প্রত্যাবর্তন



গল্প


          মাধবচন্দ্রের রাজ দরবারে কাজ প্রায় পাকা। বশির আয়াতুল্লা খাঁর অধিকৃত রাজপাটের আয়তন যতই ক্ষুদ্র হোকমেজাজ ও আদবকায়দায় নবাবি চাল না থাকলে মান থাকে না। এই মুলুকে নতুন আসা দুধ সাদা বেনিয়াগুলো সাধারণ মানুষজনকে নেটভবলে তাচ্ছিল্য করলেও বাদশাহী তথা নবাবি জাঁকজমক আর আতিথেয়তার গুণমুগ্ধ। সভা সাজানোর জন্য শুধু মন্ত্রী,  সেনাপতি,  কোষাধক্ষ্য এসব রাজপদ থাকলেই হয় না,  রাজাকে হতে হয় জ্ঞাণী-গুণীর পৃষ্ঠপোষকও। বাদশা আওরঙ্গজেবের মতো বাংলার নবাবরা বেরসিক নন। নাচ,  গান,  সুরার রীতিমতো সমঝদার। তাছাড়া কাব্য ও সাহিত্যচর্চা,  ইসলামিক অনুশাসনের জনহিতার্থে বঙ্গানুবাদ,  হিন্দু সাহিত্যের কৌতুহলবশত আরবি অনুবাদ এসব করানোর জন্য জ্ঞাণী ও গুণী মানুষের দরকার।
          হরিহর চন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র শুধু চারটি বেদ, সবকটি উপনিষদ, ষড়দর্শন নয়; পাঠ করেছে আরবি ভাষায় রচিত আসল কোরান,  হাদিশ, শরিয়তও। সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক ইত্যাদি নাস্তিক্য দর্শন পাঠে সে নাস্তিক হয়ে যায়নি; বরং আস্তিকতা ও বেদের পক্ষে যুক্তিগুলি ন্যায়শাস্ত্রর অস্ত্রে শাণিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছে। সে আরও দেখেছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশেষত নারী-পুরুষের অবস্থান নির্ণয়ে বেদপন্থী শঙ্করাচার্যের উপলব্ধি ও কোরানের দর্শনে আশ্চর্য সঙ্গতি,  মনুর বিধান আর হাদিশের অনুশাসনে দারুণ মিল এবং এরকম আরো কিছুকিছু। এই নিয়ে নবাবসাহেবের সাথে তার এক-আধবার আলোচনা করার সুযোগ ঘটেছিল এবং সেই সূত্রেই মাধবচন্দ্র পেয়েছে অনুবাদ ও সংশ্লিষ্ট বিধান বা সংহিতা রচনার কাজে হাত দেওয়ার বিশেষ উৎসাহ যা একপ্রকার নির্দেশেরই নামান্তর।
          কিন্তু প্রতিযোগিতা আছে। কান ভারি করা আছে। পিঠে ছুরি মারা আছে। আছে উৎকোচ স্বরূপ মহামান্য নবাবকে পঞ্চ ম-কারের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা যা সেই নারী সরবরাহের প্রথা। এ মোটেই নতুন কিছু নয়। মুসলমান শাসনের আগে থাকতেই নাকি এভাবে রাজপদ লাভের পথ কেউ কেউ দেখিয়ে গেছেন। এমনকি প্রভুর আদেশে আপন আত্মীয়াদের ব্যবহারও চলত। সম্রাট আকবরের হারেমের অধিকাংশ স্ত্রীদেহ আসত নাকি হিন্দু ঘর থেকেই। তবু কুলীন ব্রাহ্মণ মাধবচন্দ্র শঙ্কর বর্ণিত নরকের দ্বারগুলিকে স্বর্গের সিঁড়ি লাভের পথ হিসাবে কাজে লাগাতে পারেনি; বোধহয় মনুর সতীত্বনিষ্ঠায় বেধেছে। না হলে নারীর জন্য তাকে কড়ি ব্যয় করতে হোত না। নিজের বিবাহিতা সাতাশটি স্ত্রীর মধ্যে দু-একটি খরচ করা কী এমন ব্যপার? পাপ-স্খালনের জন্য না হয় বংশের কয়েকজন বিধবা থুড়ি সদ্যমৃতের সধবা সতী হবে। আরে বাবা,  চার ভাইয়ের মধ্যে মাধবেরই বা কেন এতগুলো পরিবার? সে তো তার নবাবসভায় খাতিরের জন্যই। কন্যাদায় গ্রস্তদের পার করতে আগ্রহী কুলীনের তো অভাব নেই। তার ভাইরাই তো মুখিয়ে আছে। কিন্তু জামাতা সভাকবি কি সভাপণ্ডিত হতে চলেছে,  এই উচ্চাশাতেই কি অনূঢ়া কন্যাদের পিতারা সাধ্যাতীত উচ্চ পণেও মাধবের হাতে কন্যা সম্প্রদান করেননি? তাছাড়া মহাজ্ঞাণী কৌটিল্য বলে গেছেন,  আত্মানাং সততই রক্ষেৎ ধনৈরোপি দারৈরোপিকিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত মাধব নবাব বশির খাঁর সুবিবেচনার ওপরেই আস্থা রেখেছিল। প্রতিদিন আট ক্রোশ পথ ঠেঙিয়ে,  নবাব হাভেলির পাহারাদারদের বিদ্রূপ সয়ে, তাদের টালবাহানা কাটিয়ে, মোসাহেব-ওমুকদার-তমুকদারদের প্রাচীর টপকে কোনওদিন স্বয়ং নবাববাহাদুর কোনওদিন তাঁর কোনও ঘণিষ্ঠকে নিজের নিবেদনটা রেখে আসা আর ফরমায়েশমতো নবাবের প্রশস্তিসূচক পদ-রচনা কি বৃথা যেতে পারে?
          কিন্তু কোথাকার এক মুর্শিদাবাদি পণ্ডিত যে নিঃশব্দে কোন অজানা কৌশলে বরেন্দ্র নবাবের হৃদয় জয় করে রেখেছে তা জানার পর মাধবচন্দ্রের আর কিছু করার রইল না। সভাপণ্ডিত পদটির জন্য মাধবচন্দ্র ছিল প্রায় অপ্রতিদ্বন্দী কী বৈদিক শাস্ত্রজ্ঞানে,  কী আরবি শিক্ষায়,  কী ইসলামিক সাহিত্যে! চাটুকার কয়েকজন অগভীর জলের কুচো মাছের প্রতি মাধবের অবজ্ঞায় স্বয়ং নবাববাহাদুর শুধু ইন্ধনই দেননি,  এই সেদিনও ঐ বিশেষ সম্মানজনক পদটির জন্য মাধবকেই যে তাঁর পছন্দ,  সে কথাও জানিয়েছিলেন। আর এখন বলছেন উপযুক্ত পদ খালি না হওয়া পর্যন্ত মাধবকে অপেক্ষা করতে। উপযুক্ত পদ মানে? নবাব তাঁর সভাসদদের নিয়ে এমন হাসি মস্করায় মেতে উঠলেন,  যেন মাধবের উপস্থিতি তাঁর চোখেই পড়ছে না। অথচ মাধবেরই রচিত পদ গেয়ে নবাবসাহেবের স্তুতি করছে চাটুকারের দল। অপমানে উদ্‌গত অশ্রু দমন করতে করতে মাধবচন্দ্র জিজ্ঞাসা করল,  হুজুর আমার অনুবাদকর্ম যে প্রায় শেষের মুখে। সেগুলোর কী হবে?”
          তাই তো সেগুলোর কী হবে?” বলে হুজুর হেসে গড়িয়ে পড়লেন। তারপর তাঁর পানপাত্র খালি থাকার জন্য সাকিকে অনর্থক বকাবকি শুরু করলেন। সুরারসিকদের আরও সুরা পানে আওহ্বান জানালেন। ইঙ্গিত স্পষ্ট।
          মাধব চোখের জল বাষ্পীভূত করতে করতে ব্রহ্ম রোদে নিজের বাড়িতে ফিরে এল। মুখে একটি কথাও নেই। স্নান সেরে শয্যা নিল। আহার করল না। অনেক অনুরোধে কেবল গৃহে উপস্থিত দুই স্ত্রীর প্রসাদ পাওয়ার নিমিত্ত উচ্ছিষ্ঠমাত্র করে উঠে গেল। এই দুজন যদিও প্রথমা এবং দ্বিতীয়া নয়,  তবু এদেরই শ্বশুরঘরে আনা হয়েছে। প্রথমা চিররুগ্না,  সেবা করতে পারবে না। বাকি পঁচিশজন তাদের পিত্রালয়ে থাকে। অধিক সন্ন্যাসীর সমাগমে তো লাভ নেই। মাধবপণ্ডিত বছরে দুবার করে গিয়ে প্রতিটি শ্বশুরবাড়িতে আপন স্ত্রীদের শয্যায় শয়ন করার বিনিময়ে নিজের পাওনাগণ্ডা আদায় করে আসে। সবার সাথে সব বার সংসর্গ হওয়া সম্ভব নয়। অনেক সময় শুধু দর্শনদান করেই ছুটতে হয় অপর শ্বশুরালয়ে। খুব একটা দর কষাকষি না করেও মাধবের রোজগার পঁচিশ,  না না,  মোট সাতাশটা শ্বশুরবাড়ি থেকে নেহাৎ মন্দ হয় না। পাণ্ডিত্য ছাড়া এজন্যও অন্য ভাইদের চেয়ে স্বগৃহে তার কদর বেশি। তার অনেক স্ত্রীই জননী হয়েছে। তাদের গৌরবই আলাদা। শ্বশুরবাড়িতে সকলের মন যুগিয়ে চলার চেয়ে পিতৃগৃহে মা,  ভ্রাতৃজায়া বা দাইদের হাতে হাতে সন্তান পালনের ভার ছেড়ে দিয়ে একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকাটা কোনো কোনও সম্পন্ন ঘরের মেয়েরা পছন্দই করে। সধবা মেয়ে,  বোন বা ননদকে দায় মনে হয় না,  হয় বিধবা হলে। তখন সংসারের হাজারটা কাজের দায় বর্তায় তাদের ওপর,  আমিষ হেঁসেল সামলানো বাদ দিয়ে।
          এই মাধবচন্দ্র রাজপদ হারানোর দিন কয়েক পর নিজের কিছু পুথিপত্র নিয়ে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল। এই কদিন সে চরম অবমাননার মধ্যেও আশা করে বসেছিল রাজসভা থেকে ডাক আসবে। এক সভায় দুজন পণ্ডিত থাকা কী এমন অস্বাভাবিক? নবাবের তো নবরত্নের শখ ছিল। মাধবচন্দ্র তো কাব্যচর্চাও করে। সভাকবি করলেও বেমানান হয় না। কত খামখেয়ালে তো কত কত টাকা ওড়ে! কিন্তু ডাক আসার বদলে একদা যেসব চুনোপুঁটিরা মাধবপণ্ডিতের অবজ্ঞার পাত্র ছিল,  তাদের বিদ্রূপ ভেসে আসতে লাগল। সুতরাং মা বাবার কেঁদে বুক ভাসল,  দুই সতীনের ভূমিশয্যা হল। কিছুটা দেরিতে হলেও দুঃসংবাদ পৌঁছল মাধবের অন্যান্য শ্বশুরগৃহগুলিতে। পঁচিশ স্ত্রীর কেউ কেউ একান্তে দাবি করল,  তারা থাকলে কিছুতেই স্বামী বিবাগী হতেন না। কুডাককারীরা সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল নবাবের প্রতি অষন্তোষ পোষণকারী নিশ্চই জীবিত নেই। মাধবের পরিবারেও তার মা বাবা পত্নীরা ছাড়া পাঁচ ভাইয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ এই সন্দেহ সত্য মনে করারই পক্ষপাতী। নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে মৃত ঘোষণা করার জন্য শাস্ত্রমতে বারো বছর না কত বছর যেন অপেক্ষা করতে হয়। ঝটপট রহস্যের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে ভাল হোত।
          কিন্তু নিখোঁজ স্বামীর মঙ্গলকামনায় দুই সতীন লক্ষ্মী আর অচলাসুন্দরী মাথায় মোটা করে সিঁদুর দেয়,  ফাটা পায়ে ডগডগে করে আলতা পরে আর মাধবকে ঘরে বেঁধে রাখতে না পারার জন্য একইরকম কটুকাটব্য পরিপাক করে। লক্ষ্মীর এক মেয়ে এক ছেলে,  অচলার একটি পুত্র। নেহাত নাতিদের খাতিরে তারা এখনও শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই পেয়ে আছে। তবে তাদের গৃহকর্ম হয়ে গেছে দ্বিগুণ। কাজ না থাকলেও তাদের বসে থাকতে দেখলেই সবাই জ্বলে ওঠে। এমন কি বয়সে ও মান্যে ছোট জা-রাও হুকুম চালাতে ছাড়ে না। অন্য ভাইরা দু-তিনটির বেশি দারপরিগ্রহের সুযোগ পায়নি। একজনের টোল আছে,  বাকিরা কোনও না কোনও মন্দিরের সেবাইত বা পূজারী। কুলীন বামুনের যজমানি করতে মানে লাগলেও তেমনটাও করতে হয় মাঝে মাঝে। কন্যাদায় উদ্ধার করে উপার্জনের প্রতীক্ষায় থাকে সকলেই। সেই সাথে নিখোঁজ ভাইয়ের ভাগটা যদি আপদ বিদায় করে নিষ্কন্টক করা যেত। চরম নিরাপত্তাহীনতায় দুই সতীন এখন প্রাণের সখী।
          মাস দুয়েকও হয়নি। লক্ষ্মী তখন উঠোন ঝাঁটাচ্ছিল,  অচলা কাপড় কাচা সেরে গা ধোবার আগে গোবরমাটি প্রস্তুত করছিল উঠোন নিকোবে বলে। এই সময় হরিহর চন্দ্রের চতুর্থ  পুত্র এসে হাউহাউ করে কান্না জুড়ে দিল। মা মাগো,  শুনে যাও। বাবা কি আছেন? সবাই শোন,  মেজদাদা আর নেই।মনোহর চন্দ্র সম্প্রতি নগরের একটি শিব মন্দিরের নিয়মিত পুরোহিত হয়েছে। পড়াশুনোয় খুব একটা মতিগতি কোনও কালে ছিল না। আর এখন তো মনে হয়,  পড়ে শেষ পর্যন্ত হবেই বা কী? সাতাশটা বৌ থাকতেও তো দেশত্যাগী হতে হয়।
          যদিও দেবর,  কিন্তু লক্ষ্মীর সমবয়সী আর অচলার চেয়ে সামান্য বড়। তাই ঘোমটাখানা আরও খানিকটা টেনে দুই সতীন বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মা পাকশালেই ছিলেন। ছুটে এসে শুধোন,  কী বলছিস নখোকা? মেজখোকার কী হয়েছে?”
          দেহ পাওয়া যায়নি মা। শুধু মেজদাদার পিরান পুঁথিপত্তরের পোঁটলা দেখে আর সন্দে্হ নেই,  যে সে আর বেঁচে নেই। রক্তের দাগ দেখে অনেকে বলছে সে কোতল হয়েছে,  নয়ত বুনো জন্তুর পেটে গেছে। যে নদীর ধারে তাকে মানে তার সামগ্রী পাওয়া গেছে তার ওপারেই তো বন। যদি কোতলও হয়ে থাকে তাহলেও দেহ পড়ে নেই,  শেয়াল নেকড়েয় খেয়েছে।
          বিস্তর বাদানুবাদ,  পাড়াপ্রতিবেশীদের সাক্ষ্য ও আলোচনার পর লক্ষ্মী আর অচলা ছাড়া সকলেই মেনে নিল মাধব চন্দ্র প্রয়াত। মাধবের বাড়িতে তিনটি সন্তান। দুটি তো এমনিতেই দুধের জন্য বায়না করে। বড় মেয়েটাও ঘটনার গুরুত্ব বুঝে কান্না শুরু করল।
          শাস্ত্রজ্ঞ ভ্রাতার অনুপস্থিতিতে সবাই পণ্ডিত। তাও মাতব্বর ব্রাহ্মনদের ও ভট্টাচার্যমশাইকে ডেকে আলোচনা হল। তাঁরা বিধান দিলেন,  একে গৃহত্যাগী তায় অপঘাতে মৃত্যু। অবধারিত নরকবাস। মৃতকে উদ্ধার পেতে হলে অন্তত তিনজনকে সহমরণে যেতে হবে।যার সাতাশটি পত্নী,  তার পরপারে সেবা যত্নের অভাব রাখা কি বিধেয়?
          লক্ষ্মী ও অচলার হৃদয় শোকের বদলে শঙ্কায় আঁতকে উঠল। ও দিদি আমার দেবু আর তোমার সনাতন যে এখনও মাই খায়। লতুটাও তো এখনও নিজের হাতে খেতে পারে না। আমাদের নিশ্চই মরতে বলবে না। আমাদের ছেলেপুলেগুলোকে মানুষ করবে কে?”
          ওদিকে সৎকারের দায়িত্বে থাকা দেবর ভাসুররা আর একজন সতীর খোঁজে মাধবের কাছাকাছির মধ্যে যে শ্বশুরগৃহ সেখানে তলব পাঠিয়েছে। মুকুন্দদেবের অবস্থা ভালো নয়; বহুবার জামাতার সাথে কন্যাকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এযাবৎ মেয়ের ভরণপোষণ আর জামাইয়ের দক্ষিণা দুটোই যোগাতে হয়েছে। নিজের ত্রয়োদশ বৎসরের কন্যাটির সাথে মাধবের অন্তর্ধানের কিছু পূর্বে সাক্ষাত হয়েছিল। তার কদিন পর থেকে তার খাদ্যে অরুচি,  বমি হচ্ছে। স্ত্রীলোকেরা সুসংবাদ সন্দেহ করছে। সর্বনাশ! হবু মাতামহ সাশ্রুনয়নে কন্যাকে চিরসুখী হওয়ার আশিস সহ পতিগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। গর্ভবতী নারীর সহমরণে যাওয়া যে অশাস্ত্রীয় সে কথা অথবা কন্যার গর্ভসঞ্চারের সংবাদ,  যে কোনও একটা তাঁর অজানা থাকলেই হল। মেয়ের মায়েরা তো নাকে কেঁদেই থাকে।
          অন্যান্য শ্বশুরালয়গুলিতে সংবাদ প্রেরণ ছাড়া বৃথা ধরপাকড়ের লোক পাঠানোর দরকার নেই কারণ বাকি দুই সতী পতিগৃহেই মজুত। সন্তানের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। তাদের কাকা-জ্যাঠারা আছে কী করতে? বাকিরা বৈধব্য ধারণ করে যে যার বাপের বাসায় ফিরে যেতে পারে। দরকার খুঁটিদুটোকে ওপড়ানোর।
          ও দিদি, আমার যে আজ দুদিন গো। শুনেছি অপবিত্তির শরীর নিয়ে সতী হওয়া চলে না।
          “আমা্রও আজ তিনদিন।
          “মাকে বলি? লজ্জা করে যে।
          “এখন লজ্জা পেলে চলবে? পুড়েও মরব,  আবার পাপও লাগবে! কমলাকে,  বিনুকে এদের বলি না হয়। বড়দিদিকেও জানাই চল।বড়দিদি মানে ভাসুর রাঘবচন্দ্রের প্রথমা স্ত্রী।
          মাধবচন্দ্রের অন্তর্ধান ইস্তক এই দুই সতীন মাধবের শোবার ঘরে পুত্র-কন্যাসমেত একসাথে শোয়। সপত্নীসুলভ কলহের বদলে গভীর সখ্যই গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে। কাজের ফাঁকে যার যখন সময় হোত পিঠোপিঠি দুধের বাছাদুটিকে আপন পর বিচার না করে স্তন্যপান করায়। তাদের ঋতুও এক আধদিন আগুপিছু করে মোটামুটি একই সময়ে হয়।
          লজ্জার কথা শেষমেষ বাড়ির এমনকি বাইরের পুরুষমানুষদের কানেও পৌঁছল। সবাই মিলে না জানার ভান করে কী করে? শ্বাশুড়ি-ঠাকরুন খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। তারা মরার ভয়ে মিথ্যা বলছে কিনা যাচাই করলেন। সত্যি জেনে প্রতিকার খুঁজতে বিধান চাইলেন। তাঁর আশঙ্কা চিতায় সুস্থ ও শুচী পত্নী না পেলে মাধব সর্বগুণ সত্বেও স্বর্গলাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। রক্তপাত সম্পূর্ণ বন্ধ না হলে ঠাকুরঘর তো নয়ই,  রান্নাঘরেও প্রবেশ তাঁর পছন্দ নয়; আর এদের যে একেবারে -! এখন দুজনকে যোগাড় করতে হলে তো পারলৌকিক কাজ, প্রায়শ্চিত্ত সবেতেই দেরি হয়ে যাবে।
          টোলের পণ্ডিত তৃতীয় পাণ্ডব ভেবে বলল, “বৌমারা, বৃথা মনে দ্বিধা রেখো না। মা,  তোমাকেও বলি -অগ্নির আর এক নাম পাবক। তাঁর স্পর্শে সবই শুদ্ধ হয়ে যায়। অনলদেব সর্বভূকও। তিনি শূচী-অশূচী সবই গ্রহণ করেন। এত বড় সৌভাগ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত কোর না বধূমাতারা। তোমরাই তো সঠিক অর্থে মাধবের ঘর করেছ। তোমাদেরই সহমরণে যাবার অধিকার সবচেয়ে বেশি। নিজেরা মহাপাতকী হয়ে আমাদেরও পাপে ডুবিও না। বরং স্বামীর সেবা করতে স্বর্গে যাচ্ছ তাই ভেবে প্রফুল্ল হও।এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে পেরে যাদবচন্দ্র বেশ গর্ব অনুভব করল। তাহলে শাস্ত্রব্যাখ্যা সেও পারে। ভট্টাচার্যমশাই পর্যন্ত যাদবের প্রশংসা করলেন।
          পরাশর সংহিতা যে মৃত বা নিরুদ্দিষ্ট পুরুষের স্ত্রীদের পুনর্বিবাহের পরামর্শ দিয়েছে,  সেসব যার জানা ছিল সেই তো নেই। সে অনেকেই তো অনেক কথা লেখে। আজকাল সনাতন হিন্দুধর্মে সেরকম ব্যাভিচারের চল আছে নাকি?
          তাছাড়া স্বামীকে ঘরে আটকে রাখতে না পারার প্রায়শ্চিত্তও তো করতে হবে। যে যার সন্তানদের আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদল। সারা জীবনের জন্য দাসত্বের অঙ্গীকার করল। কিশোরী বধূটি ওয়াক্  তুলতে তুলতে মূর্ছা গেল।
                   হুঁ! এসব ছলাকলা অনেক দেখা আছে। এরাই তো প্রথম নয়। তবে একসাথে তিনতিনজন সতী দাহ হবে এরকমটা বড় এক দেখা যায় না। রাজাগজাদের চিতায় একাধিক পত্নী এবং উপপত্নী সহমৃতা হন। কিন্তু সাধারণ যজমানী বা পণ্ডিত পরিবারে এমন রাজকীয় সৎকার? তা মাধবচন্দ্রের নবাবের সভাপণ্ডিত হবার কথা ছিল। জীবনটা না হোক,  মরণটা ঘটা করেই উদ্‌যাপন করতে হচ্ছে। সারা শ্মশানে বিরাট শোভাযাত্রা। তিন-তিনজন সিঁদুর আলতায় রাঙানো মানবী সারা গায়ে ঘি চর্চিত হয়ে কেউ স্বামীর ব্যবহৃত খড়মের সঙ্গে, কেউ শয্যার সাথে, কেউ নামাবলীর সাথে আগুনে প্রবেশ করতে চলেছে। কীভাবে তারা অপঘাতে মৃত মাধবচন্দ্রের আত্মাকে অনুসন্ধান করে স্বর্গারোহণ করে তা দেখতে মেয়ে পুরুষের ভীড় মন্দ জমল না। এমনকি নবাব বশির আয়াতুল্লা খাঁও খবর সংগ্রহের জন্য লোক পাঠালেন। তারা একটু দূরে একটা উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে লাগল। অবশ্য তিনজনের মিলিত আর্তনাদ সম্মিলিত জয়ধ্বণি,  ঢাক ও কাঁসরের শব্দে চাপা পড়ে গেল। তবু দূরের পথযাত্রীরা সেই বাদ্য ও কোলাহলে রোমাঞ্চিত হল। তাদের চোখ না হোক, কান সার্থক হল।
          চার বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। মুখমণ্ডল শ্মশ্রূল এক সাধুর রাজধানীতে আগমণ ঘটল। মাথায় জটার বদলে চূড়ো করে চুল বাঁধা। নবাবের নগররক্ষীরা ফকির দরবেশদের প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল, সাধুসন্তদের প্রতি তা না হলেও হিন্দু প্রজাদের ভক্তির প্লাবন ঠেকানো মুশকিল বলে এদের বিশেষ বাধা দেয় না। সাধু বাড়ি বাড়ি না ঘুরে সোজা হরিহরচন্দ্রের গৃহে উপস্থিত হলেন। ভিক্ষা চাওয়ার বদলে গৃহকর্তা ও গৃহিণীর সাক্ষাত চাইলেন।
          হরিহর ইতিমধ্যে প্রয়াত। তার বিধবা স্ত্রী পাঁচ-পাঁচটি পুত্র ও তিনটি সুপাত্রস্থ কন্যার গর্বিত জননী। তাঁর সতীত্ব এমনিতেই সিদ্ধ। আর বংশে একজন সতী হলেই সাতপুরুষ স্বর্গে বাতি পায়। তাছাড়া তাঁর ভাসুর দেওররা যে যার মতো আলাদা ভিটেয় প্রতিষ্ঠিত। ভ্রাতা ও ভ্রাতৃজায়ার ইহকাল পরকাল নিয়ে না ভাবলেও চলে। তাঁরা ব্রাহ্মণভোজন করে যথোপযুক্ত দক্ষিণা পেয়ে বিদায় হয়েছেন। ছেলেদের অবশ্য আর একটু পূণ্যার্জন হলে মন্দ হোত না। কিন্তু মোটের ওপর তাদের মা ইহকালেই অবস্থান করছেন।
          বাড়িতে তখন অভিভাবক শ্রেণীর পুরুষ বলতে তৃতীয় পুত্র যাদব হাজির ছিল। সে সাধুমহারাজকে দাওয়ায় বসতে বলে ভেতরে হাঁক পাড়ল, “কেউ এসে সাধুবাবাকে জল বাতাসা দিয়ে যাও।
          মা বেরিয়ে এলেন। পেছনে সেজর পরিবারের হাতে জলের ঘটি আর কলাপাতায় মোড়া বাতাসা।
          মা, আমায় চিনতে পারছ না?”
          প্রথমে ভূমিকম্প। তারপর আনন্দের ফল্গুধারা। সেজ ভাই সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে গোঁজ মেরে রইল। দস্তুরমতো নানা প্রমাণ দাখিল করে সন্ন্যাসী প্রতিষ্ঠা করলেন,  তিনি এবাড়ির দ্বিতীয়পুত্র মাধবচন্দ্র।
          কী আনন্দ! কিন্তু এ কী অনর্থ! মাধবের জিনিসপত্রকে তার প্রতিনিধি বানিয়ে সৎকার হয়েছে,  শ্রাদ্ধ হয়েছে। তার স্ত্রীরা শাঁখা ভেঙেছে,  নোয়া ছেড়েছে, সিঁদুর মুছেছে! কে জানে বাছার পরমায়ু কত কমে গেছে,  কত অমঙ্গল মাথার ওপর ঘনিয়েছে। মাধব কেন চলে গিয়েছিল,  কোথায় গিয়েছিল,  এতবছর কীভাবে কী খেয়ে কাটিয়েছে......প্রশ্নের শেষ নেই।
          মাধব উত্তরে শুধু বলল,  এবার ভাবছি টোল দেব। রাজা-রাজড়ার দিকে না তাকিয়ে।
          বেড়ায় গোবরমাটি লেপছিল যে মেয়েটি,  তাকে ডেকে মাধবের মা বললেন,  প্রণাম কর। তোর বাপ।
          ললিতা বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। এই লোকটা হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার জন্যই তার দু মাকে জ্যান্ত পুড়ে মরতে হয়েছে। একে প্রণাম করলে মায়েরা ফিরে আসবে? আর একজনের কচি মিষ্টি মুখটাও চোখে ভাসছে।
          মায়ের কাছে নিজের পরিবারদের সম্পর্কে জানতে চাইতে সংকোচ হচ্ছিল। মেয়ের প্রণাম নিতে গিয়ে সবই জানা হয় গেল। ছি ছিঃ ! আট বছরের মেয়ে,  বারো বছর হলে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে যাবে সে নিজের জন্মদাতা পিতাকে মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী ঠাওরাচ্ছে সবার সামনে। পিতা নিরুত্তর থাকলেও পিতামহী তিরস্কার না করে পারেন না।
          বাকি পঁচিশ মানে চব্বিশজন?” মৃদু স্বরে শুধল সাধু।
          “পণ্ডিতরা তিনজনের কথাই বলেছিল। বাকিরা সব বড় মানুষের মেয়ে কিনা, শাঁখা ভেঙে থান পরে যে যার বাপের বাড়ি ফিরে গেছে। এ বংশের অনেককটি ছেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের যথাসময় নিয়ে এসে সগ্গে যাব এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। এখন কী অনাসৃষ্টি কান্ড! সধবা মাগীরা বিধবার বেশ ধরেছে,  একাদশী করছে। তাদের কি নতুন করে এয়োতীর মযার্দা দেওয়া যায়? ও সেজখোকা! একটা উপায় বাতলা। সবার সাথে পরামর্শ কর।
          মেজছেলের সৎকার সুসম্পন্ন হওয়ার পর থেকে তৃতীয়পুত্র যাদবচন্দ্র শাস্তর জানা বামুন বলে একটু মান্যতা পাচ্ছিল। এখন মা শুধু তার পরামর্শে চলতে চান না। পণ্ডিতকুল বিধান দিলেন,  যেহেতু মাধবের বিবাহিতারা কেউ সতী হয়েছে,  বাকিরা বৈধব্য পালন করছে এবং তার শ্রাদ্ধাদি হয়ে গেছে,  সুতরাং মাধবচন্দ্রকে প্রকৃতই মরতে হবে। পরিবর্তে জন্ম নেবে মুরলীধর শর্মণ। এমনিতেই সে সন্ন্যাস জীবন কাটিয়েছে বলে পুর্বাশ্রমের নাম পরিত্যাজ্যই। নব জীবনে তাকে নতুন নামে অভিষিক্ত করে পুনরায় উপনয়ন দিয়ে একটি সুলক্ষ্মণযুক্তা ধর্মপত্নী উপহার দেওয়া গেলে অজ্ঞানে কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে।
          শাস্ত্র সংহিতা পুঁথিপত্তর আর কজন ঘেঁটে দেখেছে? ঠাকুরমশাইদের মুখের কথাই বেদবাক্য। আর তাঁদের বিধানে যাদবচন্দ্র ইশৎ মনোক্ষুন্ন হলেও আর সবাই তাতে মঙ্গলই দেখল। নবাবের পেয়ারের মুর্শিদাবাদি পণ্ডিত ছোকরার হারেমের এক তরুণীর পেয়ারে পড়ে প্রচুর জরিমানা দিয়ে নির্বাসন দণ্ডে দেশ ছাড়া হওয়া আর প্রেমিকাটির শূলে চড়ার খবর লোকের মুখে মুখে। সভাপণ্ডিতের পদ ফাঁকা।
          বাঙলার শাসনকর্তাদের কজনই বা দীর্ঘদিন সিংহাসনে আসীন থাকতে পেরেছেন? বশির খাঁর মসনদ দখল করেছে তাঁর ভাইপো। নতুন নবাবের তলব আসা মাত্র মুরলীধর শর্মা রাজসভায় হুজুরের দর্শন প্রার্থী। ভাগ্যিস অভিমানবশত নিজের রচনাগুলি   অগ্নিতে বা জলে বিসর্জন দেয়নি। ঠাকুরমশাইদের বিধান কি বিফলে যেতে পারে? মুরলীধরের ভ্রাতারাও এখন তার প্রতি বিশেষ প্রীতিশীল। দরবারে আরও পদ ফাঁকা হয়েছে বা সৃষ্ট হতে পারে। রাজ পণ্ডিতের নবজীবন আর নবপরিণয় প্রকৃতই পয়মন্ত বলা যায়। 

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন