই আমাদের পিঠে চাবুক মেরে চলেছে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে-রাত্রি। চব্বিশ ঘন্টাই নাকে দড়ি দিয়ে ছুটিয়ে মারছে। আমরা ছুটে ছুটে মরছি! স্বেচ্ছায় ছুটছি কখনও, কখনও বা মোহের ঘোরে! এ এক আশ্চর্য মোহ। না পারি ফেলতে, না পারি গিলতে! গৃহকর্তা ছুটছেন হুহু তীব্রগতীতে, কেন না গৃহকর্তার প্রাণের দায়। সংসার নামক হাঁ-রাক্ষসের ক্ষিধে আর মেটেই না! হায়! গৃহকর্ত্রীর দশাও তথৈবচ। তার দায়ও যে কোনো অংশে কম নয়। আজকাল দুজনের মিলিত উপার্জন ছাড়া ভদ্র জীবন যাপন সম্ভব হয় না! বাচ্চাদের ভালো স্কুলে পড়াতেই হবে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো আর হেলাফেলা করা যায় না! এইযুগে ঘরে ঘরে এক্কেবারে একটি প্রাণের প্রাণ আমার সোনা, চাঁদের কণা। বড়জোর দ্বিতীয়জনের ভাবনা, কলিজা কী টুকরার আয়োজন সামর্থ বুঝে। ভাবীকালের জন্য সোনায় মোড়া ভবিষ্যতেরও নিখুঁত আয়োজন প্রয়োজন। আর এই পোড়ার দেশে কিস্যু হওয়ার নয়! অতএব এদেশ ওদেশ বিদেশ এখন জলভাত। যেন এপাড়া, ওপাড়া! ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে পছন্দসই প্রতিষ্ঠান বাছতে কিম্বা উচ্চশিক্ষায় পাঠাতে গেলে তো এমনধারাই ভাবতে হয়! তাছাড়াও, এই কাজ কাজ, টার্গেট টার্গেট, স্বপ্ন স্বপ্ন। জীবনের একঘেয়েমী কাটাতে নিয়ম করে ভ্রমণে না বেরোতে পারলে ভদ্র সমাজে বাস করা যায় না! অতএব সাধ্যাতিরিক্ত গাঁটের কড়ি ফেলতে হবেই। যেমন কম্মো, তেমনই বর্ম! গাঁটে যদি তেমন পরিমান না থেকে ক্রেডিট নাও!  

     বিভিন্ন সংস্থা পায়ে ধরে সাধছে দিবারাত্র। বাড়ি বয়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে সেধে সেধে, সেই সুবিধে নেব না? কোন আহাম্মক আমি? তিন চারটে ক্রেডিট কার্ড ওয়ালেটে না থাকলে যে সমাজে মুখ দেখানো চলে? প্রেস্টিজ পাংচার! কর্তাগিন্নী, ছেলেমেয়ে সকলেরই একই অভিমত!

     আর যদি বয়ষ্ক পিতামাতা বেঁচে থাকেন! বুদ্ধি করে এড়িয়ে চলতে চাইলেও যদি তাদের দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়ে অবশ্যম্ভাবীরূপে, তখন তাদের শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া। সেখানেও যে সর্বদা ফেলো কড়ি মাখো তেল। ছেলেপুলে, মিয়াবিবি কিম্বা বয়ষ্ক মাবাবা সকলেরই যথাযথ ভালো চাই তো! অতএব উদয়াস্ত পরিশ্রম করো, ফুর্তী করো, পরিশ্রম এবং ফুর্তীও। মেডিক্লেমের প্রিমিয়ম ভরো মোটাসোটা অঙ্কে। আর যদি বয়ষ্কদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারো তো, সেই খরচও কম নয়কো মোটেই!

     শুধু কী তাই? নিজেদের নিয়েও যে সমস্যা কম নয়! ধরুন না শুরুতেই। ভদ্রভাবে বাঁচতে হলে একটি ভদ্র বাসস্থান প্রথমেই প্রয়োজন। সকলের তো আর বাপদাদা চোদ্দপুরুষের বানানো বাড়ি থাকে না! যদিও থাকে, সেখানেও যে একসময় বড্ড গা ঘেঁষাঘেঁষি। মতের অমিল, স্থান সঙ্কুলান। সম্পর্কে ক্রমশ বিপদের ফাটল। চারপাশে অশান্তির ঝুরি নেমে পাকে পাকে জ্বরাজীর্ণ করে তোলে জীবন।

     তার চেয়ে বাপু চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ নিয়ে চল আকাশ ছুঁই। এত এত আকাশ ছোঁওয়া অট্টালিকা বানানো হচ্ছে শহরের অলিতে গলিতে, সে সব কাদের জন্য? সমস্ত রকমের অত্যাধুনিক সুবিধে সহ রূপালী পর্দায় বিজ্ঞাপিত সেইসব সুখী গৃহকোণ থরে থরে সাজানো। সেই সাম্রাজ্য হাতছানি দিয়ে দিবারাত্রি আন্তরিক আহ্বান করছে, সেকি এমনি এমনি? সেই ডাকে সাড়া না দেওয়া কী উচিৎ কাজ হয়? জীবনের প্রথম ভাগেই যদি ঝুঁকি নিয়ে সময়ের কাজ সময়ে করা থাকে তো ভালো, নইলে কপালে হোমলোন, কারলোন নিয়ে হ্যাঁচোর প্যাঁচোর ভোগান্তি। এদিকে চাকরি বাকরির অবস্থাও সঙ্গীন! ঘাড়ে ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে কতশত প্রতিযোগী! স্বামীস্ত্রী সুখের সংসার করবে কী? হিসেব কষতে কষতে মাথার চুল বেবাক রুপোলী।  

     ভালোমন্দ স্বপ্নরা কখন যেন জানালা গলে পালায়। তারপর তো বোসগিন্নী, ঘোষগিন্নী, রায়গিন্নীদের সঙ্গে কথায় কথায় ঠেস দেওয়া লড়াই। সমস্ত প্রকার অত্যাধুনিক গ্যাজেট ঘরের মধ্যে রাখা চাই-ই চাই! আরে রাম রাম! আজকাল যে বারোমাসে তেরো পার্বণ। নয় নয় তিনশ পঁয়শট্টি দিনে সাতশ উৎসবের ধারা। ড্যাম কুড়াকুড় বাদ্যি বাজছে সারা বছর। কতশত ছাড়, কতশত উপহার। সেদিকে কর্ণপাত না করে কোন সাধুপুরুষ বাঁচবে এই সংসারে? ওদিকেও শ্যাম রাখি না কুল রাখি?

     বিভিন্ন শপিংমল ঘুরে ঘুরে দর্শনানন্দের মধ্যেও যে অভুতপূর্ব সন্তুষ্টি রয়েছে সে কথা কে না জানে! তাছাড়াও আন্তর্জাল দুনিয়া যে সমস্তপ্রকার উপকরণ সাজিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। এড়িয়ে যাবে কোথায়? চাও তো, মুহূর্তে জী-হুজুর করে মস্ত সেলাম ঠুকে দাঁড়াবে। আঙ্গুলে ঘুরিয়ে কেবল বাটন টেপার অপেক্ষা। পলক ফেলতে না ফেলতেই হাজির বাঘের দুধ থেকে মঙ্গল গ্রহের পাথর, মোহময়ী রূপসীর সজ্জা কিম্বা ভালোবাসার মানুষের অন্তরে প্রবেশের মন্তর- তন্ত্রবীণা। যা কিছুই চাইতে পারো। এক্কেবারে সখের প্রাণ গড়ের মাঠ!

     পেটের ভেতর থেকে সখ আহ্লাদ টেনে টেনে নিয়ে এসে জড়ো কর, সে সব কাজে লাগুক ছাই না লাগুক! না হলে যে মান থাকে না সমাজে! এমন এমন ভয়ঙ্কর ডামাডোল নিয়েই চলতে হচ্ছে সব্বাইকে। চাও কী না চাও! আরে, যতই আমরা বৃত্ত সঙ্কীর্ণ করছি, ততই আয়তনে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা। মিয়াবিবির আপনি কপনি শুধু? সংসার যে তার বাইরেও ছড়িয়ে।

     বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। রাস্তা-ঘাট, দোকান- পাট, অফিস-আদালত। সবই তো আজ আমার আপনার জীবন যাপনের অঙ্গ! আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া। কবিগুরু তো সেই উপদেশ দিয়েই গিয়েছেন বহুকাল আগেই! সেই উপদেশ মেনেই তো আজকাল আরও বৃহত্তর পরিধিতে আমরা ছড়িয়ে পড়েছি। যা কিছু কর, সে খাও নয় তো ঘুমাও, মান কর কী অভিমান, ঝগড়া কিম্বা প্যায়ার সব, সবই তৎক্ষণাৎ আন্তর্জাল দুনিয়াতে দর্শানো দরকার নইলে ঘুমের বারোটা, হজজমেরও।

     সেও আর এক কাজের বাড়া কাজ। সর্বদা টানাটানি সময়ের যুদ্ধ। মরণ বাঁচন কাড়াকাড়ি। আধুনিক জীবন দর্শণ আপডেট থাকো, রাখো! নিজেও, অন্যেরও! বড় দুরূহ কম্মো এইভাবে এগিয়ে চলা। আচ্ছা কোথায় চলেছি? এগিয়ে যাচ্ছি তো! কোথায়? কোনো আদর্শ? আছে কোনো সঠিক ভাবনা? কোথায় কী? দুচোখে কেবল ঝাঁঝাঁ চক্কর, সর্ষেফুলের চকমকি! সুন্দর উপযুক্ত সঠিক চিন্তা ভাবনা কই?

     মাঝে মাঝেই দেখি, দুচোখের পাতা জুড়ে ধূধূ শূন্যতা! হৃদয়ের অন্তরালে হুহু কান্না! পাশাপাশি থাকি, তবু পাশে কই? সামনে কী দেখছি? পাশে কাকে চাইছি? কোনদিকে এগোবো? কীভাবে এগোবো? কোথায় যেতে চাই শেষ পর্যন্ত? আমাদের মত ছাপোষা মানুষের চাওয়া পাওয়াতে বিস্তর ফারাক! তবুও হুঁশ ফিরছে কই? সুখ, শান্তি, সম্পদ, স্বাচ্ছন্দ্য, চাই, চাই, চাই। সবই চাই। যতই হোক না অধরা! অধরাকেই তো ধরতে চাই। পাই না! কেন? চাওয়া পাওয়ার মাঝে লক্ষ্যযোজন দূরত্ব! তা ভরাব কী দিয়ে? সকাল টু সন্ধ্যে, ভেবেই চলেছি বেফিকির! ভাবতে দোষ কী?  আগডুম বাগডুম এমনি করেই আমি দিনরাত্রি ভাবি। ভাবনাবিলাস আমার একপ্রকার অন্যায় সখ। দিশা কোথাও পাই বা না পাই, ভাবতে ক্ষতি কোথায়? ভাবতে ভাবতে এক একসময় আমার ভাবনা, আপনার ভাবনা, তাহার ভাবনা, কাহার ভাবনা সব মিলেমিশে একাকার!

     যদিও কবিগুরু সতর্ক করে দিয়েছিলেন কতদিন আগেই। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না! কিন্তু এই রোগের চিকিৎসা কই? কে পারবে এমন মহামারী রোগের অব্যর্থ নিদান দিতে আমাদের?

     এমনি করেই যায় যদি দিন যাক নাতে নেচে উঠি! তবু কিছুতেই কিছু হয় না! ভেবে ভেবে কুল কিনারা পাই না! এক একদিন ভাবতে বসি নাওয়া খাওয়া ভুলে। এক একবার ভাবতে বসলে দুনিয়া বিস্মৃত হই। কাজ নেই, কম্ম নেই, শুধুই গালে হাত! হা ভগবান! একে দিয়ে এই দুনিয়ায় যে কিছুই উপকার হবে না!

    কিন্তু ফেলে দিতেও পারবেন কী? বর্জ্যপদার্থ ঠিকঠাক ভাবে ধ্বংস না করে দিলে পৃথিবীরই ক্ষতির সম্ভাবনা! তাহলে? ধ্বংস করি কীভাবে এইসব আবোল তাবোল ভাবনারাশি? আচ্ছা, ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েও শিল্পীরা কতকিছু গড়ে তোলেন, তেমনই করুন না কেউ! পারবেন না?

    দীর্ঘ সময় বসে বসে সেইসবও ভেবে চলেছি আমি। কিছুই কী সারবত্তা নেই আমার এমন ধরণের ভাবনার? তার মধ্যেই এক একসময় মনে হচ্ছে, অতি অবশ্যই কী যেন দরকারি কাজ ছিল! বলার ছিল যেন কাউকে কোনো অত্যন্ত দরকারি কথা। হয়ত বা করার ছিল কিছু কাজ কিম্বা কারও আসার কথা ছিল, নাকি আমারই কোথাও যাওয়ার ছিল?

    কেউ কোনো কাজের কথা বলেছিল? নয়ত আমি কাউকে কোনো কাজের কথা বলেছিলাম? এমন ধারা অসংখ্য ভাবনা একটা সময় মাথার মধ্যে ঘোঁট পাকিয়ে একেবারে ভজগোবিন্দ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাকে। প্রায়ই আমার হতভম্ব দশায় আমি নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই।

     মাঝে মধ্যেই, হঠাৎ, হঠাৎ! ওদিকে সংসারে হাজার কাজকর্মের ধুন্ধুমার লড়াই। এমন ধারার টানাপোড়েনে নাস্তানাবুদ আমি বিপর্যস্ত। কি করি? বড্ড অসহায় বোধ হয়। কেমন পাগল পাগল লাগে। চোখের সামনে আকাশভরা ধোঁয়াশার মেঘ। মনের মধ্যে বুক-ধড়পড় দ্বন্দ্ব।  চোখেমুখে বোকা বোকা অস্থিরতা নিয়ে আমি কলুর বলদ, ঘুরেই যাচ্ছি, ঘুরেই যাচ্ছি! আমারই চারপাশে ছটাক ব্যাসার্দ্ধ পরিসীমায়! এইসময় কি করা উচিৎ কিম্বা কী করা উচিৎ নয় ভেবে উঠতে পারি না! অসম্ভব চাপে ঘেমে-নেয়ে একসা! মাথা যেন বন্-বন্ লাট্টু!

     মাপ চাইছি এইক্ষণে! আমার অত্যন্ত সঙ্গীন অবস্থার গুরুত্ব বুঝাইতে সাধুভাষার শরণাপন্ন হইলাম। গুরুচন্ডালী বলছেন? সে তো হতেই হবে। হাইব্রীডের যুগ, ফসলের পরিমান যা চাই, তাতে অত বাছবিচার চলে না!

     সকলের নিকট আগাম ক্ষমা প্রার্থনা চাহিয়া বলিবার প্রচেষ্টা এক্ষণে। একদিবস, এমনই কঠিন মনোকষ্টে যৎপর নাই ভোম্বল দশাপ্রাপ্ত পূর্বক বেতার যন্ত্রটির প্রতি আকর্ষিত হইলাম। ঊষাকালে নিদ্রাদেবী পলায়ন করিবা মাত্রই ভয়ঙ্কর দুঃসহ যন্ত্রনায় হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছিল আমার!    অতএব তীব্র বিরাগ সহযোগেই ক্ষুদ্র যন্ত্রটিকে হস্তে তুলিয়া জোরপুর্বক তাহার কর্ণমুল আন্দোলিত করিতে লাগিলাম। একটানা শোঁশোঁ শব্দে তাহার অসম্মতি সে জানাইতে লাগিল প্রবলভাবে। তাহার অসহযোগে কিঞ্চিৎ মাত্র বিচলিত না হইয়া এইদিক ওইদিক ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বিষন্ন মনখানির উন্নতি ঘটাইবার আয়োজনে সেইমত সামগ্রীর অনুসন্ধান করিতে থাকিলাম। এবং তদ্ উদ্দেশে বীরদর্পে ক্রমাগত তাহার কর্ণমুল মর্দন করিতে লাগিলাম। কোনোপ্রকার আপত্তি শুনিলাম নাতো বটেই, বরঞ্চ তাহা কর্তৃক সমস্তপ্রকার প্রতিরোধকে অস্বীকার করিতে থাকিলাম প্রবল বিক্রমে। মস্তিষ্কের তাপমাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি হইতেছে। দরদর বহিতেছে ঘর্ম, কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ না করিয়া, যে কর্ম করিতেছিলাম, তাহাই করিয়া যাইলাম। তাহা হইতে আমি অধিক বলশালী, সেইক্ষণে তাহা সঠিকভাবে বুঝাইব। প্রতিপক্ষ যদিও অতি নগন্য, অতীব পুরাতন, সামান্য মূল্যের একটি বেতারযন্ত্র। তথাপি, তাহাকেই বুঝাইতে তৎপর হইলাম, কে আমি?

      যদ্যপি যন্ত্রটিতে কোনোপ্রকার বিনষ্ট করার অভিপ্রায় আদপেই ছিল না, সেইহেতু মনোযোগ সহকারে আরও অধিক কিছুসময় ব্যয় করিলাম। যন্ত্রটিও যেন সেদিন চিতোর রাণার পণ সাধিয়াছিল! পূর্বে তাহার মনোভাব কিছুই আমি অনুমান করিতে পারি নাই! অনতিবিলম্বে বিফল হইয়া সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম। অতঃপর কিংকর্তব্য?

      চারিপার্শ্বে দৃষ্টিপাত করিলাম। আধুনিক কালের অভিশাপে গৃহে সকলই আধুনিক সরঞ্জাম। সংসারের দূরদর্শনে শ্রুতি শ্রবণের বৃহৎ পরিবার। দর্শনীয় সামগ্রীতেও এমত নানাবিধ কাড়া-নাকাড়া বাজিতে থাকে সর্বদা। সময় ও মেজাজ ধ্বংসের বিশালসম্ভার। অনুকরণীয় সজ্জায় পুলকিত গৃহ।

      তাহাদের উপর শক্তিপ্রয়োগ করিলে অধিক অর্থদন্ড স্বীকার করিতে হয়। অবশ্যম্ভাবীরূপে সেইসমস্ত কার্য সমুচিৎ হইবে না! মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থপ্রসূত প্রবলতম জ্ঞান মুহূর্তে আমাকে সতর্ক করিয়া দিল। বুঝিলাম, ইহসংসারে বাহুল্য বস্তুর আধিক্যেও সম্পূর্ণ বিনষ্ট হই নাই আমি!

      অতএব অতীব আহ্লাদপুর্বক আনন্দিতচিত্তে অনুসন্ধিৎসু চক্ষুদ্বয়কে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিন হইতে উর্দ্ধ-অধঃ পর্যন্ত সমস্ত দিকেই ফিরাইয়া ঘুরাইয়া এইকোণ হইতে ওইকোণে সন্ধানকার্যে কিছুসময় ব্যপৃত রাখিলাম।

      হেনকালে বহুদিনের পুরাতন একটি পুজাসংখ্যা গোচরে আসিল। তৎক্ষণাৎ নট নড়ন চড়ন! অপলকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলাম। সুনামীর ধ্বংসপ্লাবন শুরু হইবার পূর্বেই যেন কেহ মন্ত্রবলে প্রস্তরমূর্তীতে পরিনীত করিয়া দিল অস্থিরমতি পাগল প্রায় আমাকে। দীর্ঘসময় ভোগান্তিতে ক্রোধে অন্ধ হইয়া হস্তস্থিত যন্ত্রটিকে আছড়াইয়া বিনষ্ট করিবার ইচ্ছা হইলেও সংযত হইলাম।

      আপৎকালে বুদ্ধিনাশের সম্ভাবনা অতি প্রবল থাকে। ভাবিতেছিলাম কিছুক্ষণ, বরুণদেবের কল্যাণে সেই মুহূর্তে তাহা হইতে মুক্তিলাভ করিলাম। বাহিরে মুহূর্তেই কাড়া-নাকাড়া বাজিয়া উঠিল। আচম্বিতে হৃদয়গভীরে আমূল বিদ্ধ ছুরিকার ন্যায় বিদ্যুতের চাবুক শতহস্তে আছড়াইয়া মারিল কেহ। মুহূর্তেই উন্মাদিনী বাঘিনী যে মিউমিউ বিল্লীতে রূপান্তরিত। থরথর কম্পমান ভীতমানবী সমস্ত উপদ্রপ ভুলিয়া গৃহকোণে প্রাণ বাঁচাইতে সচেষ্ট।

     উপুর্যুপুরী কড়াৎকড় মুহুর্র্মুহু্ বজ্রপাত! কর্ণপটাহ সমূলে উৎপাটিত হইবার দশা। প্রবল বেগে তান্ডবনৃত্য জুড়িয়াছেন শ্রাবণ সুন্দরী। অদ্যই বুঝিবা পৃথিবীর শেষতম দিবস। প্রবল পরিস্থিতি আনিতে পারিয়া সম্ভবত বর্ষসুন্দরী তৃপ্তচিত্তে খানিক শ্বাস ফেলিয়াছিলেন। জানিনা কাহারও করুণ অনুনয় বিনয় মানিয়া হয়ত ক্ষন্ত দিলেন।। কিম্বা আমাকে দেখিয়া তাঁহার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইয়াছিল, হইতেও পারে! সে যাহাই হউক, তাহাতে সকলের উপকার হইল। এতদসত্বেও আমি সেই পুস্তকটিকে হস্তচ্যুত হইতে দিই নাই। পৃথিবী শান্ত হইল, আমিও একটি অব্যবহৃত বস্ত্রখন্ড লইয়া পুস্তকটিকে ধুলি আচ্ছাদন হইতে মুক্ত করিতে সচেষ্ট হইলাম।

      প্রতিটি পৃষ্ঠার উপর সম্পূর্ণরূপে অবনত হইয়া বহুক্ষণের বিক্ষিপ্ত মনোভার লাঘব করিবার উপাদান সন্ধান করিয়া বেড়াইতে থাকিলাম। পত্রিকাটি একটি সৌজন্যসংখ্যা। সম্পাদকের নিকট হইতে উচ্ছসিত প্রশংসাবাক্য সহযোগে উপহার স্বরূপ প্রাপ্তি ঘটিয়াছিল বহুকাল পূর্বে। কোনো কারণে পরবর্তীকালে সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। নামটিও ভুলিয়াছিলাম, মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থে কিছুক্ষণ আলোড়ন করিয়া অর্থাৎ কিছুসময় ব্যয় করিয়া স্মরণে আনিলাম। 

      স্মরণে আসিল আরও অসংখ্য আনন্দক্ষণ, আলোকিত অতীত। দেখিলাম, আমার রচিত একখানি গল্পও রহিয়াছে। মুগ্ধ হইলাম, অশ্রুবাস্পে রুদ্ধ হইলাম এবং আশ্চর্যান্বিত হইলাম অতীতে আমাকর্তৃকই এ হেন সৃষ্টি হইয়াছিল কীভাবে! 

      নিজের নিজস্বতা অর্থাৎ স্বরূপ বুঝিতে সকলকেই পরিশ্রম করিতে হয়। আপনাকে আপনিই আবিষ্কার সহজ কর্ম নয়! সংসারজীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত সহিয়া অর্থাৎ আপনাকে আপনি দগ্ধ করিয়া অনাব্যশক খাদ পুড়াইয়া নিজেকে খাঁটি স্বর্ণে প্রস্তুত করা অতীব কঠিন পদ্ধতি। কাহারও কাহারও জীবনেও যা সাধিতে সাধিতে মানবজীবন হয়ত সমাপ্ত হইয়া যায়। যদিও সেই প্রচেষ্টা করিবার অভিপ্রায় কিম্বা সামর্থ কোনোটাই আমার ছিল না! তবুও আচম্বিতে এই সে যেন চিচিং ফাঁকের মন্তর!

    সহসা আমার সম্মুখে যেন অতুল ঐশ্চর্যের দ্বার উন্মোচিত হইয়া যাইল। এবং সেই অভিপ্রায়ে আত্মহারা আমি তাহাতে নিমগ্ন হইয়া মুহূর্তে জগৎ সংসার বিস্মৃত হইলাম।

    সময় সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতক হইয়াও আমি দীর্ঘসময় বহাইয়া দিলাম আমারই অলক্ষ্যে। ভুলিলাম, সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম আমারই অপেক্ষায় রহিয়াছে অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে। সেইক্ষণে, সমস্ত কিছুই ভুলিয়া যাইলাম!

      একক্ষণে হুঁশ আসিলে অতঃপর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে বাধ্য হইলাম যে, আধুনিকতার দোহাই দিয়া যতই আমরা অগ্রগতির নেশায় দৌড়াইয়া চলি কিম্বা যতই দৌড়ে চলুক জগৎসংসার, তবুও এইপ্রকার সামগ্রী ফিরিয়া দেখিতে যে অভুতপূর্ব আনন্দ হয় তাহা অতুলনীয়।
 
    এবং তাহা কোনো অত্যাধুনিক বিলাস বিষয়ক বিস্ময়কর যন্ত্রপাতি হইতে নহে, একান্ত সাধারণ একখানি কাগজ-কলম-মন নির্ম্মিত সাধারণ পুজাসংখ্যা হইলেও হইতে পারে। যাহাতে বহুসংখ্যক সাহিত্যপ্রেমী তাহাদের ভাবনা চিন্তায় সময়ের দলিল অঙ্কিত করিয়াছেন। যাহার সৌজন্যে এই অমূল্য সম্পদ আহরিত করিয়াছি সাময়িক তাহাকে বিস্মৃত হইলেও তাহারই সৌজন্যে নির্ভর করিয়া সংসারের অসার সময় এবং তাহা হইতে প্রাপ্ত মনোভার কমাইতে পারিলাম সানন্দে। আপনারা কী বলিবেন এক্ষণে?

      আশায় বাঁচিব, আশায়। আহত না হইয়া আশায় থাকিব।
      ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরনী, বহি তব সম্ভার, নয় কী?

পূর্ণপ্রভা ঘোষ: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন