সীমার জন্য সেদিন ট্রেনে যাওয়া হল না



রম্যরচনা

এ আর কার ভালো লাগে বলুন তো? ভালো লাগার কথাও যে নয়। দু’চারদিন পরপরই বসের নির্দেশ, আপনাকে কলকাতা যেতে হবে। শিলিগুড়ি-কলকাতা করতে করতে আমার তো একেবারে দফারফা। কিন্তু কি আর করার বলুন, বসের হুকুম। অফিসের কাজ বলে কথা। আমি যেন হয়েছি হলুদ-গুড়ো। সব ক্ষেত্রে আমাকেই লাগে। অফিসে আরও তো অনেকেই আছেন, রায়বাবু, সাহাবাবু, দত্তবাবু, সেনবাবু, খানবাবু আরও অনেকেই। তবুও বস তাদের কেন যে পাঠান না, জানি না। প্রত্যেকবার সেই আমাকেই যেতে হবে। আমার কোনও ওজর আপত্তিই কখনও খাটে নি কেবলমাত্র বাবা হওয়ার সময় ছাড়া। তবে হ্যাঁ, প্রথম প্রথম অবশ্য ভালোই লাগতো শিলিগুড়ি-কলকাতা করতে। সে সময়ের কথা আলাদা। তখন যে ছাড়া হাত-পা ছিলাম। ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতাম, সুন্দরী মেয়েদেরও দেখতাম, যখন যেখানে ইচ্ছে হতো চলে যেতাম। তখন কোথায় থাকতাম, কি খেতাম, তা কেউ দেখারও যেমন ছিল না, কেউ বলারও ছিল না। এখন যে সে উপায় নাই। একেবারে কোমরে, থুড়ি কোমরে বলি কেন, একেবারে নাকে গলায় যেন রশি বাঁধা। ঘাড় ঘোরালেই ঘোড়ার মতো রশিতে টান অনুভব করি। 

আর হ্যাঁ, কথাটা আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। তবুও বলি। বিয়ের পরপর বউ ফেলে কোথাও যেতেই কেন যেন ইচ্ছে করতো না আমার। তবে, বিয়ের বছর তিন বাদে যখন বউয়ের কোলে একটা স্যাম্পেল ধরিয়ে দিলাম, তারপর থেকে কেমন যেন মন আর ঘরে বসে থাকতে চাইল না। এমনটা অন্য কোনও পুরুষ মানুষের হয় কি না জানি না, তবে আমার হয়েছিল। মনটা যেই না একটু ছটপট করতে শুরু করল, অমনি দেখি বউয়ের গালমন্দ আর মুখ ঝামটা। সেসব অবশ্য আপনাদের আর বললাম না। তবে, আজকাল ঘর ফেলে বাইরে থাকতে মন চাইলেও ঘন ঘন কলকাতা যেতে আর সত্যিই ভালো লাগে না। তবুও ইদানীং কলকাতা যাওয়াটা আগের তুলনার আমার অনেকটাই যেন বেড়ে গেছে। মানে, যেতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে, আজকাল আমার জলাতঙ্ক রোগের মতো যেন কলকাতাতঙ্ক রোগে ধরেছে। এটা আগে ছিল না। ইদানীং হয়েছে। হেড অফিস থেকে কোনও চিঠি পিওনের নিয়ে আসা দেখলেই আমার ওই রোগটা দেখা দেয়। এই বুঝি আবার পিঠে ব্যাগ বাঁধতে হবে। তারপর অন্তত তিন তিনটা দিন নরকে পড়ে থাকো। এ আর ভালো লাগে না, বুঝলেন। একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি। কিন্তু আমি যে নিরুপায়। সরকারের চাকর। সরকারের চাকর হয়ে তাঁর আদেশ তো আমাকে মানতেই হবে। তা না হলে যে চাকরিটাই বাঁচানো দায়। হাজারো কাঠখড় পুড়িয়ে যে চাকরিটা একদিন পেয়েছিলাম, আজ হুকুম পালন না করতে গিয়ে যদি সেটা চলে যায়, তা হলে বউ বাচ্চা নিয়ে একেবারে পথে বসতে হবে। অগত্যা উপরওয়ালার হুকুম আমাকে পালন করতেই হয় একরকম অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো।

তবুও মেনে নিয়েছি ওসব। কিন্তু গোলটা কোথায় জানেন? গোলটা আমার ঘরে। এত ঘনঘন বাইরে যাই বলে, বউ ইদানীং আমাকে খানিকটা সন্দেহ করতে শুরু করেছে। সেটা ওর হাবভাবে বুঝতে পারি। বাইরে যাওয়ার কথা শুনলেই বউয়ের মুখটা কেমন যেন বাংলার পাঁচের মতো হয়ে যায়। আপত্তি জানায়। বউ আমাকে যতোই সন্দেহ করুক আর যাই করুক, অফিসের আদেশ পালন না করলে বউকে আমার চাকরি চলে যাওয়ার ভয়টা দেখাই। ফলে, সে বাপের বাড়ি যাওয়ার মতো জেদ ধরে আমাকে আর আটকাতে চায় না।

শুনেছি প্রেম নাকি সবার জীবনেই আসে। কিন্তু আমার বিবাহিত জীবনের পূর্বে অন্তত সেরকমটা ঘটেনি। সে যখন এল, তখন বিবাহিত জীবনের বছর কুড়ি পার করে ফেলেছি। অর্থাৎ বয়সের হাফ সেঞ্চুরি যখন করলাম তখন এল প্রেম। ভাবুন একবার! এই বয়সে প্রেম! বউ সন্দেহ করবে না কেন বলুন। তবে দেরি হলেও প্রেম অবশেষে আমার জীবনে এল। সুতরাং প্রেম যে সবার জীবনেই আসে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ আর থাকল না মনে।

সে যাই হোক, আসল কথায় এবারে আসা যাক। এমনিতেই অনেকটা সময় নিয়ে ফেলেছি আপনাদের। আর বেশি সময় নেব না, কথা দিলাম। আসল কথাটা কি জানেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই সীমাকে মৈনাক টুরিস্ট লজের সামনে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। আপনারা হয়তো বলবেন, তাতে কি এমন হয়েছে। বিশ্বাস করুণ, যা হয়েছে তা এই বয়সে বলতে খানিকটা লজ্জা লাগলেও বলছি। সত্যি বলতে কি, ওকে প্রথম দেখেই আর চোখ ফেরাতে পারিনি আমি। মানে, প্রথম দেখাতেই ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। সেই থেকে মনের মধ্যে কেবল সীমা আর সীমা। ওর চেহারা ছবি সময়ে অসময়ে আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগল।

এতবার কলকাতা যাতায়াত করেছি, বিশ্বাস করুণ ট্রেন ছাড়া কখনও বাসে করে যাইনি। বাসে কখনও যেতেও ইচ্ছে করেনি। বাস জার্নির ধকল আমার সহ্য হয় না। ফলে, ট্রেনেই যেতাম। রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেই হল, ব্যাস। ট্রেনের দুলুনিতে নাদুস-নুদুস শরীরটায় ঘুম এমনিতেই যেন চলে আসে। ঘুময়ের মধ্যে কখন যে গঙ্গা পার করে ফেলি, তা টেরও পাই না। কিন্তু অসহ্য লাগে কখন জানেন, যখন ট্রেন শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছায়। মানে, যখন ট্রেন থেকে নামতে না নামতেই কলকাতার বেগুনপোড়া গরমে পরি। 

অসংখ্য মানুষের কিলবিল আর যান-যন্ত্রণায় জীবন একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, না আসতে পারলেই কত না ভালো হত। বাড়িতে বসে বসে বউয়ের আদর অন্তত খাওয়া যেত। এই ভাবনা ভাবতে না ভাবতেই, ঠিক তখনই কথাটা মনে পড়ে যায়। কোন কথাটা জানেন? ওই যে, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস’।

যাকগে, যা বলছিলাম সে কথায় বরং ফিরে। সেদিন শুনলাম, সীমা নাকি কলকাতা যাচ্ছে। এ কথা শোনামাত্রই, আমি জেনে নিলাম, সীমা কবে আর কখন যাচ্ছে। ব্যাস, সেই থেকে আমারও হয়ে গেল। আর আমার কপালটা দেখুন, যেদিন জানলাম সীমা কলকাতা যাচ্ছে, ঠিক তার দু’দিন বাদেই আমার কলকাতা যাওয়ার অর্ডার হল। ওই, যেমনটা হয় আরকি। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো আমি তো আছিই। বসের অর্ডারের উপর না করার মতো বুকের পাটা আমার আগেও ছিল না, এখনও নেই। যা সত্যি তাই বললাম। সে যাইহোক, আমাকে যখন যেতেই হবে, তখন আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, এবারে আমি সীমার সঙ্গেই যাবো। সীমা আমার প্রথম প্রেম, বুঝলেন। শেষ প্রেমও বলা যেতে পারে। যদিও পুরুষ মানুষের নাকি আবার একখানে মন স্থির থাকে না। এ ফুল ও ফুল করা তাদের চাই-ই চাই। আমি অবশ্য ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়ি। বিশ্বাস করুণ, নিজের কথা বলে বলছি না। যা সত্যি তাই বললাম আর কি।

সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই বউকে ডেকে বললাম- ‘হ্যাঁগো শুনছো, কাল তোমাকে আবার ব্যাগ গুছাতে হবে’। কথা শোনা মাত্রই দেখলাম বউয়ের মুখের আদল ফটাং করে পাল্টে গেল। অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথাই বলল না। আমি সাধ্যমতো মলম লাগানোর চেষ্টা করে গেলাম। মিথ্যে বলবো না, বউ অবশ্য পরদিন ব্যাজার মুখে আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দিল। এবারে আমি যে ট্রেনে করে কলকাতা যাচ্ছি না, যাচ্ছি বাসে করে সে কথা বউ জানে। কথাটা বউকে আমিই বলেছি। তবে, সীমার সঙ্গে যে যাচ্ছি, সে কথা আর বউকে বলিনি। নির্ঘাত আস্ত বোকা না হলে, সে কথা কেউ কি আর বলে বলুন? অতোটা বোকা অন্তত আমি নই। জেনে বুঝে কেউ কি আর অশান্তি ডেকে আনতে চায় ঘরে? সুতরাং সীমার বিষয়ে আমি একেবারে শামুকের ভূমিকা নিলাম।

সেদিন বাড়ি থেকে বেরনের আগে বউকে একটু ইয়ে, মানে, একটু মন ভুলানো আদর করে টাটা বাইবাই করলাম। বিদায় বেলায় বউ তার অভ্যাস মতোই দু’দুবার দুগ্যা দুগ্যা বলে উঠল। আর আমি ভাবখানা এমন করলাম যে, কিছুতেই যেন বউকে ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না। বউ অবশ্য সেটা বুঝল কিনা জানি না।  সে যাইহোক, শিলিগুড়ি জংশনে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই দেখি, পেট্রোল পাম্পের শেডের নিচে সীমা একা দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই সে আমাকে ডাকল। আর এমন ভাবে ডাকল আমাকে, যেন আমি তার বহুদিনের চেনা। আমি বুঝলাম, প্রেম আমার একতরফা ছিল না। সীমাও নিশ্চয়ই আমাকে লাইক করে। তা না হলে, সে আমাকে এভাবে ডাকবে কেন। আমি আর কোনও আগুপিছু না করে সরাসরি ওর কাছে গেলাম। একেবারে কাছ থেকে দেখলাম সীমাকে। এমন স্নিগ্ধ, পরিপাটি চেহারার কেউ যে হতে পারে, সে আমার ধারনায় ছিল না। মনে হল, এইমাত্র সীমা বুঝি স্নান সেরে হাওয়ায় চুল শুখাতে দাঁড়িয়েছে। 

আমি টিকিট কেটে উঠে পড়লাম বাসে। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রেখে নিজেও গুছিয়ে বসলাম সিটে। সীমা তখন আমার সঙ্গে। বুঝলাম সীমা ভীষণ শান্ত, মানে একেবারে ভীষণই ঠাণ্ডা প্রকৃতির। যেমন ওর রূপ, তেমনি ওর পরিপাটি ভাব। আমার আবার এমনটাই পছন্দ, বুঝলেন। আজ মনে হল যাত্রাটা সত্যিই স্বপ্নের হবে। এতদিন তো ট্রেনে গেছি। সেখানে হাজারো নোংরা। যত্রতত্র বাদাম খোসা, চায়ের কাপ, বিস্কুটের র‍্যাপার, নোংরা জল, আরশোলার ছড়াছড়ি। আর বাথরুম? সে কথা এখানে নাই বা বললাম। সে এক নরক সমান। কিন্তু আজ মনে হল সে নরক যাত্রা থেকে শত যোজন দূরে আমি সুখে গা ভাসিয়েছি সীমার সঙ্গে। বাস যখন ছাড়ল, তখন সবে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। ভেতরে কেবল একদুটি মৃদু নীল আলো। সীমার সংস্পর্শে আসতে না আসতেই আমার প্রাণ একেবারে যেন জুড়িয়ে গেল। বউ বাচ্চার কথা তখন আর মনেই পড়ল না আমার। বিষয়টা অন্যায় হলেও সত্যি। কিন্তু কি করব বলুন। আমার তখন কেবলই যেন মনে হতে লাগল, আমি আর সীমা ছাড়া কেউ নেই আর এ পৃথিবীতে।

সীমা আমাকে জল খেতে দিল। একেবারে মিনারেল ওয়াটার। বাসটা যখন শহর ছাড়িয়ে হুহু করে ছুটতে শুরু করল, তখন দেখি সীমা নিজের মনে গান গাইতে শুরু করল খুব নিচু গলায়। কোন গানটা জানেন। ওই সেই বিখ্যাত গান, ‘এ রাত তোমার আমার, শু-ধু-উ-উ দু’জনে.......’। আমি শুনতে লাগলাম। নিজেকে উত্তম কুমার ভাবতে লাগলাম। বিশ্বাস করুণ, আমার ভেতরটা কেমন যেন করতে লাগল। এরকম একটা পরিবেশে একজন পুরুষ মানুষের মনে কি ঘটতে পারে, আপনারা ভাবুন একবার। অন্যদের মনে কি হচ্ছিল জানি না, তবে, আমার মনে যা ঘটছিল সে কথা আপনাদের একটু বলি। সীমা যে এভাবে গান শুনিয়ে আমার হৃদয় একেবারে ভেঙে দেবে তা ভাবতে পারিনি। আমি তখন সীমার বুকে হাফ, না হাফ না, একেবারে পুরো মাথাই দিয়ে ফেলেছি। সীমাকে একটু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছি। আমার ঠাণ্ডা লাগতে পারে বুঝে, সীমা কখন যেন আমার গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে দিয়েছিল। অন্য যাত্রীদের মধ্যে কে কি ভাবেছে, জানি না। তবে, কম্বল গায়ে জড়িয়ে সীমার বুকে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, সে খেয়াল আর আমার ছিল না। পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, দেখি সকালের রোদ্দুর বাসের জানালায় উঁকিঝুঁকি মারছে। রাতে ঘুমটা বেশ ভালই হয়েছে। ফলে, জার্নিটা আর জার্নি বলেই মনে হল না। কলকাতা পৌঁছেও গেলাম সকাল সাতটার মধ্যে।   তখন শুধু মনে হতে লাগল, কেন যে এতদিন সীমার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আগে আলাপটা হলে দালাল ধরে আর ট্রেনের টিকিট কাটতে হত না। সীমা পরিবহণের বাসে করেই শিলিগুড়ি-কলকাতা করতে পারতাম। সীমার মতো আরামদায়ক এসি বাস পেয়ে ট্রেনের টিকিট কাটার টেনশনটা আমার মন থেকে দূর হল। বাস থেকে নেমে সীমাকে টাটা বাইবাই করলাম আবারও উঠবো বলে।

অরুণ কুমার সরকার : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


1 টি মন্তব্য: