গল্প
এখন
সন্ধ্যা রাত। আগ্রা দূর্গের রংদার ছায়া মুছে গেছে যমুনার জল থেকে। শুধু প্রাকারের
সাঁঝবাতি রা জ্বলে গেছে অনেক ক্ষন।
শাহবুরুজ মহলের তিনতলার অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছেন, হিন্দুস্থান ই আজম বেতাবপনা বাদশাহ খান ই খানান উল মুলক জাহাঙ্গীর
খান। চোগা চাপকানের হীরে মোতি থেকে থেকে ঝলসে উঠছে জামেওয়ারের কাজে। তাঁর
হাতে সিরাজিতে আগের দিনের রাতে জমানো শিশিরের সাথে মেশানো আফিং গুলি। আর সাথে লাল
লাল চেরি। একটা একটা করে চেরি খাচ্ছেন হাতের হীরা ঝকমক করে উঠছে। আজ এই সময় বাদশা
জেনানা মহলে আসেন অভিযোগ শুনবার জন্যে। দাঁড়িয়ে আছে পাশে জেনানা ই দিওয়ান আর
ওয়াকেনবিশি দুজনেই। বন্দেগান ই হুকুম, বলে কিছু বলতে যেতেই
দুজনেই থমকে গেলেন খোদ মালেকা ই হিন্দুস্থানের, খাস তসরিফি প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে
পড়ল। তার মানে নুর ই আলম বেগম আসছেন। অনুচ্চ গলায় জেনানা ই দিওয়ান উচ্চারণ করলেন, তামাম হিন্দুস্থান কি
মালিকা ই জানম,
নুরে ই জান ফরমাইশ লে রহি হ্যায়---
বাদশা
সিরাজীর নেশায় তখন চমৎকৃত, আস্তে আস্তে বসে পড়লেন আট কোনা ছত্রী চেয়ারের গদ্দাতে।
মাথা তুলে দেখলেন হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ট সুন্দরী, জন্নত দিল মাশুকা নূর জাহান আসছেন। কালো মখমল আর
ভেলভেটের জৌলুলস ও ম্লান হয়ে গেছে স্বর্ণ
চাঁপা রঙে। কনক চাঁপা আঙুলে জড়ানো কমল হীরে, কানে গলায় সুদুর কান্দাহারী চুনোট চুনির হার আর দুল, ইস্পাহানী
কোমরবন্ধনীতে বসরাই মুক্তো বসানো মাথার ঝাপ্টায় গোলকুণ্ডার নীল হীরের
কারুকাজ। পায়ের নাগরাতে দু পাশে দুটি ইংলিশ দের উপহার দেওয়া পান্না। জাহাঙ্গীর
মাশুকাকে দেখতে দেখতে চোখ বুঝলেন তৃপ্তিতে। হিসেব মত মেহের এখন চল্লিশ বছরের প্রায়, তবুও তার ভঙ্গিতে এখনো
বালিকা সুলভ লাস্য! কাঁচুলিতে আঁটা যৌবন দেখতে দেখতে বাদশা অস্ফুটে বলে উঠলেন—
নীগাহ
সিনেসে উঠকর কাঁহা যায়েগা ভাই!
ওঁহা
তো হুশন কি দৌলত গড়ি হ্যায়!!!
মুখে
বললেন,
--
মেহের
মেহের আমি তোমার কে!
----
আপ হিন্দুস্থান কি বেতাব বাদশা মেরি দিল কি মালিক হ্যাঁয় হুঁজুর
--
হা হা করে হেসে উঠলেন চাঘতাই বীর জাহাঙ্গীর খান
দু
হাতে পাঁজা করে তুলে নিলেন বেগম জাদীকে, মুখ নামালেন সুউচ্চ স্তনে, হ্যাম সিরফ তুমহারে আশিক হু
-- মেরি জান!!
---তাই
যদি হয় আপনি আমার ভাই আশফ খানকে আপনার বড়ছেলে খসরুর আতালিফ কেন হতে দিলেন না!
খসরুকে অণু রায়ের হাতে ছেড়ে দিলেন! অনু রায় কে জনাবম! সেও তো চুনারের জাগীরদার
মাত্র।
মেহেরের
গলায় উষ্মা! টের পেলেন বাদশা। নামিয়ে দিলেন তাকে বাদশাহী ভেলভেট বসানো
হাতির দাঁতের দিবানে।
---বেগম, খসরু আমার অন্ধ হলেও বড় ছেলে। এই মসনদ, বাদশাহী বড় ছেলেরই
প্রাপ্য হত আজ। অণু রায় আমার খুব কাছের
জাগীরদার ওকে খসরু পছন্দ করে! আতালিক নয়
বাপ মানে! অণু থাকতে খসরু নিরাপদ মালিকা
---
এটা কোন কথা হল না, অণু
রায়ের থেকেও এই খানদানের অনেক কাছের লোক আসফ খাঁ। আমার ভাই, তোমার ছেলে খুররম এর
বিবি মুমতাজ মহলের পিতা---তাঁকেও বিশ্বাস নেই!
--আসফ
আপনার উজিরি ই আজম—
অধোবদন
হলেন বাদশা। কি করে বোঝাবেন পুত্র তার অন্ধ, অসহায় আর এই জন্যে তিনিই দায়ী, তিনিই সিংহাসনের লালচে
আকন্দর আঁঠা দিয়ে দিয়ে শেষ করেছেন তার চোখের জ্যোতিঃ। সেই সময় তিনি ছিলেন বাগী, শাহেনশাহ আকবরকে তার
নাতীকে সিংহাসন দেবার জন্যে চাপ দিচ্ছিল ইরানী লালী বেগমের জ্ঞাতিরা। রাজপরিবারের
রাজনীতি,
চাঘতাই
ইরানী সেই দ্বন্দ্ব! তার উপায় ছিল না। কিন্তু এখন! খসরুকে বুকে জড়ালেই চোখে জল চলে
আসে, তার এমন সিংহের মত বীর
সন্তান,
সে যদি
বাদশার পাশে দাঁড়াতো, ক্ষমতা
ছিল মহাব্বত খাঁর লাল চোখ দেখানোর! আজ খুররম না থাকলে সব শেষ, তাও সে কি ভাবছে আজকাল
বোঝাও যায় না! নুর নুর আমি যে পিতা! অক্ষম!
অসহায়!
মুখে
বললেন,
--
মেহের,
খসরু আমার
যোধপুরী বেগমের সন্তান। অনেক ছোটোবেলায় নিকাহ হয়েছিল কিন্তু আমার পহেলা আওলাদ, পহেলা হকদার! বেগমের চোখের দিকে তাকাতে পারি না! আমি অপদার্থ
পিতা!
---
শাহেনশাহ! খসরু দশহাজারী মনসব্দারী তামিল করে!
--
আর তুমি মেহের! ষাট হাজারী মনসবদারী!
---
মেহের উন নিসা স্তব্ধ হলেন-- অপমানে তার মুখ লাল হলো।
এক
সামান্য জায়গীরদারের বিবি ছিল সে, বাদশাহ তাই কি মনে করালেন!
---
রেহেম করো মেহের! রেহেম করো এক পিতাকে!
খসরু
অন্ধ, পারভেজ অপদার্থ, শাহরিয়ার অনেক ছোট! একা
খুররম মুঘল নিশান সামলে বেড়াচ্ছে। হেকিম সিরাজুদ্দিনের দাওয়াইতে কাজ হচ্ছে শুনলাম!
যদি খসরু তার আঁখ ফিরে পায়, ইনশা আল্লাহ আমি মোনাজাত করেছি আমিও পায়দল যাব সেলিম
চিশতীর দরগায়! বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন তামাম হিন্দুস্থানের মালিক!
---আপনার
আরো আওলাদ আছে জাঁহাপনা, পরভেজ কে জাগীরদারি বাড়িয়ে দিন। শাহরিয়ার ছোট আছে কে
বললে, হজরত আলা ওকে এবার একা
কোন সুবে তে পাঠান। শুধু খসরু আর খুরম কেই আপনি চোখে কেন দেখেন! আর অনু রায়ের
খসরুর আতালিক হবার কোন যোগ্যতাই নেই। আসিফ খাঁ আপনার ইমানদার হুজুর সেই থাক।
খসরুকে বুরহানপুর কিলায় পাঠানোর জন্যে শাহী ফরমান জারী করুন!
--
বুরহানপুর কিলা! মেহের, তাহলে তার চোখের নূর আর সে ফিরে পাবেনা যে! এত টা না
ইনসাফি আমি কি করে করি! এতটা বেরেহেম বাপ হতে পারে!
---
তাহলে খুররম এর মায়া ত্যাগ করুন বাদশা! সে কেন বাদশার জন্য এত যুদ্ধ করবে! মুঘল
সলতানাতের উপর তার যদি দাবী নাই থাকে!
বাদশার
মুখ থেকে কথা জোগালো না, এই নারীর কাছে তিনি চির ভিখারী। কি করে আটকাবেন এই
ফরমান! কিন্তু খসরু জানতে পারলে তার আলিঙ্গনপাশ ছাড়িয়ে নেবে! এমনিতেই বলে আপনি
স্বার্থপর এক পিতা। আমি আপনাকে চিনি ই না! নুর জাহান যাবার সময় চাঘতাই মাথাটি বুকে
টেনে নিলেন তার। উদ্ভ্রান্ত বাদশা জড়িয়ে ধরলেন বেগম কে।
---
একি আপনার সিরাজি শেষ দেখি বাদশা! ঢেলে দিলেন সুরাপাত্রে মুঘল সাম্রাজ্যের নূর, মালিকা ই হিন্দুস্থান
না
না, তিনি কিছু আর চিন্তা
করবেন না। দু বখত রোটী সিরাজী, আর মেহের থাকলেই হবে। বাদশা সিরাজী আর আফিংগুলি তুলে
নিলেন মুখে চেরির সাথে। নুর চলে গেলেন খিদ মহলে। তার মুখে জয়ের হাসি।
--
দূর্গের ভেতরে কি এত শলা পরামর্শ চলে
শাহজাদা!
আর্জুমন্দ
বেগমের সরাসরি প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলেন মুঘল সলতানাতের পাঁচহাজারী মনসবদার শাহজাদা
খুররম। তার ভ্রু কুঞ্চিত হলো! চিলমিল সরিয়ে তিনি শয্যায় গিয়ে বসলেন বেগমের পাশে।
--
শলা পরামর্শ আবার কি বেগম, উজির ই আজম আসফ খাঁ তোমার আব্বাহুজুর আর মালিকা ই
হিন্দুস্থান তোমার বাবার বহেন।
--
সেই জন্যেই ভয় শাহজাদা। আমি তো চিনি ওদের।
আব্বা হুজুর নিজের কথাই ভাবেন, আর মালিকা ই হিন্দুস্থান! তার কথা না বলাই ভালো।
-- এত বেহতমিজের মত কথা বলছ কেন আরজুমন্দ!
শাহজাদা
ক্রুদ্ধ হলেই নাম ধরেন বেগমের।
--
তমিজি কি করে রাখব সুলতান! আপনি দেখলেন
স্বয়ং শাহেনশাহ জাহাঙ্গীর তার খিদমতগার।
তার নামে মোহর বানানো হয়েছে! এর আগে কোনদিন শুনেছেন কোনো জেনানার নাম দিয়ে ফরমান চলছে!আব্বা হুজুর নয় অন্ধ কিন্তু আপনি!
বেগম হামিদা বানুর দিকে তাকানো যায় না। কতযুগ ধরে তিনি শাহজাদা খসরুকে ছেড়ে আছেন।
শাহজাদা খসরু দিল্লীর তখতের পহলা হকদার
শাহজাদা।
---
শাহজাদা ভেতরে ভেতরে অসহিষ্ণু হলেন।কিন্তু মুখে হেসে উঠে বেগমকে বুকে নিলেন। আর্জুমন্দ তার শাহজাদাকে জড়িয়ে ধরলেন বটে
কিন্তু খচখচানি থামল না।
গভীর
রাতে আরজুমন্দ ঘুমিয়ে পড়লে তার বুকের ভেতর গল তাকিয়া দিয়ে উঠে পড়লেন শাহজাদা।
কক্ষের
গবাক্ষ দিয়ে দেখলেন যমুনা স্থির শান্ত ভাবে জেগে আছে। চাঁদের আলো যমুনার গায়ে পড়ে
প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের আগ্রা দূর্গের গায়ে। শাহজাদার চোখের সামনে একটি নারী ভাসছে, জলতলের পদ্মের মত নুর ই
জাহান। কি আকর্ষণ! কিন্তু তিনি জানেন এই
মহিলা স্বার্থান্বেষী ক্ষমতালোভী আব্বা
হুজুর এর পদতলে বাঁধা তখত এ বসতে গেলে
মালিকাকে ক্রুদ্ধ করা যাবে না। কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে। তিনি মেপে নিতে চান
নুর জাহানের সুতো, তার বফাদার কুত্তাদের। অনেক
কায়দা করে সরিয়ে দিয়েছেন মহাব্বত খাঁকে-- সরছে অনু রায়, সুজামল খাঁ। আসফ খাঁ
বেগমের আব্বা যত ই হোক দামাদের বিপক্ষে দাঁড়াবেন না--- বাকি রইল খসরু আর
তার পুত্র দারারবক্স--- ঘুরে দাঁড়ালেন পরম মমতায় তাকালেন পর পর শুয়ে থাকা কচি ফুল
গুলির দিকে দারা, সুজা
আওরঙ্গজেব মুরাদ রোশেনারা
জাহানারা--- মনে মনে বললেন এই চার ফুল আর বেগম ছাড়া কেউ নেই আমার, কেউ নয়--
ভোর
হচ্ছে আগ্রা দূর্গে ফজরের নমাজে কিলাদার রা সুর মেলাচ্ছে। এ সময়ে যমুনার কালচে জল
পুরো গৈরিক লাগে। আকবরী দরজা দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে ফিরছে শাহজাদা শাহরিয়ার আর লাডলী বেগম। শাহজাদা যমুনার পাড় বড় পছন্দ করেন। নুর জাহানের
খাস তাতারনী এসে খবর দিয়ে গেল বাদশা বেগম
এত্তেলা দিয়েছেন তাদের।
---
এত ভোরে এ ভাবে একা একা বেরোনো ভালো নয় শাহজাদা।
বেগম তুমিও বা এ ভাবে সঙ্গে গেছ কেন? বারণ করেছি তোমায়! তুমি এখন
শাহজাদার বেগম। মুঘল সলতনাত তোমার কাছে সহবৎ আশা করে।
---
আম্মী হুজুর! আমরা রোজ ই যাই! আজ হঠাৎ
এই কথা!
নুর
জাহান তার দিকে তাকালেন না, শাহজাদার দিকে তাকিয়ে
বললেন
--আপনাকে
এবার জং করতে হবে। মেহফিল শিকার রুবাইয়া
বন্ধ করতে হবে।
--
আমি এ ভাবে ভালো আছি বাদশা বেগম
--
তুমি শুধুই শাহজাদা নয় হিন্দুস্থানের মালিকা উস জাহানের দামাদ ও।একদিন এই চাঘতাই তখত আপনার হবে ইনশালাহ
--
আমি খুব সাধারণ,
মাকে
দেখিনি,
শুনেছি
তিনিও খুব সাধারন ছিলেন। এই তখত, মুঘল আশরফি, জং, এই সব আমার নয় মালিকা-- আমি শান্তি চাই
---তোমার
মা ক্রীতদাসী হলেও তোমার আব্বাহুজুর বাদশা
ই হিন্দুস্থান। তিনি শুনলে একথা রক্ষা পাবেনাতুমি। নিজের দায় এবার বুঝুন শাহজাদা।
---
খুররম দাদা,
জনাব
দায়ারবক্স এরা আছেন বাদশাবেগম
---
খুররম বেশিদিন বাদশার অধীনে থাকবে না। আর দায়ারবক্স! আপনার অনেক পরে তার স্থান জনাব!
বুঝতে
পারছেন আমি কি বলতে চাইছি! দু দিন বাদের নওরোজ শুরু হবে, এইবার আপনি হজরত আলার সাথে ঝরোখা দর্শন দেবেন। আগ্রার লোক
ভবিষ্যতের বাদশাকে দেখে রাখুক!
শাহজাদা
শাহরিয়ার কিছু বলতে যেতেই, নুর জাহান গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন পরভেজ নালায়েক, খুররম দক্ষিণে, খসরু অন্ধ, সুযোগ কাজে লাগান দামাদ
জী! উজিরে আলম আসফ খাঁ ভাবে তার দামাদ
খুরররম তখতের পহেলা হকদার! বাদশা বেগমের
দামাদ জি কি করবে তবে! সলতনাতের বান্দা হয়ে গোলামী করবে!
শাহরিয়ার নুরজাহানের
দুচোখে আগুন দেখলেন।
সকাল
থেকেই মন টা ভালো নেই সম্রাটের। কাসীদ রা
খবর এনেছে রাজ্য জুড়ে টুকরো অশান্তির খবর। এবার বর্ষা কম হয়েছে
হিন্দুস্থান জুড়েই। প্রজারা কর দিতে চায়
না। মনসব দারেরা কি ছেড়ে দেবে! খুররম ক
দিনের জন্য এসেছে আগ্রায় আবার চলে যাবে দক্ষিণে।
এই সবল দক্ষম পুত্র টি দূরে থাকলে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। হাতের কররেখা
গুনতে চাইলেন তিনি। তিনি চান না খুররম দূরে যাক, তিনি চান পরভেজ নালায়কপন বন্ধ করুক, তিনি চান খসরু তার চোখের জ্যোতি ফিরে পায়, --আল্লা রেহম কর মেরে খুদা মনে মনে বলে উঠলেন। এত্তেলাদার এসে জানালো মহব্বত খাঁ বাদশার দর্শন চান
---
এসো এসো মহব্বত! আজ কাল দূরে দূরে থাকো মেরে দোস্ত
মহব্বত
খাঁ তার বাগী হবার সময় সাথেই ছিল।
বন্দেগান আব্বাহুজুর আকবরের বিরুদ্ধে তিনি
ও বাগী হয়েছিলেন কিন্তু আব্বা তাকে ক্ষমা নসিব করেছিলেন তার মত পুত্রের চোখে
জ্যোতি কেড়ে নেন নি!
---
হুজুরে আলা তো ঠিক করেই রেখেছেন আমাকে আগ্রায় আনবেন না! প্রথমে সেই লাহোর, তারপর দক্ষিণ, এখন বাংলা
---
মহাব্বত তুমি এখন বিশ হাজারী মনসবদারী তে
বহাল আছো। মুঘল সলতনাত তোমার বফাদারী মনে রেখেছে তো!
---
হা হা হা,
সহি বাত! হুজুর!
আমি আগ্রা থেকে কার ইশারায় চলে গেছি আমি জানি!
--
কার ইশারায়! বাদশা ভ্রু কুঁচকালেন!
--
গুস্তাকি মাফ বন্দেগান! বাদশা বেগমের
ইচ্ছাতে
--
স্তব্ধ হলেন বাদশা! এর নাম মহাব্বত খাঁ, উদ্ধত দুর্বিনয়ী কিন্তু যোদ্ধা, বফাদার
---
আমি মুঘল শাহজাদা পরভেজের আতালিক, হুজুর, সন্তানের দিকে নজর
রাখুন! তাকে আগ্রাতে ডেকে নিন--আপনি বাদশা, আওরতের আঁচল কি ধরবেন!
অনুযোগ
সুস্পষ্ট! মেহেরের দিকেই আঙ্গুল!
কিন্তু বাদশা কত অসহায় কে ই বা জানবে!
মোহাব্বত
খাঁ তাকে প্রায় হাত ধরিয়ে তখতে বসিয়েছিল। বাদশার প্রধান বফাদার সেনাপতি কিন্তু
মেহেরের নামে মুদ্রা কাটাতেই মহাব্বত খাঁ বিগড়ে আছে। মেহের ও না ইনসাফি করে
মহাব্বত কে আগ্রা থেকে দূরে পাঠিয়ে দিলো। এরা ভাই বোন কি চায়! বাদশা চিন্তামগ্ন হলেন।
--
জাঁহাপনা,
আপনার সিরাজি--
সকালের
বরাদ্দ সিরাজি আর খোবানি এসে গেছে। এসেছে কাবুলি পিচ ফল
বাদশা
হাতে ধরলেন রক্তের মত টলটলে
সিরাজীর
পানপাত্র! দেখতে দেখতে হাত থেকে খসে গিয়ে
মর্মর মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেলো।
বাদশা শঙ্কিত হলেন, ইয়া আল্লা এ কি চাঘতাই
শক্তির বিরুদ্ধে ঝড়ের সঙ্কেত!
মুবারক হো
হজরত,
মুবারক হো
-- কি খবর আজিমুদ্দিন! আজিমুদ্দিন বাদশার আজিজ
দোস্ত
--
শাহজাদা খুররম আপনাকে তার চতুর্থ পুত্র ভেট করেছেন
---
শুভানাল্লাহ! আল্লা আমার মুরাদ পুরো করেছেন। ওর নাম দিলাম মুরাদ--
বাদশার
আনন্দের মাঝখানেই বাদশা বেগম আসছেন খবর
পেলেন।
বাদশার
মনে পড়ে গেল বেগমকে কথা দেওয়া আছে তার হুকুম তামিল হবে।
ওয়াকেনবিশ
কে ডেকে বাদশা ফরমান দিলেন বিয়ানা থেকে খসরুকে বুরহানপুর পাঠাতে। তার নয়া আতালিক
হবে আসফ খাঁ। আর অনু রায়কে দিলেন স্বর্ণ মুদ্রা আর শাল। মনসবদারি বাড়িয়ে পাঠালেন
সুদুর গুজরাটে। ফরমানে কাল ই মোহর হবে। কিন্তু ভাবলেন খসরুকে সরিয়ে হটাৎ মেহের
খুররম কে সাহায্য কেন করছেন, সেতো মেহেরের চোখে
চিরকালের বাগী আওলাদ। আসফ খাঁ তো মুমতাজের পিতা----
তবে
কি মেহেরের চাঘতাই মুঘল যুবক নীল চোখের মণির মালিক সা জোয়ান খুররম, পাঁচহাজার জাইগীরদারির
মালিক হবু হিন্দুস্থান ই মালিক শাহজাহানের প্রতি অনুরাগ জন্মিয়েছে! বাদশা বুড়ো হতে
চলেছেন বলেই!
চিন
চিন করে রাগ ঈর্ষা তার শরীরের জ্বলে উঠল একবার! কোমরের কোতল তলোয়ার খানা চেপে ধরলেন, নাহ তিনি এত বুড়ো হন নি! তার শরীরেও তিমুরের রক্ত! হাতের
লাল পাঞ্জা মেলে ধরলেন! চওড়া পাঞ্জায় বাঘের জোর প্রয়োজনে আর এক আওলাদকেও---
ছি
ছিঃ কি ভাবছেন এ সব! খুররম তার শক্তি।
মুঘল বিজয় নিশান নিয়ে সে ছুটে চলেছে হিন্দুস্থানের বুকে, আর মেহের--
মেহেরের
কথা মনে হতেই তার নি: শ্বাস ভারী হয়ে এলো! সেকি এখনো শের খাঁকেই ভালোবাসে তবে! জল
হয়ে গেলেন যেন! ছিঃ কি ভাবছেন এসব! সে যা
হোক, করুক, তিনি হিন্দুস্থানের
বেতাজ বাদশা সকলের কাছে, তিনি জানেন তিনি শুধুই আশিক! বেপনাহ মোহাব্বত করতে পারেন
শুধু তার আশিকি কে, আর
তার কোন ক্ষমতা নেই! কিচ্ছু না!! এই মুলুক! বাদশা খান ইয়ে তখত, এই ক্ষমতা! এই
মোহর ছাপ!-- সব তার হোক তার---
বিড়
বিড় করে বলতে লাগলেন--
ইয়ে
ঈশক নহি আসান ইয়ে তো সমঝ লিজিয়ে,
ইয়ে
আগ কা দরিয়া হ্যায় ডুব কে জানা হ্যায়---
শুভশ্রী সাহা: কপিরাইট লেখক কর্তৃক
সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন