কনে দেখা



গল্প


(এক)

টাটা ইন্ডিকাটা নিজেই ড্রাইভ করছিল শমীক সেই ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছিল গড়িয়ার বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতার প্রান্ত থেকে দ্বিতীয় হুগলী সেতু হয়ে মুম্বাই রোড, সেখান থেকে সোজা লোধাশুলি -ঘাটশিলা হয়ে নারোয়া পৌঁছাতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লাগে নির্জনতার ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করেই ড্রাইভারকে কোনওবারই সঙ্গে নেয় না শমীক এ যাত্রায় বহড়াগোড়ার কাছে রোড জ্যামে ফেঁসে ঘন্টা দুই দেরি হল এদিকে এলেই বড্ড বেশি করে মিতার কথা মনে পড়ে স্বভাব বাউন্ডুলে শমীক ঘরে থাকতে পারে না এক নাগাড়ে কর্মস্থলের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ হলেই কদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে সে এভাবেই মিতাকে হঠাৎ ঘাটশিলাতে আবিষ্কার করেছিল নতুনভাবে মিতাই তাকে নারোয়াতে নিয়ে এসেছিল তারপর থেকেই এই দলমা রিসর্টে ফাঁক পেলেই আসে শমীক, তবে এবারের আসাটা একেবারেই অন্য ধরণের

গাড়ি চালাতে চালাতেই দেখল শমীক ডানদিকের ভাঙা ব্রিজের গায়ে সারি সারি বাঁশের মাচা বেঁধে বিচিত্র কায়দায় সুবর্ণরেখা নদী থেকে মাছ ধরছে জেলেরা এরকম কায়দায় মাছ অন্য কোথাও ধরতে দেখেনি শমীক নদীর ধার ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে মুখ রেখে একটু এগোলেই তেরাস্তার মোড়। বাঁদিকে সুরদা হয়ে মুসাবনি তামার খনি, শমীক ডানদিকে বাঁক নিল পাহাড়ের পেট চিরে কিছুটা এগোলেই জাদুগোড়া ইউরেনিয়াম খনির জন্য নিরালা এই জনপদ এখন ভুবন বিখ্যাত নতুন রাস্তায় আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই বদলে গেল প্রকৃতি টাড়  টিলা আর জঙ্গল যেন বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে এসেছে রাঙা ধুলোর ঝড় পার করে ইন্ডিকা এগিয়ে চলেছে অচেনা রাজ্যে মূল রাস্তা ডানদিকে  চলে গেছে হাতা হয়ে টাটানগরের পথে বাঁদিকে সামান্য এগিয়ে যাওয়ার পরেই পাহাড়ভাঙা নদীর ওপর ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে শমীক পৌঁছাল  অনুপম সৌন্দর্যের দেশে নির্জনতার শেষ স্টেশন নারোয়াতে গাড়ীটা পথের পাশে রেখে নদীর ধারে একটা বোল্ডারে বসে পড়ল শমীক  মিঠে সোনা রোদের আদর খেতে খেতে পা ডুবিয়ে দিল মৃদু স্রোতে এ জায়গাটা সত্যি তার খুব প্রিয় শীত- বসন্তে এখানে চারিদিক আলো করে ফুটে থাকে অজস্র নাম না জানা ফুল হলুদ, বেগুনি আর গোলাপি রঙের আলপনার ফাঁক ফোকর দিয়ে নীচে বয়ে চলা নদীর টুকরো দৃশ্য যেন ফ্রেমে বাঁধানো ছবি এ দৃশ্য দেখতে হলে বহুদূর থেকে আসা শুধু নয় জীবনকে বাজি রাখাও যায় মিতার সঙ্গে সেদিন অতোগুলো বছর পরে না দেখা হলে এ জায়গাটা  কোনোদিনই দেখা হত না তার এমন স্বর্গ চিনিয়ে দেওয়ার জন্য মিতাকে সবসময়ই মনে মনে শাবাশি দেয় শমীক ওর কথা মনে হতেই আবার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল কি করে যে ঘটনাটা ঘটল কে জানে!

(দুই)

হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাতে বিয়ে সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল শমীক অবিবাহিত শমীক ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়ত নীল আকাশের নীচে অকৃপণ প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে, কখনও কাছে পিঠে কখনও বা দূরে  এমনই একদিন জাতীয় সড়কের ধারে সোজা এসে উঠেছিল গালুডি হলিডে হোমে ঘাটশিলা থেকে আট- নয়  কিমি দূরে গালুডি সুবর্ণরেখার বাঁধের ধারে সত্যিই মনোরম এদিক ওদিক ছড়ানো টিলার মাঝে হাট বসে ওখানে একটু নজর রাখলেই রাতের আলো আঁধারিতে দেখা পাওয়া যায় আদিবাসী নৃত্যের ধামসা- মাদলের মাদকতা ভরা বোলে, মাটির গন্ধে ও লোক সঙ্গীতের মন খোলা সুরে, রঙিন পোশাকে সজ্জিত আদিবাসী মাঝি মেঝেনদের মনে হয় সত্যিকারের ভূমিপুত্র এ অঞ্চলে হাটে টাটকা সব্জি ও হাঁড়িয়া বিক্রি করে নিষ্পাপ হাসিতে ভরা উজ্জ্বল মুখের মেঝেনরা শালপাতার দোনায় পিঁপড়ের ডিমের পসরা নিয়ে বসে থাকা গোলাপি শাড়ির মাজা রঙের মেঝেনদের শরীর লজ্জা দেয় শহুরে সুন্দরীদের
          
ঘুম কাতুরে শমীক সেদিন উঠল অনেক দেরিতে সকাল নটা নাগাদ চা- বিস্কুট খেয়ে বারান্দাতে বসে থাকল অনেকক্ষণ স্নান সেরে জলখাবার খেয়ে বেরোল মোরগ লড়াই দেখতে ঘন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা নদীর ধারে মাঠের মধ্যে বসেছে মোরগ লড়াই- এর আসর রাতে চৌকিদারকে বলে হাল্কা আঁচের হলকায় শিকে গেঁথে ঝলসানো মশলা ভরা মুর্গা খাবে রুটির সাথে, এই ভেবে চড়া দামে কিনে নিল লড়াইয়ে জেতা মোরগটিকে। ফিরে এসে বারান্দাতে বসেই চোখ পড়ল সাম্নের বাগানে মেলে রাখা একটা ভেজা শাড়ির দিকে অবাক হল শমীক কারা আবার এলচৌকিদারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানল ঝাড়্গ্রাম থেকে একজন দিদিমণি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন বেড়াতে প্রত্যেক পুরুষের মনে মহিলাদের নিয়ে স্বভাবজাত কৌতূহলের বয়স অনেকদিন পেরিয়ে এসেছে শমীক তাই আর কৌতূহলী হল না সে
              
পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে রওয়ানা হল ঘাটশিলার কাছে বুরুডি ড্যাম ও ধারাগিরি ফলস দেখার জন্যে সিংভুমের এ তল্লাটের বন, পাহাড় ও জল্প্রপাতের অনাঘ্রাত সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছাল বিভূতিভূষণের স্মৃতি বিজড়িত ফুলডুংরি পাহাড়ে পাহাড়ে উঠতে উঠতে দেখল এক ভদ্রমহিলা তাঁর স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে নামছেন নীচে চোখাচোখি হতেই হাসলেন খুব চেনা চেনা লাগছে  শমীকের কিন্তু চিনতে পারল না কিছুতেই লজ্জায় কিছু বলতে পারল না পরে শেষ বিকেলের হলুদ আলো আর কালো ছায়ার লুকোচুরির মধ্যে ক্লান্ত শরীরে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সেই মহিলা এসেই হেসে বললেন চিনতে পারছেন না মনে হচ্ছে?
     
এমন স্নিগ্ধ, শান্ত রূপের কোনও মহিলা বোধহয় চোখে পড়ে নি আগে বাঙালি মহিলাদের একটা সমাহিত কমনীয়তা আছে যা সত্যিই সম্ভ্রম জাগায় সদ্য স্নাতা ঈষৎ ভারি পরিচ্ছন্ন ভঙ্গিমার মহিলা এসে বসলেন সামনের চেয়ারে আবার একরাশ মুক্তোর হাসির ঝিলিক ছ্যাঁৎ করে উঠল শমীকের ভেতরটা; বহু যুগ বাদে মনের আরশিনগরে জেগে উঠল একটুকরো প্রতিচ্ছবি মিতা এতো বছর বাদেও হাসিটা একইরকম আছে
                                                              
(তিন)              
   
জামশেদপুরের ছেলে শমীক তখন কলকাতায় ব্যস্ত জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়নি তবু চাকরির সময় বাদ দিয়ে একাদেমিতে থিয়েটার দেখা, কফি হাউসে আড্ডা ভালোই লাগতো মা অনেক করে বললেও বিয়ের ব্যাপারে রাজি হচ্ছিল না সে এরই মধ্যে মামাতো দাদার বিয়েতে বহরমপুরে গিয়েছিল সোজাসুজি কলকাতা থেকে ওখানে গিয়েই শোনে  বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন মালদায় মেয়েটি খুব ভালো গান গায় দেখতেও সুশ্রী বাবার মুখের ওপর তারা ভাইবোনেরা কোনোদিনই  মাথা তুলে কথা বলে নি এ যাত্রাও তার কোনও ব্যতিক্রম হল না তবে মায়ের ওপর একচোট রাগারাগি করে বুঝল লাভ হবে না অগত্যা ঠিক হল কলকাতাতেই সে মেয়ে দেখতে যাবে যদিও যাওয়ার ব্যাপারটা  নিয়ম রক্ষার পর্যায়েই পড়বে কেননা বিয়ের দিনক্ষণও প্রায় ঠিক
         
মেয়েটির বাবা মালদার স্বনামধন্য ডাক্তার ওনারা কিড স্ট্রিটের স্টেট গেস্টহাউসে উঠেছেন সেখানেই এক পড়ন্ত বিকেলে শমীক বন্ধু দীপ, মেজদি ও ছোট ভাইকে নিয়ে উপস্থিত হল কনে দেখার শেষ পর্বে সূর্য ডুবে গেছে  ততক্ষণে চা- জলখাবারের পরে পরেই মিতাকে নিয়ে তার মা ঘরে ঢুকলেন
             
প্রথম দর্শনেই মিতাকে খুব ভালো লেগে গেল শমীকের তাঁতের শাড়ি পরনে সম্ভ্রান্ত চেহারার মিতার দিকে বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকতে থাকতেই একবার ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল তার হঠাৎ মৃদু ইলেকট্রিক  কারেন্টের মতো শিহরন ছড়িয়ে গেল মস্তিষ্ক থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল মেয়েটা তার অভাবনীয় সারল্যের মুখচ্ছবিতে, ঈর্ষানীয় শরীরী ভাষার সাবলীল স্পর্ধায় নিজেকে স্বর্গীয়রূপে সঞ্চারিত করে রেখেছে এমন স্বর্গীয় মুহূর্তেই সেই সুগন্ধি সন্ধ্যায় শমীক বাবা মায়ের পছন্দের তারিফ করে উঠল মনে মনে

মেজদি  বলাতে মিতা গান গাইবার আগে পারমিশান নিল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবার

ধীরে ধীরে শুরু করল

রোদন ভরা এ বসন্ত সখী কখনও আসেনি বুঝি আগে

দীপ বিস্ময়ে তাকাল শমীকের দিকে মুখে কিছু বলল না বটে, অবাক হল শমীকও এই সুন্দর মুহূর্তে এই গানটা কেন বুঝতে পারল না

গান শেষ হতেই কিছু বলার আগেই মিতাই প্রশ্ন করে বসল শমীককে

- আমি গান গাই শুনেছেন তো? আমি ফাংশন অ্যাটেন্ড করলে আপনার কি আপত্তি আছে?

-- না, না, আপত্তি কিসের? বিব্রত গলা শমীকের তির্যক ভঙ্গিতে পরবর্তী শেল ছুটে এল

-- আমি কুকুর ভালোবাসি, কুকুর পুষলে আপনার আপত্তি আছে?

উত্তর দিল না শমীক

-- আমি শাড়ি পরতে ভালোবাসি না, শাড়ি না পরলে আপনার আপত্তি আছে?

-বিরক্ত শমীকের মনে হল উত্তরটা ভালো করেই দেয়, শালীনতাবোধ তাকে গণ্ডী ছাড়াতে দিল না

এরপর মিতার বাবা মার অনুরোধে সবাই তাদের দুজনকে ওই ঘরে বসিয়ে বাইরে গেল ওদের সাবলীলভাবে কথা বলে নেওয়ার জন্যে।

বিরক্ত শমীক মনস্থির করে ফেলেছে এখানে আর রাজি হবে না সে, তাই চুপ করে থাকল সে

মিতা অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না, অনেক পরে নিচুস্বরে  বলল আপনাকে একটা কথা বলব বলব করে বলতে পারছি না আসলে আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা

রাগত শমীক বললে বলে ফেলুন, আমি গুছিয়ে নেব

- মিতা আবার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল

বিরক্ত শমীক বলল, কি হল? বলে ফেলুন

- দেখুন আমি ক্ষমাপ্রার্থী আমি আমার এক সহপাঠীকে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি, আমারই অন্যায় আমি আপনার বাবা মাকে আঘাত দিতে পারিনি আমার বাবা মাকেও বলতে পারছি না এখন আপনি আমাকে অপছন্দ বললে সবকুল রক্ষা হয় নতমস্তকে বললে মিতা

- তা এত নাটক করার কি দরকার ছিল?  আগে আমাকে জানালেই হতো

-  শমীকবাবু আপনি কি আমার বন্ধু হতে পারেন না? আমার জন্যে যদি এটুকু করেন

 -ঠিক আছে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি যা চাইছেন তাই হবে

মেয়ে অপছন্দ বলায় শমীকের বাবা মা তো চটলেনই মিতার বাবার পত্রাঘাত নিদারুণভাবে সইতে হল ভালোমানুষ লাহিড়ীবাবুকে আগেই ছেলের মতামত না নিয়ে এতদূর অগ্রসর হয়েছেন বলে

(চার)

এতদিন পরে মিতাকে দেখে ভালোই লাগল শমীকের তফাৎ চোখে পড়ল পরিণত বয়সে এখন অনেক গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে মিতা একলহমাতেই আপন করে নিল শমীককে শমীককে অবাক করে আপনিথেকে তুমিসম্বোধনে নেমে এল সে

শমীকদা বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে দুটো জীবনকেই নষ্ট করলাম আমিতো আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তুমি আর বিয়ে করো নি দোষ তো আমারই যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেও চলে গেল আমার মেয়ের চার বছর বয়সে স্টেটস এ সেটল করেছে খোঁজ খবর রাখে না প্রথম প্রথম টাকা পাঠাত কয়েকবার ফিরিয়ে দেওয়ার পর আর যোগাযোগ করে না আমি মেয়েকে নিয়ে ঝাড়্গ্রামে থাকি ছুটিতে ঘুরে বেড়াই তোমার সঙ্গে হঠাৎ এমন করে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি কী যে ভালো লাগছে বোঝাতেই পারব না

শমীক চুপ করে শুনছিল

- মিতা বলল, গভীর রাতে কখনও কখনও ঘুম ভেঙে যায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি তুমি কলকাতাতে এখন কি করছো? আমার তখন খুব কষ্ট হয় তোমার জন্যে

চৌকিদার চায়ের পট, চিনি,লিকার সব দিয়ে গেল পেয়ালায় চা, দুধ ঢেলে চিনি মেশাতে মেশাতে মিতা অনর্গল কথা বলছিল উল্টো দিকের চেয়ারে বসে অপলক দৃষ্টিতে মিতার দিকে দেখছিল শমীক

ছেলেরা বোধহয় এমনই হয় যে পেল সে সমস্ত পাওয়াকে মিথ্যে করে দিল যে পেলনা তার জন্য আজ মিতার আফসোস হঠাৎ তাকে মনে মনে সুখী করে তুলল এই পড়ন্ত বেলায়

অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে ঝিঝির ডাক ও জোনাকির আলোর আলপনার মধ্যে মিতা তার নরম হাত দিয়ে শমীকের ডানহাতটা ধরল আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে বলল

-শমীকদা, তুমিও তো ঘুরতে ভালোবাসো চলো এখানেই পাশে একটা জায়গা আছে আমরা মা মেয়ে একা যেতে সাহস করিনি তুমি আছো যখন চল যাই কাল সকালে, তোমারও জায়গাটা খুব ভালো লাগবে

আপত্তি করতে পারল না শমীক পরের দিন সকালেই তিনজনে পৌঁছাল নারোয়ার অবসররিসর্টে রিসর্ট থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে ওরা এসে  বসল নদীর ধারে একটা বোল্ডারে মিতার মেয়ে তিতলি ছুটোছুটি করে নদীর মধ্যে থেকে বেলেপাথর কুড়িয়ে নিচ্ছিল বোল্ডারে পা ঝুলিয়ে বসেছিল শমীক আর তার পাশে বসেই জলে পা ডুবিয়ে মিতা গুনগুন করে চাপা স্বরে গাইছিল

-মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায় / বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায় / হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায় / আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয় ...।

(পাঁচ)

গাড়ি চালাতে চালাতে শমীকের  চোখে পড়ল রাস্তার ধারেই  হাট বসেছে রবীন্দ্রনাথের বক্সিগঞ্জের শুক্রবারের বিশাল হাট নয়, এ অঞ্চলের ছোট্ট হাট।  দূর দুরান্ত থেকে, কাছে পিঠে গ্রাম গঞ্জ থেকে হেঁটে, সাইকেলে, ট্রেকারে আসা সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো  উপজাতি মেয়ে পুরুষদের ভিড় হয়েছে হাটে একদিকে  সব্জি শাড়ি গামছা লুঙ্গি প্লাস্টিকের চটিজুতো, নানা রকমের কাঁচের চুড়ি, টিপ, তার সাথে ইঁদুর মারা ওষুধ, মাছ ধরার পোলো, মুরগি হাঁস চাল ডাল থেকে কি নেই সেখানে আর একপাশে চা, তেলেভাজা আর জিলাপির দোকান

রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই কালো চিকন চুলে নিমতেলের গন্ধমাখা হাসি মুখের আদিবাসী মেয়েটি আমন্ত্রণ জানাল শমীককে ওর চায়ের দোকানে গরম গরম ফুলুরির সাথে চায়ের কাপে ঠোঁটে ঠোঁট ছোট্ট নদী পেরোতেই সামনে আদিগন্ত পাহাড় দূরে ধূসর দলমার রেঞ্জ সপ্তাহান্তের ট্যুরে ফুসফুসে এক ঝলক টাটকা বাতাস নেওয়ার আদর্শ জায়গা অনাঘ্রাত কুমারী জঙ্গলে পুটুশ ঝাড়ের সোঁতা গন্ধ শাল, সেগুন, অর্জুন,  গামহার তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসে আছে এলাকা জুড়ে সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁসে নাম না জানা অসংখ্য গ্রাম ছোট্ট  নদী  পেরোতেই বদলে গেল আকাশ আর পাহাড়ের রং নীল  আকাশে সাদা মেঘেরা সত্যি এদেশে পাহাড় চূড়ায় গাভীর মতো চরে  বাংলা পেরিয়ে আসা কনকনে শীতার্ত বাতাস থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছোঁয়াছুয়ি খেলছে আকাশ পাহাড় আর রিসর্টকে ঘিরে

...আর খানিক চলার পর উঁকি দিল  অবসর  রিসর্টের তাঁবু গুলো অনেকদিন পরে দেখে হঠাৎ মনে হল  ওই লাল-নীল-হলুদ- সবুজ নানা রঙের ছাউনি দেওয়া তাঁবু থেকেই স্বর্গের সীমানার শুরু  অসাধারণ  দৃশ্যপট   শাল  ও মহুয়ার জঙ্গল পেরিয়ে দু কদম হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ছবির মতো এই রিসর্টের  চত্বরে নামটাও সুন্দর – ‘অবসর’ রিসর্ট থেকে যেদিকে তাকানো যায় ছোট ছোট টিলা পাহাড় আর মন কেড়ে নেওয়া সবুজের সমারোহ অনাবিল নিস্তব্ধতার মাঝে শুধুই পাখির ডাক আর বহতা বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ পুটুস আর পলাশের জঙ্গলের বুক চিরে সরীসৃপের মতো কাঁকুরে পথ হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে  পাহাড়ের দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে থাকা দূরের গ্রামে মাঠের মধ্যে বসে মোরগ লড়াই এর আসর, হাঁড়িয়া বিক্রি করতে আসা নিস্পাপ হাসিতে ভরা উজ্জ্বল মুখের আদিবাসী মেয়েদের অনাবিল সরল জীবন যাত্রা এখানকার অহংকার সপ্তাহান্তের ছুটি তে ঘোরার আদর্শ জায়গা  রিসর্ট 

গাড়িটা  রিসর্টের হাতায় পার্ক করেই আবার মনে পড়ে গেল মিতার কথা ছুটে বেড়িয়ে চলে গেল নদীর ধারে ঘোর লেগে গেল শমীকের সেই প্রথম দিনে যে বোল্ডারে পা ঝুলিয়ে বসেছিল সেটাতেই গিয়ে বসল আবার

একা একা বোল্ডারে বসে থাকতে থাকতে পুরনো দিনে চলে গিয়েছিল শমীক মনের শিশমহলে মিতার স্মৃতি শিস দিয়ে যাচ্ছিল অহরহ মিতার জন্যে মন খারাপের মধ্যেও মনে হল ভাগ্যিস স্মৃতিটা আছে স্মৃতি হারালে সে মানুষের বেঁচে থেকে কি লাভ মিতাকে ভুলতে পারেনি তাই এখনও এখানে আসে বারে বারে মনে হয় এখানেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে হঠাৎ কাছে এসে বলবে চিনতে পারছ শমীকদা?

প্রথম যেবারে নারোয়াতে তাকে নিয়ে আসে মিতা, দুদিন থেকে যাওয়ার সময় বারে বারে অনুরোধ করেছিল ঝাড়্গ্রামে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে মনের মধ্যে মিতা সম্পর্কে একটা অদ্ভুত বোধ কাজ করত শমীকের ইচ্ছে করেই যায়নি সে কখনও এর মধ্যে মিতা তাকে চিঠি লিখেছে বেশ কয়েকবার শেষ চিঠিতে মিতা জানিয়েছিল

-মেয়ের চাপে আমাকে তার বাবার কাছে নিয়ে যেতে হচ্ছে শমীকদা ভেবেছিলাম তোমাকে জানাব না খবরটা আমি তোমাকে যতটা চিনেছি  তোমার কাছ থেকে কোনওদিনই জানতে পারব না তুমি ঠিক কি চাও? সংগত কারণেই তুমি হয়ত আমায় যেতে বাধা দেবে না তবুও জানালাম খবরটা মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছি নিশ্চয়ই আমার কথা মনে রাখবে এই ভেবে দুঃখ পাবে কি? জানি না\

দিন পরেই কাগজ পড়ে শমীক জানতে পারে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেন ক্রাশের খবরটা মিতা বা তিতলি কারও বডিই আইডেন্টিফাই হয় নি মিতা সত্যিই পৌঁছাতে পারল না তার বরের কাছে মিতার বাড়িতে শমীক কোনোদিন যেতে পারেনি তাই বারে বারে ফিরে আসে নারোয়াতে এখানে মিতাই তাকে প্রথম নিয়ে এসেছিল আজ আবার এই বিষণ্ণ মুহূর্তে কথাগুলো  চিন্তা করে অজান্তেই চোখের কোল জলে ভরে উঠল

দূরে একটা বেনেবউ পাখি ডাকছে শমীকের মনে হল পাখিটা তারই মতো, কোথায় বাসা ছিল জানে না কোথায় বাসা বাঁধবে পাখিটা তারও ঠিক নেই তফাৎ শুধু পাখিটার মতো  সে উড়ে যেতে পারবে না ইচ্ছে করলেই

ভাস্কর বাগচী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন