প্রবন্ধ
পৃথিবীর
আদিমতম সময় থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে ধর্মকে ধারণ করে এসেছি। সভ্যতার বিবর্তন ধারার
ফল হলো ভারতে শক্তিপূজোর প্রচলন। শক্তিপূজো, বিশেষত মাতৃভাবে শক্তিপূজো ভারতেরই নিজস্ব
সম্পত্তি। বন্যতা থেকে সভ্যতার শুরু। বন্যতা থেকে বর্বর, বর্বর থেকে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন
এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার উদ্ভব মানুষের সবচেয়ে বড় সাফল্য বা অর্জন। বিভিন্ন
প্রতিকূলতায় জীবন ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে প্রয়োজনীয় বোঝাপড়া, প্রচলন ও সৃষ্টি মানবগোষ্ঠীর
জীবনযাত্রাকে উপযুক্ত অবস্থান দিয়েছে। সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
দ্বারা জীবনপ্রবাহের মানোন্নয়ন বিশেষ সময়কালের
পরিপ্রেক্ষিতে সভ্যতা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। যেমন, মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা, সুমেরীয়
সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসেরীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, হিব্রু
সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, মায়া সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব
হয়েছিল আজ থেকে পাঁচলক্ষ বছর আগে। তার আগে দুইশো ষাটলক্ষ বছর ধরে প্রকৃতির কর্মশালায়
চলেছিল এক বিরাট কর্মকাণ্ড। একশ্রেণির বানর জাতীয় জীব Dryopithecus চেষ্টা করছিল বিভিন্ন লক্ষণযুক্ত হয়ে
নানা বৈশিষ্ট্যমূলক শাখাপ্রশাখায় প্রসারিত হতে। এইরকম একটি শাখা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল
নরাকার জীবসমূহ। এসব জীবের মধ্যে যারা গাছ ছেড়ে মাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অন্যতম
ছিল Ramapithecus। মনে করা হয় এদের থেকেই মানুষের বর্তমান ক্রমবিবর্তিত রূপ। এই বিবর্তনের
মধ্য দিয়েই আনুমানিক চল্লিশ হাজার বছর আগে Neanderthal জাতির মানুষ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত
হলে তার স্থান দখল করে Cromagnon। এই জাতির মানুষ থেকেই পৃথিবীর বর্তমান জাতিসমূহের
উদ্ভব হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা অবশ্যই বলা দরকার যে, ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে বিখ্যাত
প্রত্নাস্থিতত্ত্ববিদ স্যার আর্থার কীথ তার Antiquity of Man গ্রন্থে লিখেছেন -- '
India is a part of the world from which the student of early man has expected
so much and so far has obtained so little.'
স্যার আর্থারের এই উক্তিকে কেন্দ্র করে ত্রিশের দশকে আমেরিকার ইয়েলের স্যাচারাল
মিউজিয়ামের অধ্যাপক ডক্টর টেরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অনুসন্ধান চালান এবং ভারতের
শিবালিক গিরিমালা অঞ্চলে রামপিথেকাস, সুগ্রীব পিথেকাস, ব্রহ্মপিথেকাস প্রভৃতি মানুষের
পূর্ববর্তী নরাকার জীবের জীবাশ্মের সন্ধান পান।অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠে ভারতেই
প্রথম মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল, একথা স্পষ্ট।
যাইহোক
ধর্ম এবং পূজো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিক কারণেই ধর্মীয় প্রাক্ প্রেক্ষাপট আলোচনা
জরুরি হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে সেইসময়কার মানুষের
যাপন এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। মানুষের আবির্ভাব
হয়েছে। বর্বরজগৎ। চারিদিক অজ্ঞানতার অমাবস্যায় আচ্ছন্ন। অন্ধকারের সাথে দন্ধ। বিপদসঙ্কুল
জীবন। প্রধান সমস্যা বলতে আত্মরক্ষা ও খাদ্য যোগাড়। বিশেষ করে অত্যাধিক শীত, তাপ, বন্যপশুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা
ও আসঙ্গলিপ্সা প্রভৃতি নানা কারণে মানুষ জীবনসংগ্রামে
এগিয়ে যাচ্ছিল এবং বুদ্ধি খাটিয়ে, আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে পাথরের আয়ুধ তৈরি করেছিল
যা প্রাচীন মানুষের কৃষ্টির একমাত্র নিদর্শন। অর্থাৎ বলা যায় সে সময়ের মানুষ শুধুমাত্র
homo sapiens ছিল তা নয় homo faber-ও ছিল অর্থাৎ বুদ্ধির ধারকের সাথে সাথে প্রাগৈতিহাসিক
প্রেক্ষাপট কারিগর। পশুর সংখ্যা কমে গেলে মানুষকে খাবারের সন্ধানে অন্য জায়গায় যেতে
হতো। এইভাবেই জীবনের প্রথম অধ্যায়ে মানুষ ৪৯০,০০০ বছর কাটিয়েছে। এই সময়কালকে বলা হয়
Palaeolithic বা প্রত্নোপলীয় যুগ। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনভাগে বিভক্ত প্রত্নোপলীয় যুগের
শেষভাগকে mesolithic period বা সন্ধিকালের যুগ বলা হয় কারণ এটাই ছিল প্রত্নোপলীয় এবং
nealithic বা নবোপলীয় যুগের সেতুবন্ধন। সেইসময় মানুষ পর্বতগুহা ও পাহাড়ের ছাউনির তলায়
বসবাস করতো। পর্বতগাত্রে নানারকম চিত্র আঁকতো। এইসকল চিত্রাঙ্কন ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায়
ব্যবহৃত হতো৷ এই ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়াই ছিল আদিম মানুষের সার্বজনীন ধর্ম।
নবোপলীয়
যুগে মানুষ পশুপালন ও কৃষির উপযোগী স্থানে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ভূমি কর্ষণের
সূচনা করেছিল মেয়েরা। পুরুষরা পশুশিকারে বেড়িয়ে গেলে খিদের তাড়নায় মেয়েরা গাছের ফল,
ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে বেঁচে থাকতো। এই অবস্থায় তারা অন্যরকম
ভাবনাচিন্তা শুরু করে।সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তারা জানতো এবং বন্য ভূমি যেহেতু শস্য
উৎপাদন করে তাই তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে যুক্তির আশ্রয়ে ভাবতে শুরু করে যে,
পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমিকে কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করে তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কর্ষণ
করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন (পরবর্তীকালে আমাদের সকল ধর্মশাস্ত্রে মেয়েদের 'ক্ষেত্র'
বা 'ভূমি' বলা হয়েছে)। তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ বানিয়ে ভূমি কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন
করলো। Przyluski তাঁর 'Non-Aryan Loans in Indo-Aryan' প্রবন্ধে বলেছেন, 'লিঙ্গ',
'লাঙ্গুল' ও 'লাঙ্গল' এই তিনটি শব্দের একই ধাতুরূপ থেকে জন্ম। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে
লক্ষ্য করা গেল লিঙ্গরূপী যষ্টি হলো passive এবং ভূমিরূপী পৃথিবী হলো active।
Active মানেই শক্তির আঁধার। ফসল তোলার পর প্রথম 'নবান্ন' উৎসবে জন্ম হলো লিঙ্গপূজো
ও ভূমিরূপী পৃথিবীপূজো (অতুল সুর, হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্বিক ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৮১ দ্রঃ)।
নবোপলীয় যুগে লিঙ্গপূজোর সূচনা হয়েছিল তার বিশদ আলোচনা আছে 'বিগিনিংস অফ লিঙ্গ কালটু
ইন ইন্ডিয়া' প্রবন্ধে। এই নবোপলীয় যুগে মানুষ স্থায়ী
বসতি স্থাপন ও ভূমি কর্ষণ ছাড়াও পশুপালন, মৃৎপাত্র তৈরি, বস্ত্রবয়ন করতো এছাড়া নিজেদের
প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ব্যবহৃত আয়ুধ বা যন্ত্রাদি মসৃণ বা পালিশ করতো। বস্তুত
নবোপলীয় যুগেই প্রথম সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। আমরা ভারতের তাম্রাশ্ম সভ্যতাকে 'সিন্ধু সভ্যতা' বা 'হরপ্পা সভ্যতা' বলি। এর উৎপত্তি
ও বিকাশ ভারতেই হয়েছিল। প্রস্তরযুগের শেষে
এই সভ্যতার ধারকদের মধ্যে তামার ব্যবহার শুরু হয়। প্রস্তরযুগের যে স্তর থেকে তাম্রাশ্মযুগের
উদ্ভব হয়েছিল তাকে আমরা নবোপলীয় যুগের সভ্যতা বলি। এই প্রসঙ্গে একটি কথা জানা দরকার,
সে সময়কার বিভিন্ন খন্ড খন্ড আবিষ্কার প্রমান করে যে সুদূর অতীতে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া,
বর্ধমান, মেদিনীপুর অঞ্চল জুড়ে এক সমৃদ্ধশালী তাম্রাশ্ম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আজ প্রণালীবদ্ধভাবে
খননকার্য চালালে নিশ্চই জানা যেত তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল বাংলায় এবং বাংলা
সভ্যতার জন্মভূমি ছিল। তাম্রাশ্ম সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন পাওয়া গেছে বর্ধমান জেলার
অজয় নদীর তীরে অবস্থিত পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে। এখানকার দ্বিতীয় যুগের লোকেরা তাম্রাশ্ম
সভ্যতার বাহক ছিল। তারা সুপরিকল্পিত নগর, রাস্তাঘাট
ছাড়াও গৃহ ও দূর্গ নির্মাণ করতে জানতো। অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল কৃষি ও বৈদেশিক
বানিজ্য। সবচেয়ে বড় কথা তারা মৃতব্যক্তিকে পূর্ব-পশ্চিমে শুইয়ে সমাধিস্থ করতো এবং মাতৃকাশক্তির
পূজো করতো।
প্রাক্-বৈদিক
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার ধর্মবিশ্বাসের প্রত্ননিদর্শনস্বরূপ লিঙ্গ ও যোনির কিছু অনুকৃতি,
মাতৃকামূর্তি ও পুরুষ দেবতা অঙ্কিত কয়েকটি সীল পাওয়া গেছে। লিঙ্গ ও যোনির উপস্থিতি
একটি উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস-কেন্দ্রিক ধর্মের সূচনা করে যেগুলি যথাক্রমে পুরুষ দেবতা এবং মাতৃকাদেবীর প্রতীক। পন্ডিতদের
মতে এইগুলি পরবর্তীকালের সুবিস্তৃত শিব ও শক্তির ধারণার পূর্বাভাস। ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসে লিঙ্গ উপাসনার সাথে শিবের গভীর সংযোগ চোখে পড়ে,
এই প্রভাব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে সুদূর প্রাগৈতিহাসিক অতীত।
বৈদিক
ঋষিরা অনার্যদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। যেমন রাক্ষস, যাতু, যাতুধান, অনাস, মূরদেব
ও শিশ্মদেব। শিশ্মদেব কথাটির দ্বারা বোঝা যায় যে, অনার্যরা সৃজনশক্তির মূল উৎস 'পিতৃদেবতা'র
জননতন্ত্র অর্থাৎ লিঙ্গকে ঐশীশক্তির প্রতীক বলে পূজো করতো। পঞ্চোপাসনা থেকে জানা যায়,
সিন্ধু উপত্যকায় এবং বেলুচিস্তানের নালপ্রদেশে
লিঙ্গ ও যোনির প্রতিরূপ এবং কিছু শিলমোহরে পৌরাণিক শিবের পরিচয় পাওয়া গেছে। অনুমান
করা যায় শিশ্ম-প্রতীক পূজো আদি শিবের পূজোর একটি অঙ্গ এছাড়া পৌরাণিক ও তান্ত্রিক যন্ত্রপূজো
বা শক্তিপূজোর আদিমতম নিদর্শন সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত ছিদ্রবিশিষ্ট ছোটবড় একাধিক বৃত্তাকার
পাথর। শিলমোহরগুলির গায়ে উৎকীর্ণ চিত্র, ছোটবড় মাটির ও পাথরের মূর্তি থেকে বোঝা যায়
সিন্ধুবাসিরা দেবতা ও দেবতার প্রতীকের পূজো করতো।
১৯২৯ খৃস্টাব্দে
'অ্যানালস অভ দি ভান্ডারকার ওরিয়েণ্টাল ইনস্টিটুয়ট পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে
যে, লিঙ্গ উপাসনা ভারতে তাম্রাশ্ম যুগের আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। বস্তুত ভারতের ঐন্দ্রজালিক
ধ্যানধারণায় এর বিশেষ ভূমিকা ছিল। সিন্ধু সাম্রাজ্য জুড়ে পূজোর প্রতীক হিসেবে যে অসংখ্য
লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি পাওয়া গেছে জন মার্শাল প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেগুলিকে সিন্ধুধর্মের
পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নরম পাথর বা
পোড়ামাটিতে নির্মিত প্রাপ্ত হ্রস্বাকৃতি অসংখ্য লিঙ্গগুলিকে জন মার্শাল লিঙ্গ প্রতীক
বলে মনে করেন। এদের আকৃতি, গঠনপ্রণালী থেকে বোঝা যায় সিন্ধুবাসীরা সেগুলিকে পিতৃদেবতার
পূজা-প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতো। মাতৃকাপূজো সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ডঃ অতুল সুর আর একটু
বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'হিন্দুধর্মে শিব ও শক্তি যে মাত্র নরাকারে
পূজিত হন তা নয়। প্রাপ্ত মন্ডলাকারে গঠিত প্রতীকসমূহ থেকে বোঝা যায় সিন্ধুর অধিবাসীরা
লিঙ্গ ও যোনি মূর্তির উপাসক ছিলেন। এছাড়াও সেখানে প্রস্তরনির্মিত পুরুষলিঙ্গের এক
বাস্তবানুগ প্রতিরূপ পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরাই ঋগ্বেদে বর্ণিত সমৃদ্ধশালী নগরসমূহের আর্য-বৈরী
'শিশ্মোপাসক' সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, ঋগ্বেদে ঐ শিশ্মদেবদের
প্রতি মনোভাব যতো বিরূপই হোক না কেন পরবর্তীকালে ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসকে
এ-মনোভাব খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। কেন না উত্তরকালের ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের
অন্যতম প্রধান পরিচয় বলতে ঐ লিঙ্গ উপাসনাই। এই উপাস্য লিঙ্গ সাধারণত শিবলিঙ্গ। যা শৈব
সাধনার পরিচায়ক।' প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শাল বলেছেন, 'শক্তিসাধনার মতোই শৈব সাধনারও
সূত্রপাত প্রাচীন প্রাক্-বৈদিক সিন্ধু যুগে এবং বেদোত্তর ভারতবর্ষীয় ধর্মবিশ্বাসের
ক্ষেত্রেও শক্তি সাধনার মতোই ঐ শৈব সাধনার অবিচ্ছিন্ন প্রভাব টিকে থেকেছে'। শক্তি সাধনা
সম্পর্কিত আলোচনায় প্রাক্-বৈদিক ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সিন্ধু ধর্মের প্রধানতম উপাদান
হলো উর্বরতামূলক আদিম যাদুবিশ্বাস ও তার স্মারক৷ এ-বিশ্বাসের মূলসূত্র অনুসারে মানবীয়
ফলপ্রসূতা ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা একই সূত্রে বাঁধা। স্বভাবতই আদিম মানুষদের মধ্যে প্রচলিত
এই বিশ্বাসমূলক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এবং এই বিশ্বাস উদ্ভূত নানান প্রচলিত ধর্মের
ক্ষেত্রেও জনন-অঙ্গের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সিন্ধু-ধর্মও যে তার ব্যতিক্রম
নয় তার প্রমাণ সমগ্র সিন্ধু সাম্রাজ্য জুড়ে আবিস্কৃত অজস্র লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি যা
প্রাগৈতিহাসিক অতীতের ইঙ্গিত দেয়। সিন্ধু যুগে লিঙ্গ ও যোনি উপাসনার এমন গভীর এবং ব্যাপক
প্রভাব সম্পর্কে বলা যায় যে, সিন্ধু অধিবাসীদের
প্রাকৃতিক শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক ও বাস্তব কোনো ধারণা ছিল না।
তারা প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকে মানবীয় ফলপ্রসূতার অনুরূপ বলে মনে করতো এবং সেই চিন্তাভাবনায়
মানবীয় প্রজননের সাহায্যে প্রাকৃতিক উৎপাদিকা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করেছিল। আদিম
মানুষদের মধ্যে প্রচলিত এই বিশ্বাসের ছাপ পড়েছিল তাদের আচার-অনুষ্ঠানেও। ফলাফল ধর্মবিশ্বাসে
মানবীয় জননাঙ্গ ও তার অনুকরণের বিবিধ প্রয়োগ তথা
চিহ্ন বা প্রতীকের ব্যবহার। যে বিশ্বাস থেকে সিন্ধু-ধর্মও আলাদা নয়।
আগেই বলেছি
সিন্ধু সভ্যতার প্রাগার্য অধিবাসীরা শুধুমাত্র মাতৃদেবীর উপাসনা করতো না নয়। সুমের
ও মধ্য-প্রাচীর প্রাচীন অধিবাসী এবং বর্তমানকালের ভারতীয় হিন্দুদের মতো তারা একজন পূরুষ
দেবতারও পূজো করতো। মহেঞ্জোদারোতে আবিস্কৃত তিন মুখ বিশিষ্ট দেবতার মূর্তি তারই সাক্ষ্য
বহন করে। সিংহাসনের ওপর আসীন এই দেবতার বক্ষ, কন্ঠ ও মস্তক উন্নত। তার এক পা অন্য পায়ের
ওপর আড়াআড়িভাবে স্থাপিত। দুটো হাত বিস্তৃতভাবে হাঁটুর ওপরে রাখা। তিনি ধ্যানমগ্ন এবং
উর্ধ্বলিঙ্গ। তার চারদিকে চার প্রধান দিক-নির্দেশক হাতি, বাঘ, গণ্ডার ও মহিষের প্রতিমূর্তি
অঙ্কিত। তার সিংহাসনের নিচে দুটি মৃগকে পশ্চাদদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ঠিক এইখানে আদিশিব ও তার ধারণার সাথে আমরা পরিচিত হই সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
বস্তুত পরবর্তীকালে শিবের তিনটি মূলগত ধারণা, তার উৎস ও একমাত্র আবিস্কৃত প্রমানও এই
মূর্তি। ১) শিব যোগীশ্বর বা মহাযোগী। ২) পশুপতি ও
৩) ত্রিমুখ। 'প্রি-আরিয়ান এলিমেন্টস ইন ইন্ডিয়ান কালচার' গ্রন্থে বৈদিক রুদ্রদেবতাকে এই আদিশিবের প্রতিরূপ হিসেবেই কল্পনা করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ
জন মার্শাল একটি প্রশ্ন তুলে আনেন, যেখানে সিন্ধুধর্মে মাতৃকাশক্তির প্রভাব রয়েছে সেখানে
অসংখ্য লিঙ্গের নিদর্শন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিশেষ করে সিন্ধু যুগের শক্তি সাধনায়,
যোনি, বসুমাতা, শাকম্ভরীর উপাসনায় এই পুরুষতত্ত্বের তাৎপর্য কি! এই প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ
চট্টোপাধ্যায় ও পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়ের প্রাসঙ্গিক মতামত হলো, 'তন্ত্রের শাক্ত সাধকগণ
বলেন যে, শিব স্থানু-সদৃশ একটা বিদ্যমানতার দ্যোতকমাত্র। তাঁহার উপাসনা করি কোন হিসাবে।
শক্তি না থাকলে শিব তো শব অথচ শক্তি শূন্যে শিব হইতেই পারেন না অতএব শিব আছেন, মাথার
ওপরে থাকুন। আমরা মায়ের আদ্যাশক্তির উপাসনা করিব কারণ তিনিই তো সব। তিনি মেধা, তিনি
মায়া, তিনি লজ্জা, তিনি ক্ষমা, তিনি বুদ্ধি, তিনি ধৃতি, তিনি বিদ্যা, তিনি ছায়া, তিনি
শান্তি, তিনি ক্ষান্তি...'।
'ভাররীয়
দর্শন'এ (পৃষ্ঠা-৭৮) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আরও বলেন, 'অতএব দেখা যায়, উত্তরকালের
শাক্ত-তত্ত্ব ঐকান্তিক অর্থে মাতৃপ্রধান হলেও তারমধ্যে শিব বা পুরুষতত্ত্বের একটি স্থান
থেকে গিয়েছে। শক্তিই প্রধান। শক্তিই মূলতত্ত্ব। তবুও অন্তত গৌণ অর্থে শিব বা পুরুষ
তত্ত্বও স্বীকৃত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে প্রকৃতিই প্রধান তবুও
পুরুষ সত্য যদিও এই পুরুষ অপ্রধান এবং উদাসীন
মাত্র। পরবর্তীকালের শাক্ত-ধর্মকে যদি সিন্ধু ধর্মেরই রেশ বলে স্বীকার করা হয় তা হলে
অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে সিন্ধুযুগের ঐ প্রাগৈতিহাসিক শাক্ত-ধর্মের মধ্যেই আলোচ্য
বৈশিষ্ট্যের বীজ ছিল। হয়তো তারই মূর্ত নিদর্শন
হলো ঐ বসুমাতামূলক ধর্মবিশ্বাসের স্মারকগুলির মধ্যে যোনিমূর্তি ছাড়াও লিঙ্গমূর্তি বা
শিবলিঙ্গগুলি। অর্থাৎ সিন্ধুধর্মেও এই শিবলিঙ্গ নির্দেশিত পুরুষতত্ত্বের স্থান গৌণ,
অপ্রধান এবং উদাসীন বলেই অনুমেয়'।
বিভিন্ন
বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসে শিব সাধনা এবং শক্তি সাধনা দুটি স্বাতন্ত্রতা
লাভ করেছে। শিব সাধনা পুরুষ প্রধান হলেও লক্ষনীয় বিষয় হলো সেখানে আদিম মাতৃশক্তির অস্তিত্বের
বিনাশ হয়নি বরং শৈব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৃষ্টির উপাদানের কারণ বলতে 'মায়া' বা 'প্রকৃতি'কেই
বোঝানো হয়েছে। সুতরাং উত্তরকালের শিব সাধনায় পুরুষতত্ত্বকে যতটাই গুরুত্ব দেওয়া হোক
না কেন তা থেকে আদিম মাতৃপ্রধান বা প্রকৃতিপ্রধান বিশ্বাসের চিহ্ন লুপ্ত হয়নি বলে দেবীপ্রসাদ
চট্টোপাধ্যায় মনে করেন। উত্তরকালে মাতৃপ্রধান বিশ্বাসের প্রধান পরিচয় হলো শক্তি সাধনা
বা তন্ত্র সাধনা।
সুতরাং
আমাদের কাছে স্পষ্ট হলো যে, সিন্ধুসভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষি জীবনকে কেন্দ্র করে
যে সমাজ গড়ে উঠেছিল তা ছিল মাতৃপ্রধান। যেখানে কৃষিভিত্তিক উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসগুলি
প্রাধান্য পেয়েছিল। প্রাধান্য পেয়েছিল মাতৃশক্তি। যদিও নগর সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে
উন্নততর কৃষিকাজের ক্ষেত্রে পশুর সাহায্যে লাঙ্গল দেওয়ার রীতি ধীরে ধীরে সমাজকে পুরুষপ্রধান
করে তুলেছিল কিন্তু মাতৃপ্রধান ধ্যানধারণা অক্ষুণ্ণ থেকেই পরবর্তীকালে প্রকৃতির সমরূপী
প্রজননমূলক জাদুবিশ্বাস হিসেবে আচার-বিশ্বাসে প্রতীকি বিষয়টি কালক্রমে এসে পড়েছে। কামাক্ষার
যোনি পূজো এবং শিবলিঙ্গ পূজো তারই উদাহরণ।
মাদ্রাজ
মিউজিয়ামে ফুট কালেকশন-এ নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের একটি সুন্দর প্রতিরূপ আছে। মাদ্রাজের
সালেম জেলার শিবারয় পাহাড়ে এটি পাওয়া গিয়েছিল। বরোদার নানা জায়গা থেকেও নবোপলীয় যুগের
লিঙ্গের প্রতিরূপ পাওয়া গেছে। এইগুলি সবই স্বজন-শক্তি উৎপাদক ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। উত্তরকালে ধর্মবিশ্বাসে শাক্তদের কাছে শক্তিই প্রধান আবার শক্তি
শূন্য শিব শবের মতোই কিন্তু পুরুষপ্রধান বৈদিক ধর্মে তথা উপনিষদের চিন্তাধারায় পুরুষই
চরম ও শেষ সত্য।
সিন্ধুর
আদিম সভ্যতায় জন্ম নেওয়া শিব ও শক্তি সাধনার এই যে ক্রমবর্তমান রূপ যা মূর্তি পূজোর
জন্ম দিয়েছে তার আদিম ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে আদিম সিন্ধুনারীদের চিন্তার ফলাফল যা কৃষিকাজের হাত ধরে নিজস্ব গতি খুঁজে নিয়েছে।
জন্ম নিয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সৃষ্টি-রহস্যের হাত ধরে লিঙ্গ ও যোনি পূজো।
সমাপ্ত
সুলেখা সরকার : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন