ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র ও লোকসভা নির্বাচন--২০১৯



প্রতিবেদন
              


       
পৃথিবীর মানচিত্রে বিশাল অবস্থান নিয়ে ভারত দেশ। একদিকে সুউচ্চ হিমবাহিত গিরি শিখর, দক্ষিণে জলধৌত সমুদ্রের ফেনারাশি, অপরদিকে রূক্ষশুষ্ক মরুভূমির উষ্ণতা, বিপরীতে চিরহরিৎ সবুজ বনানী অতিবৃষ্টির চেরাপুঞ্জি। ভাবতে অবাক লাগে, এত বৈচিত্র্য, এত বিস্ময় প্রকৃতি দুহাত ভরে সাজিয়ে রেখেছে এই উপমহাদেশে। অসমতল মাটির উপরে সুবিশাল আকাশ,উন্মুক্ত রৌদ্রের দাপাদাপি, গভীর অরণ্যে হাজার প্রজাতির জীবজগৎ, মাটির অভ্যন্তরে কোটি কোটি মুদ্রার খনিজ সম্পদ, যা একটা দেশকে স্বাধীন, নির্ভীক ও সাহসী হতে সাহায্য করে। ছোট বড় অসংখ্য নদনদী, নদী পেয়েছে বাতাসের মুক্ত স্বাদ, পুষ্ট হয়েছে শরীর উপনদীর সহযোগিতায়, পাহাড় পেয়েছে ঝরনার গান, পাখি পেয়েছে নির্মল উষ্ণতা, মাঠে মাঠে হরিৎ বর্ণের শোভা, সে এক ধরিত্রীর মহাস্বর্গীয় দেশ। বিচিত্র স্বাদের গন্ধ, ছড়াছড়ি উত্তাপ, বিভিন্ন বর্ণের আম-আদমী, বহুভাষার কলধ্বনি, হংসকুলের পদছন্দ, দোলায়িত জলের তরঙ্গ, ঝিলিমিলি, টেরাকোটা প্রতীম সোপান মন্দির, মসজিদের সুউচ্চ মিনার, গির্জার সুলালিত গম্বুজ, হরেক রকম জীবন জীবিকা, জনজীবনের নতুন নতুন মহোৎসব আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। দৈনন্দিন সূর্যের আলোকপ্রপাতের সময়ের থেকেই যে দেশ গর্বের, যে দেশ আমার মাতৃভূমি, যে দেশ সকল দেশের সেরা, সকল দেশের চাইতে শ্যামল, শস্য ভাণ্ডারে পরিপূর্ণ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাত, মারাঠা, দ্রাবিড়, উৎকল, বঙ্গ, বিন্ধ্য হিমাচল, যুমনা, গঙ্গার উচ্ছ্বসিত স্রোত, বিকীর্ণ রশ্মিছটা, সাতরঙা রামধনু, তার রঙিন আকর্ষণ আমাদের সমৃদ্ধ, পরিতৃপ্ত করে, পরিমিত করে। ভারত আমার দেশ, আমাদের দেশ;ভারতবাসী আমার ভাই, আমার হৃদয়, আমার আত্মা

   ভারত তুমি কেমন আছো? চারপ্রান্ত থেকেই প্রশ্নটা বারবার উড়ে আসে পাখির ডানার ঝাপটে, প্রজাপতির রঙিন পাখায় রঙ মেখে। যখন দেখি ভারত জননীর মুখ কালশিটে, চোখে মুখে নেই আনন্দধারা, হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই, তখন মনের দিগন্তে সন্ধ্যাতারার মল্লিক বাতাসে হতাশা অনুভব করি। কিন্তু কেন নেই -- এই কথার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অতীত বারবার ফিরে আসে। আদি জনজাতি মানুষের বাসভূমি যাকে জবরদস্তি করে দখল করেছে বিদেশের অশুভ হাতগুলো, পদসমৃহ দলিত করেছে দূর্বাদল, তাদের শিরোঘাত করে বিদীর্ণ করেছে শীর্ষ শিষ, ভেঙেচুরে দিয়ে গেছে সবুজবনানীর হাড়ডাল, নদীর জলে মিশিয়ে দিয়েছে বিভেদের বিষ, হত্যা করেছে জলজ জীবকুল।সেই যে শুরু, অত্যাচার,নিগ্রহ, নিষ্পেষণ, লুণ্ঠন নেমে এসেছে ভারতজননীর স্থূল স্কন্ধে, সেদিন থেকেই ভারত স্বাধীন হয়েও পরাধীনতার জালে বিধ্বস্ত, মুক্ত হয়েও আজও বন্দি, শৃঙ্খলাবদ্ধ। পায়ের বেড়ি তাকে চিররুদ্ধ করে রেখেছে, গলার বন্ধন তাকে রেখেছে শ্বাসরুদ্ধ করে।

        '' জননি জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরিয়সী " -- সেই জননীর বন্ধনমুক্তির জন্যে হাজার বছরের যুদ্ধ করতে হয়েছে ভারতবাসীকে। যুদ্ধ হয়েছে শত্রুর সাথে, নিজেদের সাথে, প্রাকৃতিক বিসম অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, সৃজিত কুচক্রীদের বিরূপ মন্ত্রণার বিপরীতে। ভারত মহাভারতের যুগ পেরিয়েছে, রামায়ণের কাহিনী থেকে হৃদয়ের সাহিত্যে সংবদ্ধ হয়েছে। এসেছে কত যুগের স্রোত, লুঠেরা বাহিনী, রাজন্ ও শোষকশাসক। কেউ কেউ জননীর দুঃখ দুর্দশা বুঝে তাকে স্তিমিত ভালবাসা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, আবার কেউ টেনে হিঁচড়ে সার-উপাদান শ্বাসটুকু চুষে হাড়জিরজিরে করে ছেড়েছে এরূপ চরম লাঞ্ছনা বঞ্চনার মধ্য দিয়ে কালের গতিরথে চড়ে এগিয়ে চলেছে জননি-স্নেহধারা।এই সেই দেশে যেখানে একসময়ে এসেছে ব্রিটিশরাজের শাণিত চাবুক, জর্জরিত দেহে প্রজা-রক্ত, ঘামে তৈরি হয়েছে ইমারত, শ্রমের বিনিময়ে এসেছে শিল্পের উন্নয়ন, জাতির বুকে জেগেছে ভরসার প্রদীপ। প্রদীপ জ্বলে তার তৈলাক্ত উপাদানের উপর নির্ভর করে, তৈলহীন পলতে বেশিক্ষণ আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারে না

      দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে বাহাত্তর বছর আগে, পুষ্ট হয়নি নদীর জল, গ্রাণ পায়নি ঝরনার স্রোত-সংগীত,স্বাবলম্বী হতে পারেনি কৃষক সমাজ, কাজ পায়নি শ্রমিক সম্প্রদায়, বারবার আঘাত প্রত্যাঘাত পেয়েই গেছে, প্রতিঘাত করার অদম্য সাহস হয়নি কোনোদিন। নীরব বেদনা, নীর্ব্যক্ত ব্যথার ক্ষত নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা করেছে বারংবার। কিন্তু নির্লোভ শাসকের অভাবে দক্ষ প্রশাসকের সুদৃষ্টির ঘাটতি থেকে গেছে আজতক। স্বাধীনোত্তর সময়ে মানুষ লড়াই করে বাঁচতে চেয়েছিল, চেয়েছিল নিজশ্রম উজার করে দিয়ে মাতৃভূমিকে সোজা করে দাঁড়াতে।শ্রম ব্যয় করে নিজের খাবার নিজে সংগ্রহ করতে, কিন্তু পারেনি, পারছে না, চুরি হয়ে যাচ্ছে তাদের শ্রম, লুটে নিচ্ছে বেনিয়ার দল, লাভ, মুনাফা, অতি-উপার্জন করাই তাদের লক্ষ্য, তাদের অভীপ্সা নিজেদের পুষ্ট করা, তাতে আপামর জনসাধারণ খেতে পেল কীনা তা দেখার অবকাশ কোথায়। সম্পদের কেন্দ্রীভূত করায় তাদের মুল উদ্দেশ্য।সম্পদ নিয়ে টানাটানি, কে কতটা বেশি সম্পদ সঞ্চয় করে বিশ্বতালিকায় নাম নথিভুক্ত করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে।

     সংসদীয় গণতন্ত্র একগাল ভরা শব্দবন্ধ। আমাদের উৎসাহিত করে, উদ্দীপ্ত করে, মনের জোর বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু গণতন্ত্রের ফানুস ফুটে যায় কেবলমাত্র সূচের এক ছোঁয়ার আঘাতে সংসদীয় গদির মোহে মানুষকে নানান প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকে, প্রাক নির্বাচনকালে মিথ্যের ফুলঝুরি ছেটানো হয়, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে তারা পারে না, আড়ালে আবডালে, নীরবে নিভৃতে, পেছন থেকে ছুরি মারে গণতন্ত্রের লঘু পিঠে। গণতন্ত্র বোবার দৃষ্টিতে, অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখে, পিছনে ফিরে দেখে শূন্যতার পদচিহ্ন, কেউ নেই অথচ তার পিঠ থেকে রক্ত ঝরছে অবিরত, কোন অলৌকিক শক্তি তাকে পর্যুদস্ত করে ফেলছে। ভাবতে তাই অবাক লাগে, দেশ কোন পথে চলছে?  কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আগামী শতাব্দীর ভবিষ্যত কী? একঝলক লিপ্সার কাছে, অসত্যের কাছে পরাজিত

       সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দল গঠন করা নয়, দল গঠন করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি, স্বার্থচরিতার্থ করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে, নিজের অপরিমেয় অভিলাষ পূরণের উদ্দেশ্যে সম্পদ সমৃদ্ধি বৃদ্ধির মানসে যাদের দল গঠন তাদের দিয়ে দেশ শোষণ করা যায়, জনগণকে শাসিত করা যায়, কিন্তু মহৎ কাজ করা যায় নাচালাকির দ্বারা মহৎ কাজ যেমন হয় না, তেমনি নীতিহীন, আদর্শহীন দলও দেশকে শান্তি, সুখ সুস্থিরতা ও ভালবাসা দিতে পারে না তাদের নীতিহীনতা দেশকে ধ্বস্ত করে, দেশের পবিত্র মাটিতে অপবিত্রতার ভগ্ন বাতাস ছড়িয়ে দেয়, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে পড়ে।

     সদ্য সমাপ্ত হয়েছে সাধারণ লোকসভা নির্বাচন ২০১৯। যার প্রভাব ও প্রত্যাশা দুইই ছিল আপামর জনসাধারণের চিন্তা ও চেতনায়। ফলে মানুষ চেয়েছে মুক্তির আকাশ, বাঁচার নতুন সোপান। বিগত দিনের শাসন থেকে নতুন শাসকের কাছে তারা  কী কী পেতে চায় তার পর্যালোচনা হওয়া দরকার। ২০০৪ সালের ইউ পি এ সরকার জনগণেরস্বার্থে কিছু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু মানসিকতা আর উদারতার অভাবে সেগুলো মুখথুবড়ে পড়ে।জনগণই কাঁটা সাফ করে যে পথ তৈরি করেছিল, কিছু কুচক্রীদের অতিলোভ গোপনে গোপনে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছে বারবার,মানুষ যাবে কোন পথে? বিগত সময়ে দেশের অস্থিরতা লক্ষ করা গেছে প্রতিমুহর্তে, যাদের হাতে রাজ্য,দেশ শাসনের দন্ড, তারা যদি হিংসাশী হয়, তারা যদি ধৈর্যহীন হয়ে পড়ে তাহলে মানুষ কোনদিকে যাবে? হিংসার দাবানল জ্বালিয়ে মানববনে আগুন লাগানো যদি শাসনের অন্যতম হাতিয়ার হয়, দুর্নীতি দ্বারা অর্থ উপার্জন মুনাফা বৃদ্ধির অন্যতম উপাদান, অবাধ মুক্ত বাণিজ্য উদ্দেশ্য হয় তাহলে,,,,,,, কেউ কেউ বলছেন এর জন্য দায়ী গরীব বিজাতীয় সম্প্রদায়, ঘোষিত শত্রু দলিত,জনজাতি ও বিধর্মীরা।'ধর্ম যার যার, কাজ সবার '--এই আপ্তবাক্য থেকে সরে এসে মানুষ বিভাজনের রাজনীতিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পড়ছে।কার ধর্ম মহান, কার ধর্ম বড়ো; কোন ধর্ম ধর্মই নয় আমদানি কৃত, এই চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মানুষ দিশেহারা। ফলে ছেদ লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভেদরেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার মাধ্যমে উগ্রতা, জাতীয়তাবাদ বিরোধী চিন্তা বৃদ্ধি পাবে, লোপ পাচ্ছে পরধর্মসহিষ্ণুতা। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ভালবাসা, পরস্পরের মধ্যে জমে থাকা হাজার বছরের সম্পর্কে ফাটল। ছেদ ঘটছে উৎসবে সামিল হওয়া,  বিরোধ বাড়ছে, ঘৃণা জাগছে মনে অপর সম্প্রদায়ের প্রতি। কেন, কেন, কেন?

আজ মানুষ ইতিহাসের নৌকায় চড়ে হাজার হাজার মাইল পথ বেয়ে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যন্ত্রণার বাতাস অতিক্রম করে সভ্যতার শীর্ষ শিখরে পৌঁছেও, অসভ্যতা,বর্বরতা, হানাহানি, অর্থলীপ্সাকে ত্যাগ করতে পারেনিএটা কি ভারতীয় সভ্যতার চরমতম অবমাননা নয়?

         প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু জন্মাচ্ছে আমাদের দেশে, শিশু মৃত্যুর হার সমানুপাতিক গড়ে কম, তাকে অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে, প্রসূতি মৃত্যুর হার কমেছে, পুষ্টি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চলছে, তথাপি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি তো হচ্ছে না, কর্ম ছাঁটাই চলছে দেশে কোটি কোটি বেকার, তার বোঝা বেড়েই চলেছে নিরন্তর, কার ইশারায় এসব হচ্ছে মানুষ জানতে পারছে নাসকলের মা চায় তার সন্তান দুধেভাতে থাক, দুধভাত না জুটলে নিতান্ত শাকান্ন দ্বারা, তবে  উদরপূর্তি ঘটুক, অল্পে সন্তুষ্টি তাদের। দুর্নীতি আর স্বজন পোষণ এখন অলঙ্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যতটা বেশি দুর্নীতিবাজ, বাহুবলী, যাদের দেহে পশুত্ব বেশি, তারা ততবেশি সুশাসক।তাদের হাতের পাচন দেশ পরিচালনা করে, ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখতে পারে, আমার উপর কোন কথা বলা যাবে না, আমিই শেষ কথার মালিক, এটা গণতন্ত্র হলে, অন্যকথা বলার মানেই হয় না

             ভোটাধিকার গণতন্ত্রের একমাত্র উপাদান নয়, অন্যতম শর্ত। মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ ইচ্ছায় ভোট দেওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলছে, ছাপ্পাভোট মেরে, জাল ভোটা দিয়ে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরছে। ছাপ্পাভোট ও জালভোট দেওয়ার কথা দীর্ঘদিন থেকেই শোনা যাচ্ছেকিন্তু বেলাগাম ছাপ্পাভোট এবার সচক্ষে প্রতীয়মান হয়েছে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজভোট দেওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার তা খর্ব হয়ে গেছে, কার অদৃশ্য হাতের দ্বারা সমাপন ঘটে গেছে আমার উপস্থিতির  পূর্বেইবাহঃ, কি বিচিত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকা মহান ব্যক্তির সামনে গোপনীয়তা ভঙ্গ করে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছেগণতন্ত্রের হাল দেখে মানুষ স্তম্ভিত ও হতবাক। কোথায় গণতন্ত্র! গণতন্ত্রই যেখানে খুন হয়, সেখানে সাধারণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কল্পনার অট্টালিকা। আম-আদমীর জন্য ১০০ দিনের কাজ আদিবাসীদের বনাঞ্চলের অধিকার আইন, দেশের মানুষের তথ্য জানার অধিকার ছাঁটাই হচ্ছেনয়া উদারনীতির যে নীতি তথাকথিত Washington Concensus -এর মাধ্যমে তৈরি হয়, তার একটি আবশ্যিক চরিত্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি মালিকানাদের হাতে তুলে দেওয়া আই এম এফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং মার্কিন অর্থদপ্তর যৌথভাবে আর্থিক সংস্কারের ১০দফা শর্ত তৈরি করে। তারমধ্যে ৮দফা শর্ত ছিল --সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেসরকারিকরণ করতে হবে। বিশ্বায়ণের Prescription -এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এটি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তি মালিকের হাতে তুলে দিলে ব্যক্তি মালিকের লাভ, সেই লাভ থেকে ঘটতে থাকে সমাজে অসমতা,বাড়বে অসাম্য, গরীবেরা আরও গরীব হবে, ধনীরা বৃহৎ পুঁজিপতি রূপে বিরাজ করবে।

            ১৯৯১--৯৬ থেকেই আমাদের দেশে বিলগ্নিকরণের সূত্রপাত। দেশে ৯৯৬২ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিলগ্নিকরণ হয়েছে, ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ দেশে সংযুক্ত বিলগ্নিকরণ কমে দাঁড়ালো ৬৬৬১ কোটি টাকা, শাসকদলের হেরফেরে। আমাদের দেশে ১৯৯৯-২০০৪ সালে দাঁড়ালো ২৮২৪৪ কোটি টাকা, তখন দেশে বাজপেযী-মমতা ব্যানার্জির সরকার। ২০০৪-২০০৯ সালে আবার সেটা নেমে এসেছিল ৮৫১৬ কোটি টাকা।, ২০০৯-২০১৪ সালে সেই বিলগ্নির পরিমাণ লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ালো ৯৯, ৩৬৭ কোটি টাকায় গত শাসনামলে ২০১৯ এর জানুয়ারি পর্যন্ত সম্পদ বিক্রি হয়েছে ২, ৩১, ৫০৩ কোটি।তার জেরে কর্ম ছাঁটাই চলছে দ্রুতগতিতে।

             এই পরিসংখ্যান কেবলমাত্র পাঠকের বুঝতে সহযোগিতা করার জন্য আমরা ভারতবাসী, আমাদের দেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। তাই আমরা আশা করব, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা হোক। এই প্রত্যাশা কি অপরাধের, না স্বপ্নের?  বর্তমান সরকারের কাছে দাবি করতেই পারি যে, জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার পবিত্রতা যেন বজায় থাকে।ছেড়ে দিক ধর্মীয় বিভেদ নীতি, ক্ষমতা দখলই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে মৈত্রী ডালে সকলকেই বেঁধে ফেলতে হবে। মানুষের সম্প্রদায়কে চিহ্নিত না করে, শ্রেণি বিভাজন করতে হবে আর্থিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেই। হিন্দু -মুসলমান-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ-জৈন--শিখ-পারসিক ইত্যাদি সম্প্রদায় নয়, শ্রেণি হোক শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ধনী পুঁজিপতি। এই অসম বিন্যাসকে ভেঙে সমতা ফেরানোর চেষ্টা হোক।

           ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় একদেশ, একনীতি কার্যকর করতে গিয়ে হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান স্লোগান দিয়ে সনাতনী আদর্শের বুকে ছুরিকাঘাত করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবেমিলনের মাঝে ঐক্যের সংহতি বিপন্ন। বিপন্ন ভাষা, সংকট শিক্ষা শিল্প সাহিত্যে, প্রবল ঘৃণার বন্যা বেড়ে যাবে মনের উপকূলে,বিবিধের মাঝে মিলন মহান, জাতির উত্থান অস্তমিত।একদেশ একজাতি কার্যকারণ সম্পর্কে সকল জাতির অস্তিত্ব সংকটে। এখানে ঐক্যের বীনাতারে বেসুরো আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভ্রম হত্যা, গো-রক্ষা, অনুপ্রবেশ নামে এক শ্রেণিকে চিহ্নিত করে স্বদেশভূমি থেকে উৎখাত করার উগ্র মানসিকতা বৃদ্ধি পাবে, তখনই ভারত জননীর অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হবে, আর সেই ক্ষতবিক্ষত শরীরে, দগ্ধজ্বালা বুকে নিয়ত জননি আহত হতে থাকবে। ঐক্য ও মহামিলনের ডাক দিয়ে বলতে পারি না যে ভারতবাসী মুচি, মেথর, কৃষক, দরিদ্র তুমি আমার ভাই, আমার ভারতবাসী। শত বীণা বেণু রবে, সেই ভারতই শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে সক্ষম হবে বিশ্বের বুকে।

    ' হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য, দ্রাবিড়, চীন
     এক দেহে হলো লীন,,,'

মিলেমিশে যে মিশ্র সংস্কৃতিতে আজ ভারত বৈচিত্র্যময়, বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের জাগরণ চলে আসছে যুগ যুগান্তরে, শ্রেণি পরিচয় হোক শ্রমের বিনিময়ে।

    অভিযোগ আমাদের সমাজের একধরনের ডিজিজ। যখন আমি কোন চেষ্টা না করে, শ্রম না খাটিয়ে ফল লাভে ব্যর্থ হই, তখন অভিযোগের শেষ নেই নিজেদের অক্ষমতা,অযোগ্যতা, অপদার্থতা ঢাকতে নিম্নস্তরের লোক ও কর্মীদের দোষ দিই। " কোন রাজনৈতিক দর্শন অপরাজেয় কি না, সময় একমাত্র সে বিচার করতে পারে"

    নির্বাচনে কী কী হয়েছে, ই ভি এমে  কতটা কারচুপি  করা হয়েছে, না কি ৩৭৩ টি কেন্দ্রের গণণায় বিপুল অসংগতি ইত্যাদি বিরোধীদের অভিযোগ ছেড়েই দিচ্ছি, প্রশ্ন যখন ওঠে তখন তার যাচাই দরকার।ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যারা, তাদের কাছে প্রত্যাশা জনগণ করতেই পারে এক সুখি ভারত, গর্বের ভারত, ঐক্যের ভারত। দেশ ভারত সৌন্দর্যে ঝলমলে হবে, নাকি অন্ধকারের তিমিরে, অশান্তির লেলিহান শিখায় দগ্ধীভূত হয়ে বিজনভূমিতে পরিনত হবে,তা নির্ভর করে শাসনক্ষমতা করায়ত্তকারীর শাসন পরিচালনার উপরআমাদের দেশে সম্প্রীতি হোক দেশের সংবিধানের মূল শর্ত মিলে মিশে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকতে চায় একশো পঁচিশ কোটি জনগণ। " মার্ক্সবাদ যেমন কার্ল মার্ক্সের জন্মের দু'শো বছর পরে আজও বিলুপ্ত হয়নি তার চর্চা-প্রয়োগ হয়তো-বা অনেকটা কমছে কিন্তু মতবাদ হিসেবে তার প্রাসঙ্গিকতা একেবারে হারিয়ে যায়নি। মোদীর দল বিজেপি যে-দর্শনে বিশ্বাসী, তা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ সঙ্ঘের দ্বারা জারিত ---'এক জাতি এক দেশ 'দর্শন। এ দর্শন বহুত্ববাদের পরিপন্থী। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, এ দেশ থেকে বহুত্ববাদ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে? শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা-মেরুকরণের ফলে এই নির্বাচনী সাফল্য পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী? না, সর্বাংশে এটি সত্য হতে পারে না একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটদাতারা একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট সে বার্তা -- শুধুমাত্র কয়েকটি ইস্যু ধরে যেমন, অতীতে জিএসটি --ডিমানিটাইজেশন ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না ভুল, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেমন, গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগে প্রহার প্রভৃতিকে ভিত্তি করে এখন আর নির্বাচনী জয়-পরাজয় নির্ণীত হয় না,,,,, নরেন্দ্র মোদীর যাঁরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তারা বিষয়টি ভেবে দেখেননি। জোট নিয়ে বহু আলোচনা তাঁরা করেছেন, কিন্তু তাতে আলোর দিশা মেলেনি,,,জোটের রসায়ন -পাটীগণিত, তা অন্ধকারে রেখে বিরোধীরা যুদ্ধে নেমেছিলেন।ফলে নেতৃত্বে স্কন্ধকাটা জোটের ভরাডুবি ঘটেছে। কংগ্রেস-মুক্ত ভারতবর্ষ বা কমিউনিস্ট শূন্য সমাজ -- বহুদলীয় গণতন্ত্রে কাম্য নয়" বিরোধীদের জনসংযোগ ঘাটতির কারণ অনুসন্ধান করে পরস্পরকে দোষারোপ না  করে এগিয়ে যেতে হবে, কোনও মৌলিক আদর্শ -আইডিওলজি জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে মানুষ দিশা দেখতে পাবে, সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি সমাধানের সহজ ও সরল পন্থা তুলে ধরতে হবে জীবন জীবিকা ও বেঁচে থাকার জন্য ধর্ম প্রধান নয়, ধর্মের আগে প্রয়োজন কাজ, কাজের বিনিময়ে অর্থ, ন্যূনতম বেঁচে থাকতে হলে অর্থ মুখ্য,  এবং এর জন্য প্রজাহিতেষী নীতি কার্যকরকারী প্রকৃত দল হতে হবে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে লড়াই আন্দোলনে পাশে থেকে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে, তাহলেই জনগণের আস্থা পাওয়া সম্ভব।

          সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন আমাদের অনেক নতুন নতুন রসায়ন তুলে ধরেছে, ভারতবর্ষে ভোট বাড়ানোর জন্য সংখ্যালঘু তোষণ এক অতি পরিচিত হাতিয়ার। এই হাতিয়ার কংগ্রেস ও বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে এসেছে, বিজেপি সেই অস্ত্রে শান দিয়েছে অন্য কায়দায় দেশভাগের যন্ত্রণা কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আসতে বাধ্য হওয়ার কাটাদাগ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে থাকে শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারী শব্দ ব্যবহার করে কীভাবে জনগণের ভোট নিজেদের বাক্সে ফেলা যায় তা বিজেপি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে সফল হয়েছেগণতন্ত্রের পথ অতিক্রম দীর্ঘ, এই পথে চলতে গিয়ে নানা বাঁক, মোড় অতিক্রম করে যেতে হবেসংখ্যালঘু জনগণ কতটা সুরক্ষিত থাকছে, কতটা নিরাপদ তার উপর নির্ভর করে আগামী দিনের ভারত, এগিয়ে না, পিছিয়ে পড়ছে

   সময় আমাদের কাছে  নিরাময় ঔষধি, সময়ই শেষকথা বলবে। আমাদের প্রত্যাশা অনেক,জীবন চলমান জাহাজ, সামনে গভীর সমুদ্রের জলরাশি,

  " যমে দুয়ারে টানাটানি জীবন-মৃত্যুর মাঝে
    ঘড়ির কাঁটায় চড়ে সময় অবিরত দৌড়ুচ্ছে --"

নির্বাচন যেমন কারো কারো কাছে আন্দোলন সংগ্রাম ও কর্মসূচি, ঠিক তেমনি এক যুদ্ধ, শুধু যুদ্ধ নয়, সেও এক মহাযুদ্ধ। এই যুদ্ধক্ষেত্রে ধৈর্য ও সহনশীলতা নিয়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকা বীরত্বের কাজ যে সৈনিক ধৈর্য ধরে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে টিকে থাকতে পারবে, ভবিষ্যত তাদের। মানুষ অসহায়, তবুও আশাবাদী

  " ক্ষুধার্ত দিনে প্রত্যাশা ছেড়ে চাই একমুঠো অন্ন
   এ সময়ের যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ তুমি বড়ই বিপন্ন।"

           জাতি-ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে সেই বোধ সদাজাগ্রত থাকলে, তবেই একমাত্র এ বিশ্বাসের জন্ম হতে পারে যে অনাহার-অর্ধাহারে থাকা, ধুলোমাখা নগ্নপদে চলা অসংখ্য মানুষের মধ্য থেকে একদিন না একদিন ঠিক বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ। ভারতের জনগণই ভারত-আত্মার সার্থক প্রতিমূর্তি।
    You will over come soon. India is existing into Indians.


নাসির ওয়াদেন : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন