আমি কর্ণপত্নি সুপ্রিয়া






দীর্ঘ কবিতা



"জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্

ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্ "

হে মহাভারত অহংকার

সূূ্র্যোদয় ও সূর্যাস্তের মুহূর্তে

দ্যুতিময় গভীর আহ্বানে ছিল

তোমার অখণ্ড  মেধা ও ধর্মের

এই মন্ত্র উচ্চারণ, যেখানে

জ্যোর্তিমণ্ডলের স্মৃতি ভারের

নির্মম সত্য তুমি  রূপকথা কর্ণ।

আজ এই একবিংশ শতাব্দীর

মাইলস্টোন পেরিয়ে তুমি  মিশে

আছো যার রথ আকাশ পরিক্রম

করে, সেই সূর্যরশ্মির স্পর্শে বিষন্ন

করুণ ইতিহাসে। যা অনেক

কাটাছেঁড়া করেও কোনও সিদ্ধান্তেই

পৌঁছাতে পারিনা  আমি আজও। 

হে আদিত্য সন্তান, তুমি  তো রবাহূত নও?

তুমি তো নিজ ইচ্ছেতে স্বর্গের ডেরা

ভেঙ্গে বেরিয়ে আসোনি ।

আমরা সবাই জানি তুমি নির্মোহ,

নির্বিঘ্ন  ঐহিক সূর্য তনয়।

যার অন্বেষণে আমার সহন,

প্রশান্ত বিষাদের মহানিস্তব্ধে

হয়ে আছে সমর্পিত।

নিজস্ব সত্তার কাছে বেদনা আচ্ছন্ন

চরম আহ্বানে  এখনও আকুল

তৃষ্ণাতুর রমণী আমি।  

সম্ভ্রমে চাতকের মতোন

তাকিয়ে আছি ঐতিহাসিক প্রজ্ঞায়।

তোমার অভিমানের আঁচ আমার

বুকে চেপে বসে আছে ।

সেই অভিঘাতের যন্ত্রণায় এই 

উথাল পাথাল। নাই বা বললাম

রমণ সুখ, কিন্তু  সূর্যের বীর্যে  

কুন্তী তো হল তোমার  ধারয়িত্রী।

বিস্ময় জাগে! মিলনে সচল  ইন্দ্রিয়!

তবুও নাকি এ সঙ্গম নয়।

এলোমেলো হয়ে যায় অনুমান।

আবার  প্রশ্ন জাগে নিয়তি  রচিত

তোমার অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্য নিয়ে।

এই পৃথিবীতে এখনও আদিগন্ত

জুড়ে হাহাকার, কান্না, বিপ্লব, ঘৃণা,

ক্রোধ, ব্যর্থতা, লোভ , ভ্রষ্টাচার  তবুও

তোমাকে জড়িয়ে মহাভারতের ক্ষীণতা -

ম্লানতার   যে নিষিদ্ধ ইস্তাহার। কেন যেন

আমি  সামলাতে পারিনা । মধ্য গগনের

গাঢ়  সূর্যটা ফ্যাকাশে করে তোলে

আমার মাতন। গহন বোধের আড়াল

থেকে বেরিয়ে আসে তোমার আবির্ভাব

লগ্নের তোলপাড়।

আমি তোমার পত্নী সুপ্রিয়া যে,

তোমার জীবন  জট খুলতে খুলতে 

দেখছি জগৎ পোষকের বিবেক

চেতনা। যিনি সৃষ্টি করেছেন

তোমার গর্ভ ধারণের অযত্ন লালিত

সমাচার, নিয়ন্ত্রণ করেছেন

তোমার গতি - বিধির ভাগ্যলিপি,

আর  আমাকে করেছেন

নীরস মরুর বাসিন্দা।

তবুও তুমি আমার  ভারতীয় মনে

বোধ  ও বোধির বেলাভূমিতে

ক্যাক্টাসের ফুল হয়ে আছো।

হে - কুন্তীর ধ্যানজাত সূর্যবীজ 

তুমি আলোর বীক্ষণ হয়েও কেন

হলে আঁধার পারের জ্যোতির্ময়। 

কেন হলে মৌনতার গভীরে নিমগ্ন।

তোমার গর্ভধারিণীর নির্ভুল মন্ত্রেই

তো তুমি স্পর্শ করেছিলে দ্যুলোক।

যেখানে ভরে আছে তোমার পিতা

জগৎ পোষকের সোনালি উজ্জ্বল

আলো। সেই প্রখর্য মণ্ডিত আলো কি

চন্দ্রমার মতোন তোমারও প্রাপ্য ছিল না?

হে সৌম্য বদন অনিন্দ্য সুন্দর - ইন্দ্রের

প্রার্থনা  পূরণের আশীর্বাদে দান মহিমায়

প্রদীপ্ত তুমি বিস্তৃত ও স্থায়ী হয়ে আছো

যশে ।  রাজকীয় গুণ, বীরত্ব, শ্রদ্ধা

ভক্তিতে  বিকশিত হয়েও সর্ব নিয়ামক

জগৎস্রষ্টা  তোমার ঔরসজাত পিতা

জগৎ প্রকাশে তোমাকে করেননি দীর্ঘজীবী।

আমাকে দিয়েছেন বৈধব্য উপহার। 

আমার ভীষণ ইচ্ছে করে তোমার ঐ

যাপিত জীবনের তথ্য বৃত্তান্ত নিয়ে

পৌঁছে যাই মেঘরঙা ঘোমটা খুলে -

খোলা আঁচলে বৃদ্ধ আদিত্যের কাছে !

প্রশ্ন করি, তুমি - তুমি কেন বাজালে

কর্ণের জীবনে অসময়ে মৃত্যু বীণ??

উপনিষদে কেন  লেখা হয়নি তোমার

বিদ্যা অবিদ্যার নিস্তরঙ্গ সংকুচিত রূপ!

টেনে খুলে দিতে মন চায় কুন্তির

অবগুণ্ঠন। কিন্তু পারিনা। ক্ষত বিক্ষত

বিদীর্ণ হয় হৃদয় আমার। শুধু গোপনে

শ্বাস ফেলি, ভাবি তুমি কেন এসেছিলে

ঐ অলৌকিক উৎসব থেকে মৃত্যুর ঘ্রাণ

নিয়ে। কেন অদ্ভুত নিশ্চিন্ততায়

তুমি তন্ময় মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিলে মৃতের

সারির মাঝে??! নাকি এটা বিধাতার

নিষ্ঠুর নিধন। যেখানে আমার আর্তি বয়ে

গিয়েছিল জলের স্রোতের মতোন।

তুমি সূর্যালোকের পথ ধরেই জড় তাপহীন

সহনশীলতায় অসম্ভব শক্তিতে রওনা হলে।

আমি পড়ে রইলাম মানবতার বলয়ে।

পরম করুণাময়  মৃত্যু এসে তোমাকে মুক্তি দিল।

শুরু হল আমার ঈশ্বর বিশ্বাসের অন্তর দহন।


চির সখা,  আমি এখনও অনুভব করি

তুমি আমার কে?  হিমালয়ের মত বিশাল

হৃদয় পুরুষ, দেবরাজ ইন্দ্র নিয়েছিলেন যাঁর

কাছে মহত্তর ভিক্ষা , সমুদ্রের মতোন যাঁর

বিস্তৃতি,  - আমি শুনেছিলাম বিস্ময়ে, সেই

তুমিই নির্দ্বিধায়  বলেছিলে শ্রীকৃষ্ণকে - ---

" হতে চাইনা আমি দ্রৌপদীর ষষ্ঠ স্বামী, 

পত্নীদের সঙ্গে আমার প্রেমের বন্ধন আছে "

তোমার ঐ মহাসুন্দর চোখে  সেদিন

দেখেছিলাম এক অকৃত্রিম পুণ্য দীপ্তি।

আজও যখন মনে হয় অর্জুন তোমাকে 

ঈর্ষা করেছিলেন , এমন কি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিও।

এক অনাবিল প্রশান্তিতে শীতল হয়ে আসে 

আমার অস্থির মানস। উপলব্ধি  করি

তোমার জীবন পরিচ্ছদে স্বভাবসিদ্ধ

পুরুষের পৌরুষত্ব। হে স্বামী,

তোমার আদর্শের বেষ্টনে আমি আজও

জাগরিত হয়ে আছি।

আমি জানি তুমি কর্তব্যে অব্যাহতি নয় -

একদিন তোমার সদর্থক ভাবনার মনন নিয়ে

অভিমানের অহংকারেই  খুঁজে পাবে 

হাজার হাজার বছরের জ্যোতিদীপ্ত পথ।

হে মহাভারত অহংকার -

আমার একাকিত্বের বেদনায় যখন

কোটি কোটি  কণ্ঠের হুঙ্কার বজ্রধ্বনিতে

এনে দিয়েছিল তোমার অনুপস্থিতি।

তখন এক রাতজাগা উৎসবে আমার

সম্মুখে এলো অদ্ভুত  সংশয়াতীত

শুদ্ধ প্রাজ্ঞ এক স্পর্শময় রাত।

আমার মৌলিক মনকে   সম্পৃক্ত করে

জানিনা  কোন দেবতা ঘটিয়ে দিয়েছিলেন

তোমার সাথের আমার অনুভূতির যোগ সূত্র।

 তুমি এলে সশরীরে আমার ঘুমের দরজা

ঠেলে - নৈঃশব্দে। পৃথিবীতে তুমি ,তোমার

আকাশে আমি  - এক নতুন আলোয়

কোমল আচ্ছন্ন। সেই আলোতেই দেখলাম

হিরণ্ময় তুমি, তুমি সন্ত, তুমি বুদ্ধ।

যে আমায় নিয়ে গেলে আর্মানি গির্জা,

সেন্ট জন গির্জা, সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল -

যেখানে শুধু ক্ষমা আর ক্ষমার নিদর্শন।

মৃত্যু গন্ধীর তীব্র চাপে যিনি  এক ফোটা

বিচলিত হননি। তুমিও তো তাই কর্ণ।

নিজের মৃত্যু দিয়ে অন্য মৃত্যুকে করেছিলে জয়।


তোমার ব্যাপ্তি ও গভীরতার কাছে সেই

রাতে আবার আমি  আত্ম সমর্পিতা হলাম।

দ্বিধা ও  সংকোচে সুরে সুরে বাধা হলাম দুজনে।

আমি জানি, একদিন ঠিক তুমি আমাকে

নিয়ে যাবে  তোমার নতুন উঠানে মৃত্যুর

দোসর করে। কিংবা তুমি আসবে

সংবেদী মনে তোমার আকাশটিকে নিয়ে,

মৃত্যু কাব্যের লুকানো সৃষ্টি থেকে এনে দেবে

ভালোবাসার অফুরন্ত ঐশ্বর্যের  ভাণ্ডার।

প্রিয় বোধে দেবে সান্নিধ্য।

নেমে আসবে স্বর্গ মর্তের  মেরুমিলনে।

এক অমৃত সৌভিক যোগ।


হে প্রিয় ,

আমার জীবন ভাণ্ডারের সুরায়

নাইবা হলো তোমার শরীরের শিহরণ।

কিন্তু আমার যন্ত্রণাকে হারিয়ে দিয়ে,

আমার ভাবনার  নিরাপদ নীড়ে তুমি

সৌরভ সুষমায় বিকশিত হয়ে আছো

ঈশ্বরের হাত ধরে। তোমার চিরায়ত

আলোয়  আমি উপলব্ধি করছি, দেখছি

প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ।

দেখছি নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়া  ব্যথার শোকে

আজকের সভ্যতা। ঘরে ঘরে বিচরণ করছে

দ্রৌপদী, কুন্তি, কৈকেয়ী, মন্থরা-রা।

দুঃশাসনও যেতে চাইছে সশরীরে স্বর্গে।

দেখছি সন্ত্রসবাদের মনস্তত্বের রক্তের

গন্ধ শুঁকা ঘৃণার সরণীতে সরণীতে যুদ্ধের

উল্লাসে মেতে ওঠা  আর এক মহাভারত।

যেখানে আজকের কৃষ্ণ ছোট্ট গোপাল হয়ে

ঠাকুর ঘরে বন্দী। কিন্তু আমরা পদ্মা, ভ্রুশালী,

সুপ্রিয়ারা পর্দার আড়ালেই আদিম প্রেমের

মৃদঙ্গ সুর বাজিয়ে চলেছি। প্রেরণা ও

জাগৃতিতে হয়ে আছি অনন্য স্বামীর

ত্যাগের ভুবন প্রসারী গৌরবের গরিমা।

আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে আছে এক

অলৌকিক স্মৃতিভারে স্বাক্ষর বহন করা

মহাভারতের শেষ্ঠ পুরুষ চরিত্র দানবীর কর্ণ।

যিনি  নিষ্ঠুর নিদ্রিত যাত্রায় প্লাবিত

হয়েও দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক থেকে রক্ষা

করেছিলেন পঞ্চপাণ্ডব জননী কুন্তিকে।

তুমি পেলেনা স্নেহময়ী মা।

হে মহাভারত পুরুষ শ্রেষ্ঠ, তোমার ঐ

সহিষ্ণুতার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদতে

মন চায়। অজস্র কান্নায়  ধুঁয়ে দিতে

ইচ্ছে হয় তোমার তন্ময় নিবিষ্ট কুয়াশা

আবরণ। আজকের সুপ্রিয়া আমি তোমার

দুর্বার টানে তোমাকেই ভালোবাসতে

ভালোলাগে কর্ণ। আমার প্রেম, আমার মন

এক রোমান্টিকতা খুঁজে বেড়ায়  তোমার

বীরত্বের জীবন উৎসব সমারোহে।

মহাভারতের  বিশাল ধর্মগ্রন্থের

এক কোণে লুকিয়ে রাখা তোমার

সহধর্মিণী সুপ্রিয়া আমি, চাই সর্বসমক্ষে

তোমার হাত ধরে যুগে স্বপনচারিণী হতে ।।।।


লক্ষ্মী নন্দী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন