প্রবন্ধ
ক্লাসে
ঢুকেই ছেলেমেয়েরা ঠিক করলো আজ আর পাঠ্যবইয়ের পড়া নয়। আমার অঙ্ক ক্লাস, অথচ ওরা ‘ডাকঘর’ নাটকের গল্প শুনতে
চায়। এরজন্য অবশ্য আমিই দায়ী। গতক্লাসে অমলের কথা ওদের বলেছিলাম। বলেছিলাম কীভাবে
একটা মানুষ নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে সারা পৃথিবীকে দেখতে পায়। পরিবেশ ক্লাসে আমরা
একবার প্রস্তর যুগের খেলা খেলেছিলাম। সবাই কল্পনা করেছিল প্রস্তর যুগের পৃথিবী
কেমন হতে পারে। ছেলেমেয়েদের জেগে ওঠা এই কল্পনাশক্তিই বোধহয় অমলকে ওদের কাছে খুব
প্রিয় করে তুলেছে। বসন্ত অবশ্য অতটা আগ্রহী নয়। ঘন্টা মিনিটের হিসাবগুলো সে
কিছুতেই করতে পারছে না। তীব্র প্রতিবাদ করে বলছে, ‘না স্যার অঙ্ক করাও’।
আমি মনে মনে এক বুদ্ধি আঁটলাম। খেলাচ্ছলে জানালা তৈরি হল। একজন অমল সাজলো। তারপর
একে একে দইওয়ালা, সুধা, প্রহরী সবাই এল। প্রহরী সাজলো বসন্ত। সে
সময়ের হিসাব করে ঘন্টা বাজালো। পাশে একটা খাতা। আমরা ইচ্ছে মত অঙ্ক বাঁধলাম। একটা
বানানো ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সময় নির্মিত হল। তারপর চলল যোগ-বিয়োগ। দেখলাম
বসন্ত কি বিপুল আনন্দে সেরে ফেলছে ৮ টা ৩৫ এর ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর কখন ঘন্টা বাজবে, ১২টা বাজার ১ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে ঘন্টা
দিতে হলে কখন ঘন্টা পড়বে এসব জটিল হিসাব। দইওয়ালা নিপুণভাবে কিলোলিটার থেকে
লিটারের হিসাব করছে। সুধা ঝুড়িতে ফুল ভাগ করে রাখছে।
শিক্ষার্থীদের
গণিতভীতির একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে বলতে পারি- মূর্ততার অভাব। একটি খেলাকে সামনে রেখে তাদের
মধ্যে গণিতকে মূর্ত করে তুললে তারা অনায়াসে বিষয়টি আগ্রহভরে আস্বাদন করে। এদিকে
অমল ডাকহরকরা হতে চায়। সে রাজার চিঠি পৌঁছতে চায় দেশে দেশে। আমরা মাঝে মাঝে সংলাপ
বলি, মাঝে মাঝে অঙ্ক কষি। দূরত্বের অঙ্ক, সময়ের অঙ্ক, সাধারণ যোগ,
বিয়োগ।
শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে যে সমস্ত দক্ষতা বিকাশের দিকে নজর দিতে হয়, সেগুলি মোটামুটি ৫ রকম- প্রথম হল
অন্যান্য বিষয়ের সাথে সমন্বয় সাধন,
অর্থাৎ
শ্রেনিকক্ষে কেবল একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে পাঠদান অবৈজ্ঞানিক। বাংলা থেকে অঙ্ক, অঙ্ক থেকে পরিবেশ, সেখান থেকে ইংরাজি সব একসূত্রে গেঁথে
নিতে হবে। সবার আগে পাঠ্যাংশের কাম্য শিখন সামর্থ্যগুলি নির্দিষ্ট করে নিতে হবে।
বিমূর্ত গণিত মূর্ত হয়ে উঠতে পারে একমাত্র যদি বস্তুকেন্দ্রীক কর্মসম্পাদন বা
প্রকল্প ভিত্তিক পাঠদান করা সম্ভব হয়। আর বস্তুকেন্দ্রীক কর্মসম্পাদন করলেই
শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রসার ঘটে, সে খুদে সন্ধানী হয়ে ওঠে, যা শিখন দক্ষতার আরো এক ভাগ।
প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে ৫-৬ বছরের শিশুদের আরো একটি সমস্যা হয়, সংখ্যার কথ্য রূপ, লেখ্য
রূপ ও মূর্ত রূপের সঙ্গে সামঞ্জস্যের অভাব। গৃহপরিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা কিছুটা
হলেও গণনাসংক্রান্ত পূর্বজ্ঞান অর্জন করে।তারা জানে ‘এক’-এর পরে ‘দুই’, ‘তিন’। তারা জানে চাল অনেক, গাছ বড়, পেন্সিল ছোট। এবারে বিদ্যালয়ে তারা শেখে লেখ্য রূপে ১ ও ২। এখন
তাদের মুখে বলা ‘এক’ শব্দটি যে আদপে একটি বস্তুকে(বা
ব্যক্তিকে) ইঙ্গিত করে সেটা তারা গুলিয়ে ফেলে। এক বলার সাথে সাথেই অনেকেরই মনে ‘একটি বস্তু’ ভেসে ওঠে না। সমস্যাটা সেখান থেকেই তৈরী হয়। তাই পূর্ব পদ্ধতি
অনুসারে আগে এক থেকে একশো মুখস্থ করা তারপর না দেখে লেখা ইত্যাদি পথ অনুসরণ না করে, সংখ্যার কথ্য রূপ, লেখ্য রূপ আর মূর্ত রূপকে একত্রিত করা
প্রয়োজন। এক বলানো ও লেখানোর সাথে সাথে এক বললে একটি কাঠি বা বই বা একক কিছু বোঝায়
এটা শিখন-শিক্ষণ প্রদীপন দ্বারা উপস্থাপন করা উচিত।
সংখ্যার
কথ্য রূপের সাথে মূর্ত রূপ মনে ভেসে উঠল, কিন্তু
অনেকেই আবার সংখ্যার লিখিত রূপ ভুলে যায়, এর
কারণ অবশ্য অভ্যাসের অভাব। অর্থাৎ সংখ্যাগুলোকে কেমনভাবে লিখতে হবে তা বারংবার
অভ্যাস না করা। শ্রেণিকক্ষে এই অভ্যাসের ব্যাপারটাও আনন্দদায়ক করা যেতে পারে। আমরা
শিক্ষার্থীদের দুই দলে ভাগ করে নিয়ে একদলের বুকে সংখ্যার কথ্যরূপ ও অন্যদলের বুকে
লেখ্যরূপ লিখে দিয়ে ‘সন্ধান চাই’ এরকম নামের এক খেলা খেলতে পারি, যেখানে ‘ছয়’ লেখা শিক্ষার্থী অন্য
দল থেকে ‘৬’ কে খুঁজে নিয়ে জুটি বাঁধবে। সংখ্যা দিয়ে নানারকম আকার বা ছবি
বানিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখ্যরূপ শেখানো যেতে পারে। যেমন প্রি-প্রাইমারী ক্লাসের
(বয়স ৫ বছর) মনজিৎ মনে রেখেছে ১ লেখাটা সাপের মত, ২ হাঁসের মত,
৩
পাখির মত।“Mathematics is a
science of numbers”. তাই
সবার আগে প্রয়োজন ইন্দো-আরবীয় সংখ্যার ১০টি অঙ্কের সাথে শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট
পরিচয় ঘটানো।
ডাকঘর
চলছে, ঠাকুরদা ফকির সেজে তার কল্পনার কথা
জুড়েছে। আবীর ঠিক করলো ক্রৌঞ্চদ্বীপ আঁকবে। সে সেখানে নিজের ইচ্ছেমত ঝর্না কল্পনা
করলো, নিজের মত করে পাখি আঁকল। অনেকেই মনে
করেন গণিতের সাথে কল্পনার দূর দূরান্ত অব্দি কোনও সম্পর্ক নেই। এ এক কাঠখোট্টা, যুক্তিতে মোড়া, প্রক্রিয়া ও সূত্রের কচকচানিতে ভরা এক নিরস বিষয়। কিন্তু আমি
মনে করি গণিতই কল্পনা করতে শেখায়। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে
তুমুল কল্পনাশক্তি রয়েছে তা গণিত শিক্ষক/শিক্ষিকার ব্যবহার করা প্রয়োজন। একটি খুব
সাধারণ অঙ্ক নিয়ে আলোচনার প্রসার ঘটানো যাক। ক্রৌঞ্চদ্বীপে ৪টি বক মাছ শিকারের
আশায় বসেছিল, পাশের জঙ্গলে বাঘের
পায়ের শব্দ উঠতেই সবগুলি উড়ে গেল। তাহলে কটা বক রইল?’ এই ৪টি বক বলার সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের মনে মনে ৪টি বকের ছবি
ভেসে উঠেছে। বাঘের পায়ের শব্দ তারা কল্পনা করেছে, সব বকগুলিকে তারা কল্পনার দ্বারা উড়িয়েও দিতে পারবে। এখন তার
মনে একটা ফাঁকা জায়গা ভাসছে, সে উত্তর করবে, ‘স্যার, কিছুই নেই’ কিংবা ‘শূন্য’। এই শূন্য গণিতে এক নিষ্পাপ সন্ন্যাসী। সে একটি ধারণা বা
অবস্থান, যা শিক্ষার্থীরা উঁচু ক্লাসে শিখবে।
কিন্তু এখনই শূন্যের মূর্ততায় সে কিছু না থাকাটাকে কল্পনা করে নিতে পারবে। আর
তাদের কল্পনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন সমস্যা তাদের দিয়েই বানিয়ে নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা
ভাষামূলক সমস্যা নিজে বানাতে পারবে ও তার সমাধানও নিজেই করতে পারবে। বইয়ের বানানো
সমস্যার থেকে নিজের বানানো গাণিতিক সমস্যা বা বন্ধুর বানানো গাণিতিক সমস্যা সমাধান
করে শিক্ষার্থীরা বেশি তুষ্ট হয়। এটিই শিখনের তৃতীয় দক্ষতা ‘শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা’। ঠিক যেমন একটু আগেই বসন্ত বানিয়েছিল ৮
টা ৩৫ এর ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর কখন ঘন্টা বাজবে?
তাহলে
সমন্বয় সাধন, পর্যবেক্ষন বা খুদে
সন্ধানী হয়ে ওঠা, সমস্যা সমাধান এই তিন
দক্ষতার কথা হল। পর্যবেক্ষন সম্পর্কে আমি বিস্তারিত লিখিনি, এর কারণ এর গুরুত্ব সকলেই অনুধাবন করতে
পারেন। বিদ্যালয় পরিবেশ, গৃহ পরিবেশ সব
জায়গাতেই শিক্ষার্থীরা পর্যবেক্ষন দ্বারাই শেখে। একজন শিক্ষক বা সহায়কের কাজ এই
পর্যবেক্ষনের পরবর্তী ধাপটিকে জাগ্রত করা, অর্থাৎ যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহন। বসন্ত গত ৫-৬ টা গণিত ক্লাসে ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ডের
অঙ্কে পর্যবেক্ষণ করেছে যোগের ক্ষেত্রে মিনিট বা সেকেন্ডের ঘরে যোগফল ৬০ এর বেশী
হয়ে গেলে ঘড়িতে তা পাওয়া যাচ্ছে না। আজ সে হঠাৎই আবিষ্কার করতে পারল, ৬০ সেকেন্ডে এক মিনিট হয় বলে যোগফলে
সেকেন্ডের ঘরে যদি ৬০ এর থেকে বড় সংখ্যা আসে তাহলে সেখান থেকে ৬০ সেকেন্ড= ১ মিনিট
তুলে নিয়ে পাশে মিনিটের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে। তবেই ঘড়ির সাথে খাতায় করা সময়ের
হিসাব মিলবে। এই আবিষ্কারের আনন্দ প্রবল। সে এই আবিষ্কার মিনিটের যোগফলের
ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারলো, এবং বিয়োগের বৈপরীত্য
বুঝে ঘন্টা বা মিনিটের ঘর থেকে ৬০ ধার নিয়ে বিয়োগও করতে পারলো। এভাবেই প্রত্যেকের
পর্যবেক্ষন ও সর্বোপরি সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা জাগ্রত করা গেলেই শিক্ষণের কাজ
অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। উঁচু ক্লাসে তারা এভাবেই যে কোন সূত্রও আবিষ্কার করতে পারবে।
এবার আসি চতুর্থ শিখন দক্ষতার কথায়- ‘বিষয়ের
সাথে কৃৎকলা শিল্পের সংযোগস্থাপন’। কৃৎকলা বলতে ‘Performing art’ কে বোঝায়। ঠিক যেমনটা আমরা অঙ্ক ক্লাসে ‘ডাকঘর’ নিয়ে করছি। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের কাজ শিশুকে
সহায়তা করা। এক্ষেত্রে শিশুরা নিজস্ব আগ্রহ অনুসারে শেখে। আর আমরা জানি খেলার পরেই
শিশু মনে স্থান নেয় কৃৎকলা। অনেকের মধ্যেই এই আশঙ্কা জন্ম নেয় শ্রেণিকক্ষের ভিতরে
গণিত ক্লাসে নাচ, গান, ছবি আঁকা, হাতের কাজ বা নাটক হচ্ছে মানেই ক্লাসটা উচ্ছন্নে গেছে। অঙ্কে
গুরুগম্ভীর ভাবটা গুরু আর গুরুর ক্রিয়াকলাপে বজায় থাকা জরুরি। এই ধারণা এক্কেবারে
ভুল। শিশুর মনের সুকোমল হৃদবৃত্তিগুলিকে জাগিয়ে তুলতে, তার মনকে জানতে,
গুরুকে
বন্ধু হওয়া প্রয়োজন। ক্লাসে নাচ,
গান, নাটক হওয়া বা আনন্দের পরিবেশ থাকা মানেই
কিন্তু শৃঙ্খলার অভাব নয়। শৃঙ্খলা আসে স্বাধীনতা থেকে, কাজ থেকে। তাই শিশুরা কোনও কাজ আনন্দ সহকারে করতে করতে যদি
পাঠ্যবিষয়ের কাম্য শিখন সামর্থ্যগুলি অর্জন করতে পারে, তার থেকে ভালো কিছু আর হয় না। এখন প্রশ্ন আসে গণিতের সব বিষয়ে
কীভাবে নাট্যরূপ করা যাবে? কীভাবে কৃৎকলা শিল্প
আরোপ করা যাবে? মনে রাখতে হবে Teaching বা শিক্ষণ একটি ব্যক্তিনির্ভর
প্রক্রিয়া। মৌলিকভাবে শিক্ষক/শিক্ষিকার কর্তব্য পাঠ্যবিষয় সহজ করা আর তার
বহুমুখীনতা ও বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত করা। সেখানে যাতে কৃৎকলা
আরোপিত না হয়, বা জোর করে আনা হল
মনে না হয়। তিনি কোন ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করবেন এটা সম্পূর্ন তার নিজস্ব
ব্যাপার। তথাপি অন্তত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির কিছু কিছু এককের ক্ষেত্রে
নাটক, ছবি আঁকা, ক্রাফটস তৈরির সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘সহজ পাঠে’র ‘হাট’ কবিতাটি নাট্যরূপান্তরের মাধ্যমে সহজ
যোগ ও বিয়োগ উপস্থাপন, তৃতীয় শ্রেণির
মুদ্রার হিসাব সংক্রান্ত অঙ্কের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে শিক্ষক দিবস বা অন্যান্য
কর্মকান্ড পালনের আর্থিক ব্যয় ও আয়ের হিসাব করা ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে আমাদের
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা বহির্জগতের কাছ থেকে অনুভূতি লাভ করি, তাই শিখনে যতবেশী ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার
করা হবে (প্রদীপন দ্বারা বা কর্মসম্পাদন দ্বারা)শিক্ষণ ততবেশী পরিপক্ক ও
বিজ্ঞানভিত্তিক হবে।
গণিত
ভীতির আরও এক কারণ হল গৃহে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি। ছোট থেকেই শিশুকে বোঝানো হয় অঙ্ক
কঠিন, এটা বুঝে শুনে করতে হয়, ভুল হলে সব কাটকুট। শিশুমনে এই ভয়ের
উক্তিগুলি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। সে ভয় পেতে পেতে একসময় বিরক্ত হয়ে আগ্রহ হারিয়ে
ফেলে, নিজের অজান্তেই মনে মনে যুক্তি খাড়া করে
‘অঙ্ক আমার দ্বারা হবার নয়’। নামতা মুখস্থ করো, ফর্মুলা মুখস্থ করো, হাতের কর গোণা মুখস্থ করো, এসব বলতে বলতে আমরা একদিন বলি, অঙ্ক মুখস্থ করে হয় না, বুঝে নিয়ে করো। শিশু দ্বিধা দ্বন্দ্বে
ভুগে গণিতের প্রতি ভালবাসা হারিয়ে ফেলে। অথচ সে জানেই না, ঘরে বা বাইরে সে নিপুণভাবে গণিত প্রয়োগ করছে। সে টাকা পয়সা
যোগবিয়োগ করে দোকান থেকে জিনিস আনতে পারছে, বস্তুর আকারের পার্থক্য বুঝতে পারছে, অথচ এই বিষয়ই খাতায় কলমে তার কাছে বিভীষিকা হয়ে গেছে। মনে
রাখতে হবে, শিশু
শিক্ষক/শিক্ষিকাদের থেকেও বেশি সময় কাটায় অভিভাবক, অভিভাবিকাদের সঙ্গে। তাই সর্বদা সাহস সঞ্চার করে যেতে হবে।
প্রতিটি পিতা, মাতা, অভিভাবকদের আমার অনুরোধ শিশুর ছোট ছোট
গাণিতিক সমস্যা সমাধানগুলিকে এড়িয়ে যাবেন না, সামান্য এক আর একে দুই বললেও তাকে উৎসাহ দিতে হবে। আর তার মনে
সংখ্যা গুলিকে মূর্তভাবে গেঁথে দিতে হবে। এই দায়িত্ব কিন্তু আপনাদেরও। শিশুকে
দোকানে নিয়ে গিয়ে জিনিসপত্র বাছার সুযোগ দিতে হবে, তাকে হিসাব কষার সুযোগ দিতে হবে। পরিবেশ থেকেই ধীরে ধীরে সে
গণিতের চার প্রক্রিয়া আহরণ করবে,
যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ।
এই চারটিই গণিতের মৌলিক ধাপ।
দক্ষতাগুলির
মধ্যে শেষ এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন ধাপ হল ‘শিশুকেন্দ্রীক শিখন পরিচালনা’। শিক্ষা প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থাকবে শিশু। তার চাহিদা অনুসারে
পাঠের গতিপ্রবাহ স্থির হবে। এই চাহিদা সকলের সমান হয় না, তাই বহুমেধার দল গঠন করে পাঠদান করা উচিত। একটু এগিয়ে থাকা
শিক্ষার্থী আর একটু পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থী এক দলে থাকলে দুজনেরই উপকার, একে অপরকে সাহায্য করতে পারবে।
একটা
সমস্যার কথা সংক্ষেপে বলে নি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
শিশুরা প্রায়সই স্থানীয়মানের ধারণাতে আটকে যায়। কারণ ওই মূর্ততার অভাব। তবে এ
মূর্ততা একটু অন্যরকমের।‘সাতাশ’ বললে সাতাশটি জিনিস শিশুর মনে নাও ভেসে
উঠতে পারে। কারণ সে সচরাচর তার পরিবেশে এই সংখ্যার বাস্তব কিছু গণনা করে নি। তাহলে
কি সেই মুখস্থ? না। মাথায় রাখতে হবে
আমরা বলি, ‘দুই দশ সাত সাতাশ’ এই দুই দশই হল আমাদের পথ। আমরা
শিক্ষার্থীদের দশের ধারণা অনায়াসেই দিয়েছি, তাই দশের দল গঠন করে সাতাশের ধারণা দিতে হবে। দশটি কাঠিকে
সুতোয় বেঁধে নিয়ে দল গড়া যেতে পারে। তারপর দুটি দশ আর সাতটা খোলা কাঠি নিয়ে সাতাশ
গঠিত হবে। বড় সংখ্যা গুলিকে শিশুরা এইভাবে মূর্ত করতে পারবে। আর সাথে সাথে গণিতের
এক যুগান্তকারী বিষয় শিখবে- স্থানীয়মান। এক থেকে একক, দশ থেকে দশক,
এক
শত থেকে শতক এভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। এককের কাঠিতে বা ঘরে যখন ৯ টার
বেশী বল বা কার্ড রাখা গেল না তখন ১০ করতে হলে নতুন ঘরের দরকার হল, সেই ঘরটাই হল দশক। এইভাবে ক্রমানুসারে
স্থানীয়মানের ধারণা দান করা যেতে পারে।
দুটো
দিকে আলোকপাত করা দরকার, প্রাচীন ‘হাতে রাখা’ প্রক্রিয়াটি আমাদের মধ্যে এখনও ব্যবহৃত হয়। এতে যুক্তিবোধ গড়ে
ওঠে না। শুধুমাত্র প্রক্রিয়ার আদব কায়দা মনে রাখার কৌশল হিসাবে এটি শিক্ষার্থীদের
মনে গেঁথে দেওয়া হয়। শ্রেনিকক্ষে সে একরকম শেখে, আর গৃহ পরিবেশে একরকম। তাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ‘হাতে রাখা’ প্রক্রিয়া বর্জন করে- কেন দশের থেকে বেশি হলে দশকের ঘর বেড়ে
যায়, বা বিয়োগের ক্ষেত্রে কেন পাশের ঘর থেকে
দশ ধার নিতে হয়, এই যুক্তি
শিক্ষার্থীদের মনে স্পষ্ট হয়ে গেলে তারা উপকৃত হবে। গণিত একটি ক্রমান্বয়ী বিষয়।
এখানে একটি শেখায় ফাঁক থেকে গেলে সারাজীবন নানা বিষয় শিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়।
তাই গণিত অনেকের কাছে কঠিন। এখানে শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বেশি। তাকে নির্ণায়ক
মূল্যায়ন ব্যবহার করে প্রতিটি শিক্ষার্থীর দুর্বলতার জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। কেউ
হয়তো একসংখ্যার বিয়োগ পারে, কিন্তু স্থানীয় মানের
বিয়োগ পারে না। এক্ষেত্রে কর্মপত্রে একসংখ্যার বিয়োগ, স্থানীয়মানের বিয়োগ, শূন্য
ব্যবহার করে বিয়োগ নানাপ্রকার সমস্যা দিয়ে জেনে নিতে হবে শিক্ষার্থীর ঠিক কোন
শেখার জায়গায় ফাঁক থেকে গেছে।
ঘন্টা
বাজে, আমাদের অমল রাজার চিঠি দুয়ারে দুয়ারে
পৌঁছে দিতে উদ্যোগী। কিন্তু সময়ের অভাব। খেলা চলতে থাকে ক্লাসের পর ক্লাস। অমল, অমলকান্তি কখন এক হয়ে যায়। পঞ্চাশ
মিনিটের খেলা শেষে শিশুমুখে ঝরে পড়ে পবিত্র হাসি। কোনও অ্যালজেব্রিক এক্সপ্রেশনে
তা প্রকাশ করা যায় না। দেখি আমার অলক্ষ্যে নুড়ি পাথর দিয়ে কখন ওরা একটা সত্যি
সত্যি ডাকঘর বানিয়েছে। সুধা এক আঁচল ফুল এনে বলছে, ‘অমলকে বোলো সুধা তাকে ভোলে নি।’
স্নেহাশিস ব্যানার্জ্জী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন