মঙ্গলকাব্য ও সমকালীন সমাজ বাস্তবতা



প্রবন্ধ

যুগে যুগে সাহিত্যে নতুন ধারার প্রবর্তন করার প্রয়াস চালিয়ে যান নবীন প্রজন্ম,তাদের মধ্যে ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা, ভেঙ্গেচুরে দেওয়ার কথা বেশ সোচ্চারে উচ্চারিত হয়, যেন নতুনতর সৃষ্টিতে পুরাতন পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরকম প্রয়াস নানা সময়ে হয়েছে কিন্তু কোন স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেনি। ঐতিহ্য বা শিকড়কে অস্বীকার করে কোন সাহিত্যধারা কোনকালেই গড়ে উঠতে পারেনা, স্থায়ী হতে পারেনা। বাংলা সাহিত্যের মূল ধারাকে ভেঙ্গে দাও, চুরমার করে দাও এমন হুংকার খুব শোনা যায় আধুনিক কবিকূলের একাংশের কাছ থেকে। সাহিত্যে নবনব নীরিক্ষা নিয়তই চলতে থাকে- সেটাই সেই সাহিত্যের বেঁচে থাকার লক্ষণ কিন্তু তা কখনোই সেই সাহিত্যের মূল ধারাকে অস্বীকার করে নয় – বরং মূল ধারাটিকে আরো ঐশ্বর্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে – এটাই কাম্য। বাংলা সাহিত্যেতো বটেই সব সাহিত্যেই গদ্য এসেছে কাব্যের অনেক পরে আর বাংলাভাষার যে প্রথম লিখিত রূপ পাওয়া গেছে তা কাব্য – গীতিকাব্য, সাতচল্লিশটি গীতিকবিতার সংকলন’চর্যাগীতি’ যা পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেছিলেন। চর্যাগীতির সময়কাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। আশ্চর্যের বিষয় চর্যাগীতির পর, চতুর্দশ শতব্দী পর্যন্ত অর্থাৎ  দুশ’বছর বাংলা সাহিত্যের আর কোন লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায়না। আমরা জানি দ্বাদশ শতাব্দীতে এদেশে বারংবার পাঠান আক্রমণ হয়েছে আর ঐ শতাব্দীতেই মুহম্মদ ঘোরি এদেশে স্থায়ী ইসলামী শাসনের সূচনা করেন (১১৯২)। ফলে বাংলার সমাজ জীবনে দারুণ বিপর্যয় ও বিশৃংখলা দেখা দেয় যার পরিণতিতে সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যের মূল ধারাটি ছিলই লৌকিক গান, পাঁচা্লী,ব্রতকথা এইসবের মধ্যে। তারপর চতুর্দশ শতাব্দীর প্রাক-চৈতন্য ও পঞ্চদশ শতকের চৈতন্যযুগে বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্যে সাহিত্যের পুনর্গঠন শুরু হয়। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে শিরোধার্য করি। ’বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে সুনীতিকুমার মন্তব্য করেছেন” বাংলা ভাষার জন্মমুহুর্তেই যে তাহার সাহিত্য নিজের মূল ধারা বা মূল সুর, অর্থাৎ গীতিকাব্য  খুঁজিয়া পাইয়াছিল ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাহা না হইলে আজ বাংলা সাহিত্য জগতের প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যের মধ্যে স্থান গ্রহণ করিতে পারিত কিনা সন্দেহ। কি সেই সৃষ্টিলগ্নের সাহিত্যধারা? সুনীতি কুমারই নির্দেশ করেছেন”জয়দেবের কাব্যে এবং বৌদ্ধ গানগুলিতে যে গীতিকবিতা ও পদাবলীর যাত্রা শুরু হইল এই ধারা পরবর্তী কালে বৈষ্ণব কবিদের কাব্যে অশেষ রস ও শক্তি সঞ্চয় করিয়া বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারা রূপে পরিণত হইয়াছিল। আধুনিক সাহিত্যের মধ্যেই গীতিকাব্য রূপে এই ধারাই খাত বদলাইয়া নিরন্তর প্রবাহে অক্ষুন্ন গতিতে চলিয়াছে”। অর্থাৎ মানুষই সাহিত্যের মূল উপজীব্য। কোন মানুষ?  নিশ্চিত ভাবেই ব্যক্তি মানুষ নয়, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ, আমাদের প্রাচীন সাহিত্য সেই সাক্ষ্য দেয়।

দ্বাদশ শতাব্দীর চর্যাগীতির চারটি পঙক্তি উদ্ধার করি –
টালত মোর ঘরে নাহি পড়বেষী।
হাঁড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।।
বেগ সংসার বড্ হিল জা অ
দুহিল দুধু কি বেন্টে যামায়? 

[অর্থাৎ টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাঁড়ীতে ভাত নেই অথচ নিত্যই অভ্যাগতের আগমন। বেগে সংসার বেড়ে যায়, দোয়া দুধ কি আর বাঁটে ফিরে যায় ]

এই দুঃখের বর্ণনার সঙ্গে আরো চারশ বছর পরে লেখা’চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ফুল্লরার দুঃখ যাপন বর্ণনার কোন অমিল নেই –

“কতশত জোঁক খায় নাহি খায় ফণী, দুঃখ কর অবধান
বৃষ্টি হইলে কুঁড়ায় ভাসিয়া যায় বান”।
কিংবা চর্যাগীতির কবি ভুসুকু পাদ’এর বর্ণনা –
“ বাজনার পাড়ি পউয়া খালে বাহিউ।
অদঅ দঙ্গালে দেশ লুড়িউ।।
আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী
ণিঅ ঘরিণী চন্ডালেঁ লেলী।।

[ অর্থাৎ, বাজরা নৌকার পাড়ি, পদ্মার খালে বাওয়া।
দয়াহীন দাঙ্গাবাজে দেশ লুট করে।
আজ ভুসুকু বাঙালি হয়ে গেল।
নিজ গৃহিণীকে চন্ডালে নিয়ে গেল”।]

এক হাজার বছর পরেও, চর্যা যুগের সমাজ বাস্তবতা আমাদের অচেনা লাগেনা। কারণ সাহিত্য সমাজ ও সময়ের ইতিহাসও বটে।
         
চর্যাযুগের পর দুশ বছরে বাংলা সাহিত্যের কোন লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বাংলার শেষ হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনের সময়ে বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণ ও পরবর্তী পাঠান শাসনে বাংলার সমাজ জীবনের বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার কারণে বাংলা সাহিত্যের গতি স্তব্ধ হয়েছিল বটে কিন্তু দেব-দেবীর অর্চনা, লোকিক গান, ব্রতকথা, ছড়া ইত্যাদির মধ্যে সাহিত্যের উপাদান ছিলই এবং সেই লৌকিক উপাদান থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দী বা প্রাক-চৈতন্য যুগের বাংলা কাব্য সাহিত্য। ইতিমধ্যে বাংলার সমাজ কিছুটা সুস্থিত হয়েছে,সমন্বয়ী সংস্কৃতির আলোকরেখা দেখা দিয়েছে, চন্ডীদাশ ও বিদ্যাপতির আবির্ভাব হয়েছে। অতঃপর বাংলায় ইলিয়াস শাহের আমল থেকে বাংলা সাহিত্যের রচনা ও অনুশীলন শুরু হল, বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গল কাব্যের মধ্যে। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের প্রধানতম সাহিত্যধারাই হল মঙ্গলকাব্য। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী মঙ্গলকাব্যের যুগ এমনকি সপ্তদশ শতকের পরেও অনেক মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। বৈষ্ণব সাহিত্যও এই সময়কালেই রচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব সাহিত্য আমার বিষয় নয়, আমি সীমিত থাকবো মঙ্গলকাব্যে।
         
মঙ্গলকাব্য এমন একটি সাহিত্যধারা যার মধ্যে বাঙালি তার বাস্তব জীবনের এবং তার সমকালীন সমাজের যাবতীয় পরিচয় – তার জীবন ও মন, স্বভাব-চরিত্র, অর্থনৈতিক পরিবেশ – সব কিছুকে ধরে রেখেছে। সমকালীন সমাজ জীবনের নানান খুঁটিনাটি ধরা রয়েছে আমাদের লোকসাহিত্যে, আর মঙ্গলকাব্যগুলির উপকরণ সংগৃহীত হয়েছে লোকসাহিত্য থেকে। সেদিক দিয়ে মঙ্গলকাব্য লোকসাহিত্যও বটে। নিশিষ্ট লোকসাহিত্য গবেষক ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য উক্তি উদ্ধার করি, লিখেছেন”মঙ্গলকাব্যও জনশ্রুতিমূলক বিষয়বস্তু অবলম্বন করিয়া রচিত হইয়া থাকে। ইহার একজন রচয়িতা থাকে সত্য, কিন্তু তিনি ইচ্ছামত ইহার বিষয়বস্তু নিজের মত করিয়া পুনর্গঠন এমনকি অউনর্বিন্যাস পর্যন্ত করিয়া লইতে পারেন না ...। এমনকি তিনি যে’নূতন মঙ্গল’ রচনা করেন, তাহার প্রেরণা যে তাঁহারই নিজস্ব তাহাও তিনি প্রকাশ্যে অস্বীকার করিয়া ইহার মূলে দেবতার স্বপ্নাদেশের কথাই উল্লেখ করিয়া থাকেন। সমাজই এখানে দেবতা বলিয়া কল্পিত হয়; অর্থাৎ দেবতার স্বপ্নাদেশের অর্থ সমাজেরই নির্দেশমাত্র হইয়া দাঁড়ায়”।

মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমির এক ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাৎপর্য আছে। মর্তে লৌকিক দেব-দেবীর পূজা প্রচলন এবং সেই পূজা প্রচলনকারীর তা্র আরাধ্য দেবতার কৃপালাভের আখ্যানই মঙ্গলকাব্যের বিষয় বস্তু। মঙ্গলকাব্যে যেসব দেব-দেবীর মহিমা প্রচারিত তারা কেউই আর্যদের দেবতা নন, গ্রামীণ লৌকিক বিশ্বাস নির্ভর আর্যেতর মানুষের দেবতা। মনসা, চন্ডী বা ধর্মঠাকুর কেউই পুরাণকথিত দেবতা ছিলেননা, বৈদিক যুগে তাদের পূজাও প্রচলিত ছিলনা। সাধারণ গ্রামীণ পীড়িত মানুষ, অন্ত্যজ শ্রেনী, ব্যাধ, শবর গোষ্ঠী লৌকিক বিশ্বাসে, তাদের বিপদতারণ রূপে কল্পনা করে এই দেবদেবীদের পূজা করতো। আমরা জানি সমাজ গড়ে ওঠার আদীপর্বে, বৈদিক যুগে আর্যরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা কল্পনায় পূজা করতেন যেমন সূর্য, বরুণ, মরুৎ, ইন্দ্র, ঊষা, সরস্বতী প্রমুখ। এঁরা কেউই মঙ্গলকাব্যের দেবতা নন। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসতেই হয় যে’চর্যাগীতি’তো নয়ই, মঙ্গলকাব্যগুলিও বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করেনা, যেমন বাংলা ভাষা বৈদিক ভাষার (সংস্কৃত) উত্তরাধীকারী নয়। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকরা যে গান গাইতেন সেই গানের ভাষা অবহট্ট, প্রাকৃত ও অপভ্রশ ভাষার সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষা। আমাদের সামাজিক ইতিহাস একথাও জানায় যে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে বৈদিক কঠোরতা ও ব্রাহ্মন্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন রূপেই বৌদ্ধ মতবাদের উদ্ভব। সুতরাং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আদীপর্বে বৈদিক সংস্কৃতি বা ব্রাহ্মণ্যবাদের কিছুমাত্র ছায়াপাত ঘটেনি, বিম্বিত হয়েছে মানুষ ও তার পারিপার্শ্ব।
         
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক - মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এই তিনশ বছর ছিল মঙ্গলকাব্যের যুগ। একাধিক শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল। তিন শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য’মনসামঙ্গল’,’চন্ডীমঙ্গল’ ও ধর্ম মঙ্গল’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মনযোগ অর্জন করেছে। পঞ্চদশ শতকে রচিত মনসামঙ্গল’ই প্রাচীনতম মঙ্গলকাব্য। পরবর্তী কালে চৈতন্য ও উত্তর চৈতন্যযুগেও একাধিক মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। মনসামঙ্গলের আখ্যান পূর্ববঙ্গেই বেশি প্রচলিত ছিল, চতুর্দশ শতাব্দীর আগে থেকেই ব্রতকথা, পাঁচালী গান, ও লৌকিক ছড়ার মধ্যে মনসার গান প্রচলিত ছিল পরে বাংলাসাহিত্যের পুনর্গঠনের কালে এগুলিই আখ্যান কাব্যের রূপ পায়। বিজয় গুপ্ত, নারায়ন দেব, বিপ্রদাস পিপলাই, কেতকাদাশ ক্ষেমানন্দ প্রমুখ  মনসা মঙ্গলের প্রধান কবি। মনসামঙ্গলের আখ্যান – লখীন্দর, বেহুলা ও চাঁদ সদাগরের কাহিনী আমাদের অপরিচিত নয়। সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে চন্ডীর পূজা প্রচলনের দেবী চন্ডীর ছলনা, ক্রুরতা, পূজায় অসম্মত চাঁদ বেনের বিপর্যয় বেহুলার সতীত্বের গুণে চাঁদ বেনের চন্ডীর পূজায় সম্মত হওয়া – এই হল মনসা মঙ্গলের আখ্যান। বিস্ময়কর এটাই যে চর্যাযুগের পর পরবর্তী দুশ’বছরের ব্যবধানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কি অসাধারণ অগ্রগমন ঘটেছিল। কাব্যের লাবণ্যময় রূপ নির্মাণ, চরিত্রবিন্যাস, সেকালীন মানুষ ও সমাজের বর্ণনা সবেতেই বিপুল অগ্রগতি। চাঁদ বেণের পৌরুষত্ব, বেহুলার সতীত্ব, স্বামীর জন্য তার ত্যাগের এক মহৎ চরিত্রের ছবি এঁকেছেন মনসা মঙ্গলের কবিরা। আজও আধুনিক কাব্যে বেহুলার মত কত চরিত্র ঘুরে ফিরে আসে, মঙ্গলকাব্যের রূপ-রীতি, শব্দের ঝংকার একালের কাব্যেও তো দেখি। আর এখানেই মঙ্গলকাব্যের প্রাসঙ্গিকতা এখনও। স্বামীকে সর্প দংশন থেকে বাঁচাতে নিদ্রাহীনা বেহুলা শেষ রাত্রে পলকের জন্য চোখের পাতা বুজিয়েছিলেন আর সেই কয়েক পলক পরেই লখীন্দরের মৃত্যুবিলাপ

“জাগো ওহে বেহুলা, সায়বেণের ঝি
তোরে পাইল কালনিদ্রা, মোরে খাইল কি?”
শাশুড়ি সনকাও বেহুলাকে গালি দেয় –
“সনকা কাঁদিয়া দেয় বেহুলাকে গালি।
সিঁতার সিঁদুরে তোর না পড়িল কালি।।
পরিধান বস্ত্রে তোর না পড়িল মলি।
পায়ের আলতা তোর না পড়িল ধূলি।।
খন্ড কপালিনী বেহুলা চিরুণী দাঁতী।
বিভাদিনে খাইলি পতি না পোহালে রাতি।। (ক্ষেমানন্দ কেতকাদাস)

         
স্বামীর শবদেহ নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে চলেছেন বেহুলা। শবদেহে পচন ধরেছে, তবু বিশ্বাস দেবতাকে তুষ্ট করে মৃত স্বামীর গলিত দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন। হিংশ্র জন্তুরা শবদেহ কেড়ে খেতে চায়, বেহুলা তাদের বলে—

“অভাগিনী বেহুলার সহায় কেবা আছে।
আগেতে আমারে খাও, প্রভুরে খাইও পাছে”।। (বিজয় গুপ্ত)

আবার অন্যদিকে রূপসী রমণীর প্রতি দুষ্ট মানুষেরও লোভ-

“পথের পথিক যত পথ বাইয়া যায়।
বেহুলার রূপ দেখি ঘন ঘন চায়।।
ত্রিজগৎ মোহনী কেন মড়া লৈয়ে কোলে
কলার মান্দাসে ভাসে ঢেউ’র হিল্লোলে”।। (কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ)


মসামঙ্গলে বেহুলা চিরকালীন শ্বাশ্বত পতিপ্রাণা নারীচরিত্রের মর্যাদা পেয়েছেন, কবির কল্পনায় হয়েছেন চিরকালের নির্যাতিতা নারীত্বের প্রতিনিধি। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রামাণ্য ইতিহাসকার পন্ডিত দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন”কবি স্বচক্ষে সতী দেখিয়া সতী আঁকিয়াছেন। ... ...তদ্রূপ রমণী চরিত্র সাহিত্যে বড় বিরল। বেহুলা চরিত্র আঁকিতে কোন কবিগুরু বাল্মীকি লেখনী ধারণ করেননাই। গ্রাম্য কবিগণ বংশদন্ডাগ্রে তুলট কাগজের উপর বেহুলা সতীর রেখাপাত করিয়াছেন;...... দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনে পরার্থে আত্মোৎসর্গ,উপবাস, ব্রতাদির কঠোরতা ও স্বামীর জন্য প্রাণত্যাগ – এই নানাবিধ প্রতিভা যেন আপনা আপনি সমাজ হইতে সাহিত্যে প্রতিবিম্বীত হইয়া বেহুলার ন্যায় আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে, ইহাতে কবিগণের সাহিত্যদর্পণ পড়িতে হয়নাই”।
         
প্রথম মনসা মঙ্গল রচিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে, পরের শতাব্দী’চৈতন্যযুগ’ রূপে চিহ্নিত, যা বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রথম নবজাগরণ কালও বটে। শ্রী চৈতন্যদেবের আভির্ভাবে বাংলায় ভক্তিরসের অভূতপূর্ব প্লাবন ও সমন্বয়ী সংস্কৃতির প্রভাবে মানব প্রেমের যে প্রকাশ ঘটে বাংলা সাহিত্যেও তার অবিসংবাদী প্রভাব পড়েছিল। বাংলার প্রথম নবজাগরণ কালে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গল কাব্যগুলি মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আজ ছ’শ বছর পরেও আমাদের ফিরে যেতে হয়, অবগাহন করতে হয় বৈষ্ণব সাহিত্য আর মঙ্গলকাব্যের মধ্যে। উনবিংশ শতকেও বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে বুদ্ধি ও মননের যে জাগরণ হয়েছিল তাকেও আমরা নবজাগরণ বা রেনেসাঁস বলি বটে কিন্তু তা চৈতন্যযুগের মত এত ব্যাপক ছিলনা। চৈতন্যযুগের প্রথম নবজাগরণের অংশভাগী ছিল কোন ধর্মীয় আবরণহীন, সমাজের অশিক্ষিত, অন্ত্যজ পীড়িত মানুষজন, কিন্তু উনিশ শতকের নবজাগরণ ছিল শহর কেন্দ্রিক শিক্ষিত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার জাগরণ, যার একটি অধ্যায়কে হিন্দু পুনরভ্যুথ্বানবাদও বলেন কেউ কেউ।
         
পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত রচিত মনসামঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে সংশয়াতীত ভাবেই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায় কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্য, যদিও চন্ডীমঙ্গলের আখ্যান ভাগ মনসামঙ্গলের বেহুলা-লখিন্দরের আখ্যানের মত হৃদয়স্পর্শী নয় বলেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তাদের অভিমত। চন্ডীমঙ্গল কাব্য শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায় এতে বিম্বিত সেকালীন সমাজবাস্তবতার অনুপুঙ্খ, বিশ্বস্ত প্রকাশ ও তার কাব্যভাষার জন্য। কবিকঙ্কণ দুইখন্ডে চন্ডীমঙ্গল রচনা করেছিলেন। প্রথম খন্ডে কালকেতু ব্যাধ – ফুল্লরার আখ্যান এবং দ্বিতীয় খন্ডে ধনপতি সওদাগর – খুল্লনা –লহনার আখ্যান। কবি কঙ্কণের আগে মালদহের গ্রামীণ কবি মাণীক দত্তও চন্ডীমঙ্গলের গান বেধেছিলেন, তাঁকেই চন্ডীমঙ্গলের আদীকবির মর্যাদা দেওয়া হয়। কবিকঙ্কণের জন্মতারিখ কিংবা মৃত্যুদিন কিছুই জানা যায়না কিন্তু তিনি লিখেছেন তাঁর পরিচিতির ভণিতায় –

ধন্যরাজা মানসিংহ                         বিষ্ণুপদাম্বুজভৃঙ্গ
                   গোড়বঙ্গ উতকল অধীপ।
যে মানসিংহের কালে                      প্রজার পাপের ফলে
                   ডিহিদার মামুদ সরিফ

অর্থাৎ আকবর বাদশাহর রাজত্বকালেই চন্ডীমঙ্গলের রচনা (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ আকবরের শাসনকাল)। সেকালীন সমাজ বাস্তবতার এমন অনুপুঙ্খ বিবরণ মধ্যযুগের আর কোন কাব্যে পাওয়া যায়না। সমাজতাত্বিকরা একালেও বাংলার বহু জনপদের উৎস সন্ধান করতে মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলের আশ্রয় নেন। ধনপতি সওদাগরের বিদেশ যাত্রার বর্ণনায় এমন বহু জনপদের নাম পাওয়া যায়। তাই কবিকঙ্কণের’চন্ডীমঙ্গল’ সেকালীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসও বটে।  ব্যাধ কালকেতু-ফুল্লরার দারিদ্রের যে বর্ণনা চন্ডীমঙ্গলে পাওয়া যায় সেখান থেকে সেকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র যেমন জানতে পারি তেমনই বিস্ময় জাগে কবিকঙ্কণের কাব্যভাষার নির্মাণে’। চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু-ফুল্লরার আখ্যানে এক অসাধারণ চরিত্র’ভাড়ু দত্ত’ এযুগের চলচ্চিত্রের কোন দুষ্ট চরিত্রও হার মানে তার কাছে। কালকেতুকে ভাঁড়ুর শাসানি বর্ণনা করছেন কবি –

“হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি
হাটে লইয়া বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতী
তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা
পূনর্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা”।।

[চন্ডীর বরে ব্যাধ কালকেতু গুজরাটের রাজা হয়েছিলেন। দুবৃত্ত ভাঁড়ু তাদের ক্ষতি করতে চায়। কালকেতু ভাঁড়ুকে বিতাড়িত করে, তখন ভাঁড়ু এই শাসানি দেয়, সে কালকেতুকে নিঃস্ব করে ফুল্লরাকে আবার আগের মত বাজারে পশুমাংশ ফেরি করতে বাধ্য করবে]

ফুল্লরা-কালকেতুর আখ্যানে ফুল্লরা তার বারোমাসের দুঃখ কষ্ট ছদ্মবেশী চন্ডীকে বর্ণনা দিচ্ছেন –

শীতে –”জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ”
বসন্ত ঋতুতে - “মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ / মালতী এ মধুকর পিয়ে মকরন্দ।
“বনিতা পুরুষ দোঁহে পীড়িত মদনে
ফুল্লরার অঙ্গ পোড়ে উদর দহনে”।।

আবার দ্বিতীয় আখ্যানে, কবিকঙ্কণ ধনপতির পুত্রবধু সুশীলার বয়ানে আষাঢ় মাসের বর্ণনা দিয়েছেন –
“দেখহ ঘন নাচয়ে ময়ূর। / নব জলধর দৃষ্টে ডাকরে দাদুর।।
শুন প্রাণনাথ তুমি শুন প্রাণনাথ। / নিদাঘে শীতল বড় তরুণীর হাত”।
কবিকঙ্কণের কাব্যভাষার দুটি ছবি পাশাপাশি - সেকালীন সমাজদ্বন্দ্বের কি অপরূপ প্রকাশ! – ছ’শ বছর পরে একালেও কি আমাদের মুগ্ধ করেনা!

এখানেই – কাব্যে সমাজ বাস্তবতার অনুপম প্রকাশ এবং সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হয়ে ওঠার কারণেই মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য আজও প্রাসঙ্গিক। আধুনিক বা উত্তর-আধুনিকতার দাবীদার যারা মনে করেন একালের কাব্য শুধুই’ব্যক্তি আমি’ ও’ব্যক্তি আমার’ আত্মমন্থন বা আত্ম অনুসন্ধানের শব্দ সমাবেশ, তারা কি চোখে দেখবেন মঙ্গলকাব্যকে  আমার জানা নেই। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস সমাজ বাস্তবতার প্রকাশ ভিন্ন মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারেনা, কালোত্তীর্ণ হতে পারেনা’ব্যক্তি আমার’ আত্ম মন্থন। মঙ্গলকাব্য আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন